আয়ের দিক থেকে দেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের চেয়ে মুসলমানরা অধিক সচ্ছল। দেশে মুসলমান ব্যতিত হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে হতদরিদ্রের হার বেশি। আয়ের দিক থেকে ধর্ম ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে হতদরিদ্রের হার ১১ শতাংশ। এ হার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া খ্রিষ্টধর্মের ২১ শতাংশ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ২২ শতাংশ মানুষ হতদরিদ্র।
সরকারের এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। এই সমীক্ষাতেই দেশে প্রথমবারের মতো ধর্মভিত্তিক ধনী-গরিবের হার কত, তা বের করা হয়েছে। একই সঙ্গে তুলে আনা হয়েছে জাতিগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যকার দারিদ্র্যের হারও।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে সমীক্ষাটি করিয়েছে।
ধর্ম ও জাতিগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাভিত্তিক দারিদ্র্যের বর্তমান অবস্থা নির্ণয়ের কারণ হিসেবে বিআইডিএস বলছে, জাতিসংঘ–ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) কাউকে পিছিয়ে না রেখে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে সব দেশ অনুস্বাক্ষর করেছে, যাতে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাতিগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে চাকমাদের ৭১ শতাংশ, সাঁওতালদের ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ, মারমাদের ৬৫ শতাংশ, ত্রিপুরাদের ৭৭ শতাংশ, গারোদের ৪৭ শতাংশ, ম্রোদের ৯৮ শতাংশ, খাসিয়াদের ১৭ শতাংশ ও মণিপুরিদের ৮ শতাংশ হতদরিদ্র।
ধর্ম ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক আলাদা সমীক্ষা করার কারণ সম্পর্কে বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলফিকার আলী বলেন, ‘ধর্মভিত্তিক এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে দরিদ্রের হার কত, তা আমরা দেখতে চেয়েছি। কে মুসলমান, কে হিন্দু এসব না দেখে সবাইকে নিয়েই যাতে উন্নয়ন হয়। এ সমীক্ষার ফলে সরকারের যেকোনো নীতিকৌশল প্রণয়ন সহজ হবে। সবার দিকেই সরকারের সমান নজর যাবে।’
সমীক্ষামতে, দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম। এই জেলার ৫৪ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে বান্দরবান (৫০ শতাংশ) ও দিনাজপুর (৪৫ শতাংশ)। অন্যদিকে সম্পদে সবচেয়ে পিছিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা, যেখানে ৬৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ মানুষের একটির বেশি সম্পদ নেই। সম্পদ কমের দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে কক্সবাজার (৫৯ শতাংশ) ও বান্দরবান (৫৬ শতাংশ)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব এলাকা পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থানের অভাব। দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাগুলোতে বছরের সব সময় মানুষের হাতে কাজ থাকে না। আর যেসময় কাজ থাকে, তখন মজুরিও কম পান। সরকার যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালাচ্ছে, সেখানেও অনিয়ম বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্য সমস্যাও তাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। কর্মসংস্থানের অভাব এবং স্থানীয় চাহিদা ও সম্ভাবনা বিবেচনায় উদ্যোগ না নেওয়ায় জেলাগুলো দারিদ্র্যের কবল থেকে বের হতে পারছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এখন হতদরিদ্রের সংখ্যা সবচেয়ে কম নারায়ণগঞ্জে, যা শতকরা হিসাবে মাত্র ১ শতাংশের নিচে। অথচ এই জেলাতেই কিনা ৬ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪২ শতাংশই স্কুলে যাচ্ছে না। অর্থাৎ জেলাটিতে স্কুলে যাওয়ার মতো প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ১৮ জনই পড়াশোনার মধ্যে নেই। স্কুলে যায় ৮১ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিশু।
আয়ের দিক থেকে প্রথম স্থানে থাকা নারায়ণগঞ্জের পেছনেই রয়েছে প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা মাদারীপুর। আয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে নারায়ণগঞ্জের প্রতিবেশী মুন্সিগঞ্জ। তবে মাদারীপুর ও মুন্সিগঞ্জে শিক্ষার হার নারায়ণগঞ্জের চেয়ে বেশি।
দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম। এই জেলার ৫৪ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে বান্দরবান (৫০ শতাংশ) ও দিনাজপুর (৪৫ শতাংশ)।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে আয়বৈষম্য সবচেয়ে বেশি খুলনা জেলায়। আয়বৈষম্যে খুলনার পেছনে রয়েছে যথাক্রমে পিরোজপুর, কুষ্টিয়া ও নওগাঁ জেলা। অন্যদিকে সবচেয়ে কম আয়বৈষম্যের জেলা হচ্ছে কক্সবাজার। এরপরে আছে যথাক্রমে সিরাজগঞ্জ ও ময়মনসিংহ।
উপজেলা ভিত্তিতে দেশে সবচেয়ে গরিব হলো বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম এবং কুড়িগ্রামের রাজীবপুর।
এর আগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রকাশিত ‘এক্সট্রিম পোভার্টি: দ্য চ্যালেঞ্জেস অব ইনক্লুশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জানানো হয়, কোভিড পরবর্তীতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মধ্যে ২০২১ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালেও দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক (ডিজি) ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার যা ছিল, ২০২১-এর জানুয়ারিতেও একই আছে। ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার কমেছিল। কিন্তু করোনা মহামারির ফলে এটা বেড়ে গিয়েছিল।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অতি ধনীর সম্পদ বাড়ছে। এর একটা ভালো দিক হলো, দেশের সম্পদ বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে সম্পদ কি তারা সঠিক পথে আয় করেছেন? তার ন্যায্য আয়কর কি তারা দেন? নাকি ওভার ইনভয়েস করে সে টাকা বিদেশে পাচার করে দেন? বুঝতে হবে, ৫ থেকে ১০ হাজার ধনীর সম্পদ বাড়লে দেশের লাভ নেই। তার চেয়ে শিক্ষিত বেকার মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি, যেটা বর্তমানে খুব বাজে অবস্থায় আছে।
তারা বলেন, যে দেশে দুর্নীতি কোথায় আছে না বলে, দুর্নীতি কোথায় হয় না বলতে হয়, যে দেশের রিজার্ভের টাকা চুরি হয়, ব্যাংক লুট হয়, শেয়ার মার্কেট দেউলিয়া হয়, সে দেশে এসব বিষয়ে ঠিকমতো পরিকল্পনা না থাকলে, রাষ্ট্রও দৈন্যদশাগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।
আরও বলেন, দেশ এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এখনো বাংলাদেশের বাজেটে আয় হিসেবে বিপুল অংকের বৈদেশিক ঋণের কথা উল্লেখ করতে হয়। তারপরও এখন থেকে যথাযথ প্রস্তুতি নিলে বাংলাদেশ তার সুফল নিতে পারবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৬
আপনার মতামত জানানঃ