বিশ্বজুড়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আয়ে বিস্তর পার্থক্য আছে। স্বামীরা যে অর্থ উপার্জন করেন, তার সমান আয় করেন না বেশির ভাগ নারী। সংসার সামলানো, বাচ্চা লালন-পালনসহ নানা কাজে নারীরা এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে উপার্জনের দিক থেকে। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, স্ত্রীরা উপার্জনের দিক থেকে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে আছে। অধিকাংশ নারীই স্বামীর চেয়ে কম উপার্জন করে থাকেন। বুধবার (১৩ অক্টোবর) বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
জরিপটি বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ফর পাবলিক পলিসির দুই গবেষক অধ্যাপক হেমা স্বামীনাথ ও অধ্যাপক দীপক মালগান করেছেন। ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী ২.৮৫ মিলিয়ন পরিবারের স্বামী-স্ত্রী থেকে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে এই জরিপটি করা হয়। ১৯৭৩ থেকে ২০১৬ সাল— এই চার দশকে বিশ্বের ৪৫ দেশে বিদ্যমান তথ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো পরিবারের ভেতরে স্বামী-স্ত্রীর মজুরিতে লিঙ্গ বৈষম্যের এই বৈশ্বিক গবেষণাটি করা হয়।
গবেষণায় স্ত্রীরা কেন কম উপার্জন করেন, এর কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়। গবেষকেরা বলেন, স্ত্রীদের কম উপার্জনের কিছু কারণ সর্বজনীন। সাংস্কৃতিকভাবে পুরুষকে দেখা হয় রুটিরোজগারের মূল হিসেবে, আর নারীকে গৃহিণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক নারী সন্তান জন্মের পর বিরতি নেন অথবা বেতনভুক্ত কাজও ছেড়ে দেন। সেই সঙ্গে বিশ্বের অনেক জায়গায় একই কাজের জন্য পুরুষের তুলনায় নারীকে কম মজুরি দেওয়ার বাস্তবতা রয়ে গেছে। অবৈতনিক গৃহকর্ম ও যত্নশীলতা এখনো নারীর দায়িত্ব হিসেবে আরোপিত আছে।
অধ্যাপক হেমা স্বামীনাথন বলেন, `সাধারণ ধারণা হলো যে একটি পরিবারের উপার্জন সমানভাবে বণ্টন করা হয়। কিন্তু পরিবার প্রায়ই বড় অসমতার একটি জায়গা এবং আমরা এটি উন্মুক্ত করতে চেয়েছি।’
অধ্যাপক দীপক মালগান বলেন, সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উন্নত দেশ হোক আর দরিদ্র দেশ হোক, যেখানে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই কাজ করেন এমন ক্ষেত্রে স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের চেয়ে বেশি আয় করতে পারেন না। নর্ডিক দেশগুলোর ক্ষেত্রেও অবস্থা এমনই, যদিও বিশ্বের এই অঞ্চলে লিঙ্গবৈষম্য খুবই কম।
অধ্যাপক স্বামীনাথ বলেন, প্রথাগত দারিদ্রতার ক্ষেত্রে পরিবারকে একটি একক হিসেবে দেখা হয়। একটি সাধারণ চিন্তা হলো পরিবারের মধ্যে আয় এক জায়গায় করা হয় এবং সদস্যদের মধ্যে সমানভাবে তা বণ্টন করা হয়। কিন্তু পরিবারই হচ্ছে বৈষম্যের সবচেয়ে বড় জায়গা এবং আমরা সেটিই দেখাতে চেয়েছি।
প্রতিবেদনে পরিবারকে ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক স্বামীনাথ বলেন, আমরা ভেরতটায় চোখ রাখি না। আমরা যদি ভেতরটায় চোখ রাখতাম তাহলে ছবিটা অন্যরকমভাবে বদলে যেত।
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের জন্য ভারত বেশ পরিচিতি। তবে সেখানে খুব বেশি নারী চাকরি করেন না এবং যারাই করেন তাদের অধিকাংশই পূর্ণকালীন চাকরি করেন না। যদিও স্বামীনাথ ও মালগান বৈশ্বিক চিত্রটা দেখাতে চেয়েছেন। তারা বলেন, উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নর্ডিক দেশগুলোকে লিঙ্গ সমতার বাতিঘর মনে করা হয়।কিন্তু সেখানকার অবস্থা কেমন? সেখানে বাড়িতে কি সম্পদ ও কাজকে সমভাবে বণ্টন করা হয়?
তারা বিশ্বের দেশগুলোকে সামগ্রিক ও পরিবার এই জায়গাতে বৈষম্যের ভিত্তিতে স্থান দিয়েছেন। তাদের ফল অনুসারে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব দেশের পরিবারেই বৈষম্য আছে, তা গরিব বা ধনী দেশই হোক না কেন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতির কারণে প্রচলিত প্রথা ভেঙে নারীর আয় বেড়ে গেলে তা পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। স্ত্রী যদি পরিবারে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন তবে সবচেয়ে কম চাপ অনুভব করেন স্বামী। কিন্তু স্বামীর আয়ের চেয়ে স্ত্রীর আয় বেড়ে গেলেই তখনই অনিরাপদ বোধ শুরু হয়ে যায়।
মালগান বলেন, সস্প্রতি পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন, এমন একটি দেশও পাওয়া যায়নি—(সেটা উন্নত কিংবা ধনী দেশ হোক না কেন) যেখানে স্বামীর সমান সমান আয় স্ত্রী করেন। এমনকি নর্ডিক দেশগুলো যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে কম লিঙ্গ বৈষম্য, আমরা সবখানেই দেখেছি নারীর ভাগ ৫০ শতাংশের চেয়ে কম।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী নারীরা মোট কর্মঘণ্টার ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ বিনা মূল্যে সেবা দিয়ে থাকেন, যা পুরুষের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি। আর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশে এটি বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়ায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈতনিক যত্নের কাজ হচ্ছে নারীর শ্রমশক্তিতে প্রবেশ, টিকে থাকা ও অগ্রগতিতে প্রধান বাধা। একজন নারীর কম আয়ের অর্থনৈতিক পরিণতিও অনেক সময় ভালো হয় না।
হেমা স্বামীনাথন বলেন, গৃহিণী হিসেবে স্ত্রীর অবদান অদৃশ্য, অথচ নগদ দৃশ্যমান। সুতরাং একজন স্ত্রী যখন উপার্জন করেন, নগদ অর্থ আনেন, তখন একটি নির্দিষ্ট মর্যাদা ভোগ করেন। এটি তার অবস্থান উন্নত করে এবং পরিবারের মধ্যে তার কণ্ঠ জোরালো হয়। বর্ধিত উপার্জন তার আলোচনার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, একটি দর-কষাকষির হাতিয়ার দেয়, এমনকি অপমানজনক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একটি বিকল্প পথ দেয়।
এসবের মধ্যেও আশার কথা হলো ১৯৭৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিবারের ভেতরের এই বৈষম্য ২০ শতাংশ কমেছে। তবে এখনো যা আছে, তা অনেক। সেই হার কমাতে সচেষ্ট হতে হবে বলে মনে করেন গবেষকেরা।
হেমা স্বামীনাথন বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি ঘটেছে এবং শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের অনেক জায়গায় আরও নারীবান্ধব নীতি স্বামীদের আয়ের সঙ্গে ব্যবধানকে সংকুচিত করেছে। সমান কাজের জন্য সমান বেতনের জন্য আন্দোলন হয়েছে। এ সবই ব্যবধান কমাচ্ছে। তবে এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যবধান রয়েছে, যা অবশ্যই কমাতে হবে।
হেমা স্বামীনাথনের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এ নিয়ে কোনো কথা বলছে না। কোম্পানিগুলো যথেষ্ট পরিমাণে নারীদের কাজের সুযোগ দিচ্ছে না।
ভারতের এই বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন করেন, নারীদের কাজের কী স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে? তাদের জন্য যে নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেটি কি তাদের পরিবার ও শিশুবান্ধব? এর জন্য পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে, যারা নারীদের সঙ্গে অবৈতনিক কাজের বোঝা ভাগ করে নেবেন। এ ছাড়া সরকার এবং সমাজেরও করার অনেক কিছু আছে। এভাবে চলতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংস্কৃতিকভাবে পুরুষদের উপার্জনকারী হিসেবে দেখা হয়। আর নারীদের গৃহিণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক নারী সন্তান প্রসবের পর বাইরে কাজ করা বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া নারী ও পুরুষের মধ্যে মজুরিবৈষম্যও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এখনো রয়েছে। এ ছাড়া নারীরা ঘরের কাজ কোনো মজুরি ছাড়াই করে যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দম্পতি কর্মজীবী হলে ঠাটবাটে কে কার চেয়ে এগিয়ে যাবেন, একটা দৌড় শুরু হয়। এমন দৌড়ে স্ত্রী যদি স্বামীকে টপকে এগিয়ে যান, তখন বিরূপ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। স্বামী ভুগতে পারেন অনিরাপত্তায়। স্ত্রীর আয় বেশি হয়ে গেলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার শিকার হয়ে স্বামী অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন, যা বেড়েই চলে। যে স্বামী তার স্ত্রীর আয়ে পুরোপুরি নির্ভর করেন, তার অবস্থা থাকে সবচেয়ে করুণ। স্ত্রীর আর্থিক সমর্থনে চলা পুরুষেরা সবচেয়ে বেশি অবসাদগ্রস্ত থাকেন।
তারা বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতির কারণে প্রচলিত প্রথা ভেঙে নারীর আয় বেড়ে গেলে তা পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। স্ত্রী যদি পরিবারে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন তবে সবচেয়ে কম চাপ অনুভব করেন স্বামী। কিন্তু স্বামীর আয়ের চেয়ে স্ত্রীর আয় বেড়ে গেলেই তখনই অনিরাপদ বোধ শুরু হয়ে যায়।
আরও বলেন, স্ত্রীর অধিক আয়ের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক বিষয়ের পাশাপাশি জীবন সন্তুষ্টি, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সম্পর্কচ্ছেদ, বৈবাহিক দর-কষাকষির ক্ষমতার মতো বিষয় যুক্ত হয়ে যায়। প্রথাগত লিঙ্গ ভূমিকার পরিণতি হিসেবে এটা তৈরি হয়।
তারা বলেন, অনেক পরিবারে মনে করা হয় পুরুষই হবে মূল রোজগেরে। ছোটবেলায় অনেক বইতে পরিবারে বাবার ভূমিকা হিসেবে লেখা হয়, যিনি পরিবারের জন্য আয় করেন এবং মায়ের ভূমিকা পরিবারের দেখাশোনা করা। এ ধারণা নিয়েই অনেকে বড় হন। তাই নারীর আয় বেড়ে গেলে অনেক পুরুষকেই অনিরাপত্তায় ভুগতে দেখা যায়। লিঙ্গ নিয়ে গৎবাঁধা ধারণার কারণেই রীতিনীতির বাইরের কোনো বিষয় গ্রহণ করতে মানুষের কষ্ট হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৯
আপনার মতামত জানানঃ