উত্তরপ্রদেশে বিক্ষোভরত কৃষকদের ওপরে গাড়ি চালিয়ে দেওয়ার ভয়ংকর অভিযোগ উঠল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রর ছেলের বিরুদ্ধে। রোববার উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খিরি এলাকায় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন কৃষকরা। এ সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রর ছেলে আশিসের গাড়ির ধাক্কায় চারজন কৃষক নিহত হন। এরপর একটি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। অন্য গাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়। এতে আরও চারজন নিহত হন।
এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রর ছেলে আশিস মিশ্র ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আশিস বিরুদ্ধে তিকোনিয়া থানায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (খুন), ১২০ বি ধারা (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) এবং ১৪৭ ধারায় (হিংসা) মামলা রুজু করেছে পুলিশ। এতে নাম রয়েছে তার কয়েকজন সহযোগীর।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রবিবার সকাল থেকেই উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা কেন্দ্রের ৩ বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। কৃষকরা যেখানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন সেই এলাকার ওপর দিয়েই এদিন এক অনুষ্ঠানে রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রর আসার কথা ছিল। কৃষকদের দাবি, তারা আসলে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র ও উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্যের কনভয়ের একটি গাড়িতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রর ছেলে আশিস মিশ্র তার বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়দের নিয়ে ছিলেন। কিন্তু মাঝপথে কৃষকদের বিক্ষোভের জেরে মন্ত্রীদের কনভয় আটকে যায়। এরপরই কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অজয় মিশ্রর ছেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু হয় বিক্ষোভকারীদের।
অভিযোগ, বচসার মাঝে তিনি আচমকা বিক্ষোভে অবস্থানকারী কৃষকদের ওপর গাড়ি চালিয়ে দেন। এতে ৪ জন কৃষকের ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয়েছে। গাড়ির ধাক্কায় কৃষকদের ছিটকে পড়ার পরই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা মন্ত্রীপুত্রের গাড়ি-সহ তিনটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন। গোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এ ঘটনায় লখিমপুরে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন কৃষক নেতারা। সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে ছিলেন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব দেবেশ চতুর্বেদী।
কৃষকদের দাবি, প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রকে পদত্যাগ করতে হবে। অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে অজয়ের ছেলে ও সহযোগীদের। নিহত চার কৃষকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেইসঙ্গে পরিবারের এক সদস্যকে দিতে হবে সরকারি চাকরি।
এ বিষয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, সেই ঘটনায় চার কৃষকসহ আটজন নিহত হয়েছেন। চারজন ওই গাড়িতে ছিলেন। লখিমপুর খিরির জেলা সদর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে তিকোনিয়া নামের যে জায়গায় সেই ঘটনা ঘটেছে, সেখানে সহিংসতার আশঙ্কায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পাঠানো হয়েছে তিন কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনী। জেলায় আংশিকভাবে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা।
কৃষক ইউনিয়নের এক নেতা ড. দর্শন পাল বলেন, ‘মন্ত্রীদের আগমন ঠেকাতে কৃষকেরা হেলিপ্যাড ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা করে। তা শেষ হয়ে গেলে বেশিরভাগ মানুষই ফিরতে শুরু করে। তখনই তিনটে গাড়ি আসে আর কৃষকদের উপর চালিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে রোববারের এই ঘটনার সঙ্গে নিজের ছেলের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় কুমার মিশ্র। তিনি জানিয়েছেন, তার ছেলে ঘটনাস্থলে ছিল না।
এএনআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অজয় মিশ্র দাবি করেছেন, ‘আমার ছেলে ঘটনাস্থলে ছিল না। দুষ্কৃতিকারীরা লাঠি নিয়ে আক্রমণ করেছে। আমার ছেলে সেখানে থাকলে, জীবিত ফিরে আসতে পারতো না।’
কৃষক মোর্চার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোববার নিহত চার কৃষকদের বয়স যথাক্রমে ৬০, ৩৫, ১৯ ও ২০ বছর।
কৃষক ইউনিয়নের নেতারা জানিয়েছেন, গাড়ির আঘাতে চার কৃষকের মৃত্যু হয়েছে এবং আরও ছয় জন আহত হয়েছেন। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতা তেজিন্দর এস ভিরাক মারাত্মত আহত হয়েছেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন সমাজবাদী পার্টির সুপ্রিমো অখিলেশ যাদব। টুইটারে পোস্ট করে তিনি লেখেন, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিরোধিতা করছিলেন কৃষকরা। তখনই বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছেলে গাড়ি দিয়ে তাদের পিষে দিয়ে এক অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাণ্ড ঘটান। উত্তরপ্রদেশ আর বিজেপির এই অত্যাচার সহ্য করবে না। এইভাবে চলতে থাকলে বিজেপি আর গাড়ি চড়তে পারবে না, নামতেও পারবে না।
উল্লেখ্য, প্রায় এক বছর ধরে কৃষক আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে দিল্লি। তার রেশ এসে পড়েছে উত্তরপ্রদেশেও। সম্প্রতি কৃষকদের ডাকা দেশব্যাপী ধর্মঘটে সাড়া পড়েছে যোগী রাজ্যে। জাঠ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষকরা হাতে হাত মিলিয়ে আন্দোলন করছেন। যা দেখে ভীত বিজেপি। তবে বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর ছেলে এভাবে গাড়ি চালিয়ে কৃষক হত্যা করবেন, তা কেউ ভাবতেও পারেননি। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সবাই। এই ঘটনার পর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘটনাস্থলে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের পাঠিয়েছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সামনের বছরের গোড়াতেই এই রাজ্যে নির্বাচন। এই ঘটনার বড় প্রভাব নির্বাচনে পড়বে বলে মনে করছেন দেশটির রাজনীতিক বিশ্লেষকরা। ঘটনার নিন্দায় সরব হয়েছে গোটা দেশ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৬
আপনার মতামত জানানঃ