ভারতের কৃষক আন্দোলন সাম্প্রতিককালে আন্দোলনগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, দীর্ঘদিনব্যপী এবং আন্তর্জাতিক মহলে বহুল চর্চিত একটি আন্দোলন। সাত মাস ধরে দেশটির রাজধানীর বুকে চলে আসছে এই আন্দোলন। কয়েকমাস চুপচাপ থাকার পর ভারতে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে কৃষক আন্দোলন। সোমবার ভারতের দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় ভোর ৬ টা থেকে বেলা ৪ টা— ১০ ঘণ্টার ‘ভারত বনধ’ কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনরত কৃষকরা। এই কর্মসূচিতে দিল্লি-মিরুত মহাসড়কের প্রবেশপথ আটকে দিলে দিল্লি সীমান্তে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানাচ্ছে, এই ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিচ্ছে ৪০টি খামারি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত কিষাণ মোর্চা।
এনডিটিভি অনলাইন, হিন্দুস্তান টাইমসসহ ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, কৃষকদের আন্দোলন কর্মসূচির কারণে এই তিন প্রদেশে সোমবার ট্রেনের সব সূচি বাতিল করা হয়েছে। আন্দোলনরত কৃষকদের একটি অংশ চার রাজ্যের ট্রেন লাইনগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন। অপর অংশ অবস্থান নিয়েছেন তিন প্রদেশের সংযোগকারী সড়গুলোতে। সড়ক অবস্থানের পাশাপাশি টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করছেন তারা। ফলে, সোমবার সকাল থেকে সংযোগকারী সড়কগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট।
আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, জাতীয় মহাসড়কের কিছু অংশে তারা যান চলাচল করতে দেবেন না। এ অবস্থায় দিল্লি সড়ক অচল হয়ে পড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
এনডিটিভি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশের গাজিপুর জেলায় দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সংযোগকারী সড়ক দিল্লি-মিরুত এক্সপ্রেস ওয়েতে অবস্থান নিয়েছেন নিয়েছেন কৃষকরা। এছাড়া দিল্লির প্রধান দুই জেলাশহর গুরগাঁও ও নয়ডার মূল সড়কেও তাদের অবরোধ চলার কারণে বাইরে থেকে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারছে না দিল্লিতে।
দিল্লি ও দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সংযোগকারী সড়কের পাশাপাশি কৃষক অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা প্রদেশের সংযোগকারী সড়কেও। দুই প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা শম্ভুতে অবস্থান নিয়েছেন তারা।
দেশজুড়ে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, দোকান, শিল্প কারখানা এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধের ডাক দেয় সংগঠনটি। এই ‘বনধ’কে সমর্থন করেছে বাম, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আম আদমি পার্টি, টিডিপি-র মতো বিরোধী দলগুলো। ধর্মঘটে প্রভাব পড়েছে কলকাতাতেও।
কৃষক নেতা শরণ সিং বলেছেন, দিল্লির সীমানায় কৃষক নেতারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সরকার তাদের কথা শুনছে না। তাই তারা ভারত বনধ ডাকতে বাধ্য হয়েছেন। কর্মসূচি বিকাল ৪টা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
আন্দোলনকারীরা বিজেপি সরকারের করা ৩টি আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। কৃষকদের আশঙ্কা, এই আইনের ফলে ন্যূনতম মূল্য সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে তারা বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হবেন। সরকার এখনও সরে না আসলেও কৃষকরা আইন বাতিলের দাবিতে অনড়।
রোববার ‘ভারত বনধ’ কর্মসূচির ডাক দেয় ভারতের ৪০ টি কৃষক সংগঠনের ঐক্যমঞ্চ সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম)। মোর্চার অন্যতম নেতা রাকেশ টিকায়েত রোববার এক বার্তায় বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী আমাদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু তার এই আহ্বান যে লোক দেখানো— তা আমরা জানি।’
‘আমাদের দাবি পরিষ্কার। অবিলম্বে কৃষি বিষয়ক যাবতীয় কালো আইন বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে আমরা আরও ১০ বছর আন্দোলন করব।’
অবরোধের ফলে দিল্লি-পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের বেশ কিছু এলাকায় যান চলাচল স্থবির হয়ে আছে। সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট সব বন্ধ আছে সেসব এলাকায়। তবে চিকিৎসা ও জরুরি সেবাকে অবরোধের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে।
পাঞ্জাবের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এবং উত্তরপ্রদেশের বিরোধী দল বহুজন সমাজ পার্টি ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-মার্ক্সবাদী (সিপিএম) সোমবারের ‘ভারত বনধ’ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছেন। কর্মসূচিকে সাফল্যের জন্য কৃষকদের সহযোগিতা করতে কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছেন এই তিন দলের নেতৃবৃন্দ।
আন্দোলনের শুরুর দিকে কয়েক দফা আলোচনা করলেও বর্তমানে একে পাত্তাই দিচ্ছে না ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। কিছুটা বদল করা হলেও কৃষি আইন যে প্রত্যাহার করা হবে না তা সাফ জানিয়ে দিয়েছে মোদি-শাহের সরকার। আর চাষিরাও নিজেদের দাবিতে অনড়।
২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দেশের কৃষি ব্যবস্থার সংস্কারে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় তিনটি বিল উত্থাপন করেন ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার।
বিলগুলোতে কৃষিপণ্যের মজুতদারীর ওপর সীমা তুলে নেওয়া, কোম্পানি ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক চাষ এবং উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস—এমএসপি) তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ওই বিল তিনটি আইনে পরিণত হয়। নভেম্বর থেকে এই আইনগুলো বাতিলের দাবিতে দিল্লির সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কয়েক লাখ কৃষক।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদিও বলেছেন, দেশের বিস্তৃত ও মান্ধাতা আমলের কৃষি ব্যাবস্থাকে ঢেলে সাজানো ও আধুনিকায়নই নতুন তিন কৃষি আইনের উদ্দেশ্য, কিন্তু তার এই বক্তব্যে আস্থা রাখতে পারছেন না কৃষকরা।
তারা বলছেন, ওই তিন আইনের ফলে বেসরকারি নানা বড় বড় কোম্পানি কৃষিখাতে হর্তাকর্তা হয়ে যাবে এবং দরিদ্র কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বেন।
দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন শুরুর পর থেকে মোর্চার নেতাদের সঙ্গে এ পর্যন্ত এগারো দফা বৈঠক হয়েছে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের। কিন্তু মোর্চার নেতারা আইন বাতিলের দাবিতে অটল থাকায় এবং কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবির বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান নেওয়ায় এখন পর্যন্ত এই সংকটের কোনও সমাধান হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, আন্দোলনের শুরুর দিকে কয়েক দফা আলোচনা করলেও বর্তমানে একে পাত্তাই দিচ্ছে না ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। কিছুটা বদল করা হলেও কৃষি আইন যে প্রত্যাহার করা হবে না তা সাফ জানিয়ে দিয়েছে মোদি-শাহের সরকার। আর চাষিরাও নিজেদের দাবিতে অনড়।
করোনাকালে ভারত বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে চলে গেলে দিল্লিতে একটানা বিক্ষোভে রাশ টেনেছিলেন কৃষকরা। কৃষকদের একাধিক সংগঠনের তরফে আপাতত বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। দেশজুড়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পরেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দিল্লির সীমানা ঘেরাও করে রাখা কৃষকদের অনেকেই করোনায় সংক্রমিত হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি করোনা আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন কৃষকের মৃত্যুও হয়েছিল। পরিস্থিতির বিচার করেই সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা-সহ কৃষকদের সংগঠনগুলি আপাতত আন্দোলন স্থগিত রেখে কৃষকদের নিজ-নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তবে দাবি থেকে একচুলও সরে আসতে রাজি নন কৃষকরা। কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে অনড় কৃষক-সমাজের একটি বড় অংশ। সেই লক্ষ্যেই এবার নয়া কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার তরফে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ