ইন্টারনেটে অবারিত নজরদারিতে আমাদের প্রায় কোনো তথ্যই আজ গোপন থাকছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক, অ্যাপস, ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন- ইন্টারনেট সংশ্নিষ্ট সব সেবাই আমাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখছে। জেনে অথবা অজান্তে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের ট্র্যাকিংয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছি।
ডিজিটাল পরিসরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে আছে। আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিদ্যমান হুমকি মোকাবিলা ও ইন্টারনেট স্বাধীনতা প্রসারের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ইন্টারনেট স্বাধীনতা উদ্যোগ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে।
আজ রোববার ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২১ উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ওয়ার্কিং গ্রুপের ঘোষণা করা হয়। আর্টিকেল নাইনটিনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, এই গ্রুপ দেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ধারণাকে উৎসাহিত ও অগ্রসর করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি নীতি ও আইনের সংস্কারের জন্য সুপারিশ প্রদানের মাধ্যমে কাজ করবে। এ জন্য ওয়ার্কিং গ্রুপ বিদ্যমান জাতীয় আইনি কাঠামোর বিশ্লেষণ, কৌশলগত অ্যাডভোকেসি এবং ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করবে।
আর্টিকেল নাইনটিন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ও ওয়ার্কিং গ্রুপের অন্যতম সদস্য ফারুখ ফয়সল বলেন, ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্বিক লক্ষ্য হলো নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে দেশে অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রসার এবং তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করা। গ্রুপটি ইন্টারনেট স্বাধীনতার প্রসারে কাজ করে এমন নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রাসঙ্গিক নীতি প্রণয়নে সরকারকে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া ডিজিটাল অধিকার বাস্তবায়নে সহায়ক আইনি ও নীতিকাঠামোর প্রতি সমর্থন এবং অনলাইন স্বাধীনতার প্রতি হুমকির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখবে।
সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক সভা ও ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে গ্রুপটি গঠন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, প্রযুক্তিবিদ, সাইবার বিশেষজ্ঞ, ডিজিটাল অধিকারকর্মী, শিক্ষার্থী, জেন্ডার অ্যাকটিভিস্ট এবং যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধি যুক্ত ছিলেন।
নবগঠিত এই ওয়ার্কিং গ্রুপের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ ডিজিটাল পরিসরে ইন্টারনেটভিত্তিক নাগরিক পরিষেবার বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এটি বহু মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। অথচ একই সময়ে সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার যেমন—মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্য জানার অধিকার এবং ডিজিটাল পরিসরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে আছে।
ডিজিটাল পরিসরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে আছে। আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিদ্যমান হুমকি মোকাবিলা ও ইন্টারনেট স্বাধীনতা প্রসারের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ইন্টারনেট স্বাধীনতা উদ্যোগ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে।
বিশেষ করে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা ১৬তে, টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার প্রচলন, সবার জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা এবং সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকার করেছে। তবে ওয়ার্কিং গ্রুপ মনে করে, বিদ্যমান আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় নাগরিক অধিকার সীমিত করার বিস্তৃত সুযোগ রয়েছে এবং এই কাঠামো এসডিজি অর্জনে সরকারের যে অঙ্গীকার, সেটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এটা স্পষ্ট যে, বিদ্যমান আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেশে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। এই ব্যবস্থায় অনলাইনে নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার সুরক্ষাও কঠিন।
এই প্রেক্ষাপটে এই ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ রূপান্তর করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। একই সঙ্গে ওয়ার্কিং গ্রুপ সরকারকে নাগরিকদের চাহিদা পূরণের জন্য একটি ব্যাপক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক জাতীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানায়, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। যেখানে ইন্টারনেট হবে নাগরিকদের জন্য ভয়ভীতিহীন মত প্রকাশের একটি উন্মুক্ত ফোরাম।
এদিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি), মেশিন লার্নিং, বিগ ডাটার মতো প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বজুড়ে কাজ হচ্ছে। আগামীতে আমাদের বাসাবাড়ি, স্কুল ও কর্মক্ষেত্র- ইন্টারনেট ডিভাইসের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে। জীবনযাত্রা হয়ে উঠবে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রিত। ঘরের দরজা, ফ্যান, এসি কিংবা ফ্রিজ ইন্টারনেটে যুক্ত থাকবে। দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এসব ডিভাইস। এতে যুক্ত হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর এসব প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে ব্যক্তিগত তথ্য হয়ে উঠবে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে সাইবার অপরাধীরা এখন যেমন কম্পিউটার হ্যাক করে তেমনি এসব ডিভাইস হ্যাক করে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারবে। ফলে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আর ডিজিটাল জীবনযাত্রায় নিরাপদ থাকতে এই ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা কতটা জরুরি সেটা নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটে অবারিত নজরদারিতে আমাদের প্রায় কোনো তথ্যই আজ গোপন থাকছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক, অ্যাপস, ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন আমাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখছে। জেনে অথবা অজান্তেই আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের নজরদারিতে থাকতে একরকম বাধ্য হচ্ছি। ফলে দেখা যাচ্ছে, আপনি গুগলে কোনো খাবার হোটেল কিংবা ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য সার্চ করেছেন। এরপর ফেসবুক ঢোকার পরেই দেখলেন, ফেসবুক ওই সংশ্নিষ্ট পণ্যের বিজ্ঞাপন আপনার ওয়ালে প্রদর্শন করতে শুরু করেছে! বিষয়টি কতটা ভয়ংকর দেখেন, চান বা না চান; গুগলে আপনি কী করেছেন তা জেনে নিচ্ছে ফেসবুক! ব্যবসা নিয়ে গুগল ফেসবুকের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও আপনাকে দিয়ে ব্যবসার অর্থ ভাগাভাগিতে কতটা উদার তারা! এভাবেই অনলাইনে প্রতিনিয়ত আমাদের সকল গোপনীয়তা সকল ডাটা শেয়ার হচ্ছে। কে কখন কীভাবে আমার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করছে তার হদিসও হয়ত আমরা জানি না। এরই প্রেক্ষাপটে কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ভালোভাবে নিরাপদে রাখা যায়, তা জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।
তারা জানান, মোবাইল ফোনে অ্যাপস ডাউনলোডের সময় ৯৯ শতাংশ ব্যহারকারী তার সব তথ্যে প্রবেশাধিকারের অনুমোদন দিয়ে দেন। এসব তথ্য অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ব্যবহার করছে কিংবা চড়া দামে বিক্রি করছে সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ ভোক্তা বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো (ব্র্যান্ড) তাদের দেওয়া ব্যক্তিগত তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে কি-না তা নিয়ে তারা আস্থা রাখতে পারছেন না।
তারা বলেন, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। উন্নত বিশ্বে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। বাংলাদেশেও মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মতো চরম নৈতিক অপরাধকে প্রতিহত করার জন্য আইনি ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কেউ ইচ্ছা করলেই যাতে আরেক নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে না পারে সেজন্যই শক্ত আইন থাকা উচিত। আইন ব্যক্তির পক্ষে তার অধিকার সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে আইন মেনে চলার জন্য জনসচেতনতাও প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রচার ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কীভাবে বজায় থাকবে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৮
আপনার মতামত জানানঃ