ফেসবুক-টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের অনলাইন মাধ্যমগুলোতে মিথ্যার ছড়াছড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ করেন অনেকেই। আর এসব মিথ্যা, ভুল তথ্য ও গুজবের কারণে প্রতি পাঁচজনের একজন কিশোরী ও তরুণী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এসব মিথ্যা তথ্য তাদের চিন্তিত, আতঙ্কিত ও বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। শুধু তাই নয়, এর প্রভাব তাদের বাস্তব জীবনেও পড়ে। ফলে তারা ইতিবাচক নানা বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত এক বৈশ্বিক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, এ গবেষণায় বিশ্বের ২৬টি দেশের ২৬ হাজারের বেশি কন্যাশিশু, কিশোরী ও তরুণীর ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশসহ ১৮টি দেশের কয়েক শ কন্যাশিশু, কিশোরী ও তরুণীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, এই কিশোরী ও যুব নারীদের কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়াকে প্রভাবিত করে এই সকল মিথ্যা ও ভুল তথ্য এবং গুজব।
এই গবেষণা ফলাফল কিশোরী ও যুব নারীদের জীবনে ভুল ও মিথ্যা তথ্যের প্রভাবের বাস্তব পরিণতি তুলে ধরে— এমন মন্তব্য করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল শিশু এবং যুবদের জন্য প্রযুক্তিগত শিক্ষা নিশ্চিতে সকল দেশের সরকারদের প্রতি আহ্বান জানায়।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৫ শতাংশের মতে, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। এর পরেই আছে টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউব।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি তিনজনের একজন জানিয়েছে, মিথ্যা তথ্য তাদের চিন্তিত, আতঙ্কিত ও বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। অনলাইনে মতামত আদান-প্রদানের ফলে সমাজে যে উত্তেজনা তৈরি হয়, তাতে তারা নিজেদের অনিরাপদ মনে করে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক পরিচালিত বিশদ সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে পাওয়া তথ্যমতে, অনলাইনে মতামত আদানপ্রদানের ফলে কমিউনিটির মধ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সামাজিক উত্তেজনার কারণে তারা নিজেদের অনিরাপদ মনে করে।
অন্যান্যরা তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত বানোয়াট অনুষ্ঠান বা আয়োজন নিয়ে যা তাদের শারীরিক ঝুঁকির মুখে ফেলে। পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন অবিশ্বস্ত স্বাস্থ্য উপদেশ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৮ শতাংশই কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কোন মিথ্যা তথ্য বা কুসংস্কার বিশ্বাস করেছে। অপরদিকে প্রতি ৪ জনের ১ জন, অর্থাৎ ২৫% কোভিড-১৯ এর টিকা নেওয়া উচিত হবে কিনা সেই প্রশ্ন করেছে অনলাইন মাধ্যমে।
জরিপে অংশ নেওয়া কিশোরী ও তরুণীদের প্রতি পাঁচজনের একজন (১৯ শতাংশ) জানিয়েছে, অনলাইনে মিথ্যাচার এত বেশি যে তারা নির্বাচনের ফলাফলকে অবিশ্বাস করেছে। আর পাঁচজনের মধ্যে একজন (১৮ শতাংশ) এই মিথ্যাচারের কারণে রাজনীতি বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
জরিপের ফলাফলমতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের কিশোরী ও তরুণীদের অনলাইনে মিথ্যা তথ্যে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি এবং উচ্চ আয়ের দেশের মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণসংখ্যক মেয়ে কোভিড-১৯–এর টিকা গ্রহণ করবেন কি না, সেই প্রশ্ন করেছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৫ শতাংশের মতে, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। এর পরেই আছে টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউব।
অনলাইনে ভুল তথ্য ও অসত্য তথ্যের লিঙ্গভিত্তিক প্রভাব পরীক্ষা করার জন্য এই প্রথম বৃহৎ পরিসরে বিশ্বব্যাপী এ গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৯ কিশোরী ও তরুণী (৮৭ শতাংশ) মনে করে, এটি তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিশ্বব্যাপী জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই বিশ্বস্ত তথ্য পেতে বিশ্বাস করে, এমন কোনো অনলাইন উৎস এ জরিপে পাওয়া যায়নি। অংশগ্রহণকারীদের ৪৮ শতাংশ নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবারের সদস্য ও সরকারের ঊর্ধ্বে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে বিশ্বাস করে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ওয়েলসের বাসিন্দা শারল্যেটের (২৩) মতে, ইন্টারনেটে মিথ্যা তথ্যের আধিক্য মানুষকে ‘খুব বিপদাপন্ন’ করে তুলতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, কখনো কখনো অনলাইন দুনিয়ায় জবাবদিহির অভাব থাকে। সে কারণে এখানে যে কেউ যা কিছু করতে পারে।’
কেনিয়ার নাগরিক ২০ বছর বয়সী মিয়া বলেন, ‘আমরা এমন এক দুনিয়ায় বাস করছি, যেখানে সবকিছু ইন্টারনেটের মাধ্যমে হচ্ছে। আমরা সবকিছু প্রযুক্তির মাধ্যমে করছি। তাই আমি মনে করি, প্রযুক্তিগত শিক্ষাও স্কুলের প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেওয়া উচিত, যাতে আমরা যখন বড় হয়ে উঠব, আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে বিষয়ে আরও পরিষ্কার ধারণা রাখব।’
বাংলাদেশের আঁচল (২১) বলেন, ‘যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকি আছে, সেগুলো আমি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলি। সেই অ্যাকাউন্টগুলো আনফলো করে দিই।’
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এর জেন্ডার ট্রান্সফরমেটিভ পলিসি’র নির্বাহী পরিচালক ভাগ্যশ্রী ডেংগলে জানান, “মেয়েদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণা, তারা কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিবে এবং তাদের চারপাশের জগতকে একটি আকৃতি দেয় ইন্টারনেট। আমাদের গবেষণায় এটি স্পষ্ট যে, অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ার বাস্তব জীবনের পরিণতি রয়েছে। এটি বিপজ্জনক, এটি মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এবং এটি তাদের জনজীবনে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখে।”
“প্রতিদিন, স্থান নির্বিশেষে, কিশোরী ও যুব নারীরা তাদের শরীর, তাদের পরিচয় এবং তাদের আচরণ নিয়ে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ও চিরাচরিত ধ্যানধারণা দ্বারা অনলাইনে জর্জরিত থাকে। তাদের পণ্যায়িত ও লজ্জিত করতে ছবি ও ভিডিও ম্যানুপুলেট করা হয়। শোষণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গুজব এবং মেয়েদের অন্যতম বাস্তব ভয় যে বানোয়াট অনুষ্ঠান এবং নকল প্রোফাইল তাদের প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে অফলাইনেও বিপদ ডেকে আনতে পারে।”
“মেয়ে আমি সমানে সমান” ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী মেয়েদের সাহায্য করছে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে যেন তারা শিশু ও যুবদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা নিশ্চিতে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তাদের মিথ্যা তথ্য চিহ্নিতকরণে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে, এবং অনলাইনে আত্মবিশ্বাসের সাথে বিচরণে যোগ্য করে তোলে।
ভাগ্যশ্রী আরো বলেন, “মেয়েদের নিরাপদ সিদ্ধান্ত নিতে এবং তাদের জীবনের উপর ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতে সত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন, মেয়েরা জানে না কী বিশ্বাস করতে হবে, কাকে বিশ্বাস করতে হবে এবং কোথায় সত্য খুঁজতে হবে।”
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমরা এমন একটি তথ্যনির্ভর পরিবেশে আছি, যা ক্ষোভ, বিদ্বেষ এবং বিভেদের কন্টেন্ট দিয়ে ভর্তি। এটি আপনার নাগরিক বিশ্বাসকে ক্ষয় করতে থাকে, একে অন্যের ওপর আস্থা নষ্ট করতে থাকে। আমাদের একে অন্যের যত্ন নেয়ার ক্ষমতা কমাতে থাকে।
তারা বলেন, ‘আপনার হাতে যখন এমন ব্যবস্থা থাকবে যা রাগ দিয়ে হ্যাক করা যায়, আর প্রকাশকরা যখন ভাবে যে, ওহ আমি যদি আরও বেশি আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষমূলক কন্টেন্ট দিই তাহলে বেশি টাকা কামাবো; তখন পুরো বিষয়টি অনলাইনের জন্যেও লাভজনক এবং প্রকাশকদের জন্যেও লাভজনক। অনলাইন এমন একটা প্রণোদনা ব্যবস্থা তৈরি করেছে যা মানুষকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।’
আরও বলেন, ফেসবুক বতর্মানে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নানা সামাজিক প্রতিবাদে সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনাতেই ইতিবাচক ভূমিকায় ব্যবহার করা হয়েছে। আবার অনেক সময়ই ফেসবুক ব্যবহার করে নানা ভুল তথ্য, ছবি ও গুজব ছড়ানো হয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকার আছে সবার। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। নৈতিকতা মেনেই করতে হয়। অনলাইনে মতপ্রকাশের সময় এই দায়িত্ববোধ রয়েছে। সুতরাং ফেসবুক ব্যবহারে এমন সতকর্তা ও দায়িত্বশীল হতে হবে, যাতে একটি পোস্ট বা মন্তব্য যেন আমাদের নৈতিকতা লঙ্ঘন না করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৭
আপনার মতামত জানানঃ