ইউরোপের দেশ জার্মানিতে বাংলাদেশিদের আগমন ইউরোপের অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম৷ গত কয়েকবছরে কয়েক হাজার বাংলাদেশি শরণার্থী হিসেবে জার্মানিতে প্রবেশ করেছেন৷ যাদের অনেকে আবার অন্যত্র চলে গেছেন, বা যেতে বাধ্য হয়েছেন৷ তবে জার্মানিতে নানাভাবে অনুপ্রবেশ করা ও অবৈধভাবে বসবাসরত আটককৃত ৮১৬ জন অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাচ্ছে জার্মান কর্তৃপক্ষ’৷ আর এই বিতাড়নে সহায়তা করছে বাংলাদেশ সরকার৷
দেশটিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জার্মানির চাপে নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়া এসব বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। যাদের ফেরত পাঠানো হবে তাদের সব তথ্য ইতোমধ্যে দেশটির একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে যাচাই করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২৬ অক্টোবর প্রায় অর্ধশত অভিবাসনে ব্যর্থ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তাদের ঢাকা পৌঁছে দিতে ১৩০ জনের মতো জার্মান নিরাপত্তারক্ষীও বাংলাদেশের ভিসা নিয়েছেন৷’
করোনা মহামারির কারণে বেশ কিছুদিন অনিয়মিত অভিবাসীদের বিতাড়ন সীমিত থাকলেও এখন তা পুনরায় গতি পেয়েছে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত৷ তিনি বলেন, এবারই প্রথম একসঙ্গে ৬২ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘটছে।
তবে, তিনি জানিয়েছেন যে ঢাকার গণমাধ্যমে আটশ’র বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর যে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়৷
তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বসবাসের অনুমতি নেই এমন বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ও ইইউ এর মধ্যে ২০১৭ সালে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি)’ স্বাক্ষরিত হয়৷ আমরা সেই চুক্তি অনুসরণ না করলে আমাদের উপর ভিসা কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে ইইউ৷’
২০১৭ সাল থেকে এখন অবধি ৮১৬ জনের জন্য ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ ইস্যু করতে বাংলাদেশের প্রতি জার্মানি অনুরোধ জানিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রদূত৷ তবে, তিনি বলেন, ‘এদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে জার্মানি ছেড়ে চলে গেছেন৷ ফলে জার্মানি এখন আটশ’র বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাচ্ছে এটা বলা ঠিক নয়৷ বর্তমানের সংখ্যাটি অনেক কম৷’
জার্মানি যেসব কারণে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে থেকে জানা যায়, মূলত বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, সামাজিক গোষ্ঠী কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে যারা নিজেদের দেশে নিজেদের নিরাপদ মনে না করে অন্য দেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেন তাদের এই ক্যাটাগরিতে আশ্রয় দেয়ার জন্য বিবেচনা করা হয়৷ তবে যারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে দেশত্যাগ করেন এবং অবৈধভাবে জার্মানিতে প্রবেশ করেন, তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বিবেচনা করা হয় না৷ আন্তর্জাতিক এবং জার্মান আইন অনুযায়ী, যেসব মানুষ নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির আশায় অবৈধভাবে অন্যদেশে যাচ্ছেন, তারা শরণার্থী নন৷ ফলে সংঘাতপ্রবণ নয় কিংবা যুদ্ধ চলছে না, এমন দেশের মানুষরা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চাইলে অধিকাংশক্ষেত্রেই তা বাতিল হয়ে যায়৷ তবে যারা আশ্রয় পান, তাদেরকে তিন বছরের জন্য আশ্রয় দেয়া হয়৷ সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সেটা নবায়ন করা হবে কিনা তা পুনরায় মূল্যায়ন করা হয়৷
যারা রাজনৈতিক কারণে নিজের দেশে নিগৃহের শিকার হয়েছেন কিংবা হওয়ার আশঙ্কায় আছেন, তাদেরকে এই ক্যাটাগরিতে জার্মানিতে আশ্রয় প্রদান করা হয়৷ তবে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে চাইলে অবশ্য আশ্রয়প্রার্থীকে নথিপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি তার দেশে নিরাপদ নন৷ জার্মান সরকারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক আশ্রয় খুব কম মানুষকে প্রদান করা হয়৷ যারা এই আশ্রয় পান তাদেরকে প্রথমে তিন বছর মেয়াদে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়৷ পরবর্তীতে সেই মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ থাকে৷
যে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে আশ্রয় পাননি কিন্তু নিজের দেশে ফিরলে মৃত্যুদণ্ড বা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে পারেন, তাকে জার্মানিতে শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জন্য বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়৷ মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতের কারণে যদি কেউ দেশে ফিরতে না পারেন তাকেও এই ক্যাটাগরিতে থাকতে দেয়া হয়৷ তবে একবছর পর তার বসবাসের মেয়াদ বাড়বে কিনা সেটা নির্ভর করছে জার্মান কর্তৃপক্ষের উপর৷
খুবই দুর্লভক্ষেত্রে এ ধরনের বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়৷ যদি একজন আশ্রয়প্রার্থীর উপরে উল্লেখিত সবগুলো ক্যাটাগরিতে আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হয়, তারপরও জার্মান কর্তৃপক্ষ চাইলে তাকে ফেরত পাঠানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে৷ এই নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় কনভেনশন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি তার দেশে ফেরত গেলে তার মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে কিনা সেটা বিবেচনা করা হয়৷ এক্ষেত্রেও আশ্রয়ের মেয়াদ হয় একবছর৷ এই সময়ের পর বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করা হয়৷
রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই, তবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটছে
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তেমন একটা দেখা যায়নি৷ আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো পরিস্থিতিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে নাই৷ তাই, ইইউতে দেশটির বাসিন্দাদের আশ্রয়ের আবেদন তেমন একটা গ্রহণ করা হয় না৷
মোটের উপর ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি বাংলাদেশ, ইরাক এবং গাম্বিয়ার নাগরিকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের সুপারিশ করেছে, যদি তারা ইউরোপে অবস্থানরত বৈধ বসবাসের অধিকার নেই এমন দেশগুলোর নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে সহায়তা না করে৷
বাংলাদেশ সরকার এরকম নিষেধাজ্ঞা এড়াতে দূতাবাসগুলোর প্রতি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সহায়তার নির্দেশনা দিয়েছে৷
যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবস্থাদৃষ্টে শান্ত রয়েছে, তাসত্ত্বেও দেশটির মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং কমিটি এগেনিস্ট টর্চারের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো মাঝে মাঝেই বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে নির্বিচারে আটক, নির্যাতন, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনে৷
গত দশকে দেশটিতে বেশ কয়েকজন ইসলাম ধর্মের সমালোচক ব্লগার ও সমকামীদের অধিকারের পক্ষে সংগ্রামরত অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যা করেছে উগ্রপন্থিরা৷ এরপর অনেক বাংলাদেশি ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন৷
‘এধরনের ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে দেশটিতে শুধু নাস্তিক ব্লগার বা এলজিবিটিকিউ অ্যাক্টিভিস্টরাই নয়, সরকার সমালোচক এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও হুমকি এবং নির্যাতনের মুখে রয়েছেন।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জার্মানির বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ বের্নহার্ড হার্টলাইন মনে করেন, জার্মানি থেকে অনিয়মিত অভিবাসীদের বিতাড়ন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়৷ তবে তিনি বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদনগুলো আলাদা আলাদাভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাইয়ের আহ্বান জানান৷
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে৷ কিছুদিন আগে কারাগারে একজন লেখকের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ মৃত্যুর আগে তার জামিনের আবেদন বেশ কয়েকবার বাতিল হয়েছিল৷ তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷’
হার্টলাইন, ‘এধরনের ঘটনা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে দেশটিতে শুধু নাস্তিক ব্লগার বা এলজিবিটিকিউ অ্যাক্টিভিস্টরাই নয়, সরকার সমালোচক এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও হুমকি এবং নির্যাতনের মুখে রয়েছেন।’
আশ্রয়ের আবেদন কমছে
এদিকে, পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েকবছরে জার্মানিতে বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদনের হার কমতে শুরু করেছে৷ জার্মানির কেন্দ্রীয় অভিবাসন এবং শরণার্থী দপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল অর্থাৎ এসওপি চুক্তি স্বাক্ষরের বছরে জার্মানিতে আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন ৫৭১ বাংলাদেশি৷ ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮৯ জনে৷
চলতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষ অবধি ৮৮ বাংলাদেশি জার্মানিতে আশ্রয়ের আবদেন করেছেন৷ আর সামগ্রিকভাবে এধরনের আবেদন মঞ্জুরের হার ৬.১%, জানাচ্ছে পরিসংখ্যান৷
কেন্দ্রীয় অভিবাসন এবং শরণার্থী দপ্তরের প্রেস স্টাফ ক্রিস্টিনা বানাশ এই বিষয়ে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান যে আশ্রয়ের আবেদন পরীক্ষার ক্ষেত্রে তার দপ্তর বিভিন্ন সূত্র থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের পরিস্থিতি যাচাই করে৷
তিনি বলেন, ‘এই প্রক্রিয়া এটাই নিশ্চিত করে যে একজন আশ্রয়প্রার্থীর আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া ব্যক্তিরা প্রার্থীর দেশ এবং সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত৷’
যাদের ফেরানো হয়েছে
জার্মানিতে গত কয়েকবছরে আশ্রয়ের আশায় অবৈধপথে আসা বাংলাদেশির সংখ্যা কয়েক হাজার৷ সরকারি এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন ২,৬৫৭ জন বাংলাদেশি৷ সেবছর আশ্রয় পেয়েছেন ১০৯ জন৷ ২০১৭ সালে অবশ্য আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে অনেক৷ ২০১৭ সালে জার্মানিতে আশ্রয়ের প্রার্থনা করেন মাত্র ৪৬ জন শরণার্থী৷ আর আটজনের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে৷ আর ২০১৮ সালে জার্মানিতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশির সংখ্যা ১০১ জন, আশ্রয় পেয়েছেন ৩১ জন৷
জার্মানিতে অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, নাস্তিকতার চর্চা, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, বিহারি নির্যাতন এবং সমকামিতার কারণে নিপীড়নের শিকার হওয়ার মতো কারণ দেখিয়ে আশ্রয়ের আবেদন করেন বাংলাদেশিরা৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যতটা না আগ্রহী তারচেয়ে বেশি আগ্রহ রাজনৈতিক কারণে অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রতি। ইতোমধ্যে সরকার বিদেশে নিবন্ধনকৃত অনলাইন নিউজ সাইটগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে যাদের অধিকাংশই দেশ ও রাষ্ট্র নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশন করে থাকে, যা দেশটির সরকারের বিরুদ্ধেই চলে আসে। এরই প্রেক্ষিতে দেশে নিবন্ধনের অজুহাতে বিদেশে নিবন্ধনকৃত সাইটগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে বিদেশে বসে সরকারের সমালোচনা করে এমনসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই মূলত ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার।
তারা বলেন, দেশে ফিরে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়বেন বিহারীরা ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। যারা নানা সময়ে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা নির্যাতিত হলেও সরকারের এবিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ থাকে না। বরং ভোটের রাজনীতি তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৯
আপনার মতামত জানানঃ