প্রশাসনের প্রতিরোধের মুখে পড়লেও তাদের আন্দোলন যে থামবে না, সে কথা আরও একবার স্পষ্ট করে দিলেন ভারতের প্রতিবাদী কৃষকেরা। বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো হাজার হাজার কৃষক তাদের দাবি আদায়ে দিল্লির দিকে মিছিল অব্যাহত রেখেছেন।
তবে, সেই অভিযান সে সহজ হবে না, সে কথা মঙ্গলবারই স্পষ্ট করে দিয়েছিল প্রশাসন। বুধবারও নিরাপত্তার কড়া বলয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল হরিয়ানার শাম্ভু, টিকরি ও সিঙ্ঘু সীমান্ত-সহ রাজধানী দিল্লি ঢোকার অন্যান্য প্রবেশপথ।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা, কৃষি ঋণ মওকুফ এবং স্বামীনাথন কমিশনের সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন-সহ একাধিক দাবি নিয়ে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ থেকে কয়েক হাজার কৃষক ‘দিল্লি চল’ আন্দোলনের যে ডাক দিয়েছিলেন, আজ তার দ্বিতীয়দিন।
মঙ্গলবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্রতিবাদীদের ছত্রভঙ্গ করতে ব্যবহার করা হয় জল কামান। ড্রোনের মাধ্যমে ফেলা হয় কাঁদানে গ্যাসের সেলও। রাবার বুলেট ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে তাক করে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগ উঠেছে।
বুধবার প্রশাসনের প্রতিরোধের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ছিলেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘কড়া দমননীতির’ মোকাবিলা করতে তারা প্রস্তুত।
“আমরা এখানে সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে আসিনি। আমাদের দাবি দাওয়ার কথা বলতে এসেছি। আমাদের বিরুদ্ধে একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে আমরা প্রো-খালিস্তানি, বাম ঘেঁষা আর পাঞ্জাব সরকারের দিকে। কিন্তু এর একটিও ঠিক নয়,” বলেছেন কিষাণ মজদুর মোর্চার নেতা সরওয়ান সিং পান্ধের।
অন্যদিকে, সরকার যে আলাপ আলোচনা করতে প্রস্তুত সে কথা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা।
“কৃষক সংগঠনগুলির কাছে আমাদের অনুরোধ, সাধারণ মানুষের জীবন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আলোচনার জন্য একটা সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ যেন থাকে,” বলেছেন তিনি।
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ
শাম্ভু, খানৌরি, টিকরি ও সিঙ্ঘু সীমান্তে বুধবার সকাল থেকেই জড়ো হতে থাকেন কৃষকেরা। সীমান্তে প্রশাসনের তরফে তাদের উদ্দেশ্যে দফায় দফায় মাইকে ঘোষণা করা হয়। যদিও আন্দোলনকারী রা স্পষ্ট করে দেন, তারা পিছু হটবেন না।
মঙ্গলবার গোটা দিন পুলিশ ও আধা সেনা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর সন্ধ্যেবেলায় ‘বিরতি’ ঘোষণা করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। তারা জানিয়েছিলেন, বুধবার সকালে আবার দিল্লির উদ্দেশ্যে অভিযান চালাবেন।
পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সকাল থেকেই সিঙ্ঘু সীমান্তে সকাল থেকেই বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। নামানো হয়েছে র্যা ফ, বিশাল পুলিশ বাহিনী এবং রাখা হয়েছে রায়ট কন্ট্রোল ভেহিকল। গাজিপুর সীমান্তে বহুস্তরীয় ব্যারিকেড তৈরি করেছে পুলিশ।
আম্বালার শাম্ভু সীমান্তে প্রতিবাদী কৃষকরা পুলিশ ও আধাসেনা বাহিনীর সতর্কবার্তা উপেক্ষা করলে, এদিনও তাদের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া হয় কাঁদানে গ্যাসের সেল। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, তারা ‘দিল্লি চল’ অভিযান শুরু করতেই তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের সেল ছোঁড়া হয়।
তবে তাদের রোখা যে সহজ হবে না, সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রতিবাদীরা। আন্দোলনরত কৃষকদের মধ্যে একজন বলেন, “আমরা কিছুতেই পিছু হটব না। যে ভাবে হোক এগিয়ে যাব।”
মঙ্গলবারও একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। সেদিন দফায় দফায় কাঁদানে গ্যাস ও জল কামান ব্যবসার করে পুলিশ।
“আমাদের তাক করে কাঁদানে গ্যাসের সেল ছুড়ছিল। বিষাক্ত গ্যাসে চোখ-মুখ জ্বালা করছিল। শ্বাসকষ্ট হয়েছে। বয়স্করাও রেহাই পাননি,” সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন এক আন্দোলনকারী এক কৃষক।
তবে বুধবার এই প্রতিরোধ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন আন্দোলনকারীরা। শাম্ভু সীমান্তে জড়ো হওয়া আন্দোলনকারীরা কাঁদানে গ্যাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে ‘দিল্লি চল’ অভিযান শুরু করার আগেই, মুখ-চোখ জলে ভিজিয়ে নিচ্ছিলেন, যাতে গ্যাসের প্রকোপে কিছুটা কম হয়।
আন্দোলনকারীদের কেউ মাথায় হেলমেট দিয়ে ঢেকে নিচ্ছিলেন, কেউ বা নিজেদের সুরক্ষার জন্য অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছিলেন।
সংগঠনের নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্য দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নিজেদের দাবি দাওয়ার কথা তুলে ধরা। রাজধানী যাওয়ার পথে যদি তাদের বাঁধা দেওয়া হয়, তাহলে, তারা শাম্ভু সীমান্তেই তাঁবু গেঁড়ে আন্দোলন চালাবেন, তবে পিছু হটবেন না।
প্রতিবাদীদের মধ্যে প্রবীণ নারীদেরও দেখা গিয়েছে। তাদের একজন সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশ্যে বলেন, “আন্দোলন চালিয়ে যেতে আমরা প্রস্তুত। এত সহজে আমরা দমে যাব না।”
ইতিমধ্যে কৃষকদের দাবি মেনে না নেওয়া হলে ১৬ই ফেব্রুয়ারি কৃষকদের ‘ভারত বন্ধের’ ডাক দেওয়া হয়েছে। দিল্লির পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ আগেই ঘোষণা করেছিল কৃষকেরা সীমানা পার করে আসার চেষ্টা করলে তাদের বাধা দেওয়া হবে। দিল্লির পরিস্থিতি যাতে ঠিক থাকে সেটা নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা।
হরিয়ানার অম্বালা, কুরুক্ষেত্র, কাইথাল, জিন্দ, হিসার, ফতেবাদ এবং সিরসা জেলার ইন্টারনেট পরিষেবা ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
দিল্লির টিকরি সীমানার দিকে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে যানবাহন চলাচল।
তবে প্রতিবাদের প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। দিল্লি-সোনিপত লাগোয়া সিঙ্ঘু এবং দিল্লি-বাহাদুরগড় লাগোয়া টিকরি সীমানায় যানবাহন চলাচল অবরুদ্ধ। বহু মানুষ রাস্তাতেই আটক পড়েছেন।
কী নিয়ে আন্দোলন?
এর আগে, মোদী সরকারের তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ২০২০ সালে সিঙ্ঘু, গাজিপুর এবং টিকরি সীমানায় এক বছরেরও বেশি সময় আন্দোলন করেছিল কৃষকেরা। চাপের মুখে সেই আইন প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। সে সময় আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপির আইনি গ্যারান্টির দাবিটি খতিয়ে দেখবে সরকার।
যদিও তা হয়নি। সেই দাবিতেই আবারও ‘দিল্লি চল’ অভিযানের ডাক দিয়েছে কৃষক সংগঠনগুলি। একই সঙ্গে আগেরবার আন্দোলনের সময় যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল তা তুলে নেওয়ার দাবিও জানিয়েছে তারা।
গতবার কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ কিষাণ মোর্চা এইবার আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলেও এইবারের প্রতিবাদীদের সমর্থন জানিয়েছে তারা।
মঙ্গলবার আন্দোলন শুরুর আগে, সোমবার রাতে কৃষক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন খাদ্য ও ক্রেতা বিষয়ক মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল, কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই চণ্ডীগড়ের। সেই বৈঠকে সন্তুষ্ট হননি কৃষক নেতারা।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বক্তব্য, আগের দাবি দাওয়ার সঙ্গে নতুন দাবি যোগ করেছে কৃষক সংগঠন। যা এ ভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
আপনার মতামত জানানঃ