ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০২০ সালে। কিন্তু দেশটির ২০২১ সালের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি দিন অন্তত ১৫ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। কৃষি ক্ষেত্রে আত্মহত্যার সংখ্যার সঙ্গেই পাল্লা দিচ্ছে আত্মঘাতী ক্ষেতমজুরের সংখ্যাও। ২০২১ সালের প্রতি দিন ভারতে গড়ে আত্মঘাতী হয়েছেন ১৫ জন ক্ষেতমজুর।
দেশটির অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’-র অপরাধের বার্ষিক পরিসংখ্যান সংক্রান্ত রিপোর্টেই রয়েছে কৃষক এবং ক্ষেতমজুরদের আত্মহত্যার ওই পরিসংখ্যান। যা এর আগের বছরে দেশের মোট আত্মহত্যার পরিসংখ্যানের ৭ শতাংশেরও বেশি।
প্রকাশিত ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে ১০ হাজার ৮৮১ জন কৃষক ও ক্ষেতমজুর আত্মঘাতী হয়েছেন। অর্থাৎ, কৃষি ক্ষেত্রে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বছরে মোট আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ৫ হাজার ৩১৮ জন। আত্মঘাতী ক্ষেতমজুরের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৬৩ জন। ২০১৭ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে দেশটির কৃষিক্ষেত্রে আত্মহত্যার এটি নতুন রেকর্ড।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ঋণের চাপ, পেশার অনিশ্চয়তা, মানসিক অবসাদের কারণেই কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন দেশটির অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীদের একাংশ। বিরোধীদের অভিযোগ, মোদি সরকারের ভ্রান্ত অর্থনীতির কারণে রোজগার হারাচ্ছেন কৃষিক্ষেত্রে জড়িতরা। ফলে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা।
রিপোর্ট বলছে, কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত এমন মোট ১০ হাজার ৮৮১ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন ২০২১ সালে। এদের মধ্যে ৫৩১৮ জন কৃষক এবং ৫৫৬৩ জন কৃষিশ্রমিক। এদের মধ্যে ২১১ জন নারীও আছেন। দেশে মোট আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৩ জন।
গবেষণা বলছে, এই যে ৫৩১৮ জন কৃষক ২০২১ সালে আত্মহত্যা করেছেন, তাদের মধ্যে ৪৮০৬ জনের নিজস্ব জমি ছিল। ৫১২ জন চাষ করতেন লিজ নেয়া জমিতে বা অন্য কারও জমিতে। ফলে নিজের জমি থাকা কৃষকেরাই যে বেশি বিপদে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হিসেব করলে এই সংখ্যাাটা দাঁড়ায় প্রায় ৫৩ হাজারে। কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত এতগুলো মানুষ আত্মহত্যা করেছেন এই চার বছরে। ২০২১ সালে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ।
মোট ১০ হাজার ৮৮১ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন ২০২১ সালে। এদের মধ্যে ৫৩১৮ জন কৃষক এবং ৫৫৬৩ জন কৃষিশ্রমিক। এদের মধ্যে ২১১ জন নারীও আছেন। দেশে মোট আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৩ জন।
গত বছরের এই বড় সংখ্যার আত্মহত্যার বেশিরভাগাই ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। চার হাজারেরও বেশি কৃষি-আত্মহত্যা হয়েছে সেখানে, যার মধ্যে ২৬৪০ জন ছিলেন কৃষক, যারা নিজের জমিতে চাষ করতেন।
মহারাষ্ট্রের পরেই আসে কর্নাকের নাম, যেখান থেকে ২১৬৯টি আত্মহত্যার পরিসংখ্যান মিলেছে। এর পরেই রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ু। গোটা দেশের মধ্যে ৮০ শতাংশ কৃষি আত্মহত্যাই এই ক’টি রাজ্য থেকে হয়েছে।
মহারাষ্ট্রের চিত্র এই বছরও শোচনীয়। দু’দিন আগেই জানা যায়, তিনদিনে অন্তত ৯জন কৃষকের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে।
সূত্রের খবর, গত মাসে অতিবৃষ্টির জেরে শস্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর তার জেরেই অবসাদে, হতাশায় ডুবে যান কৃষকরা। সেই ২০০০ সাল থেকে বিদর্ভ জন আন্দোলন সমিতি কৃষকদের আত্মহত্যা বিষয়টি সামনে আনছে বারবার।
তাদের দাবি, ১২ জন কৃষক এই মাসেও আত্মহত্যা করেছেন। চলতি বছরে জানুয়ারি মাস থেকে ধরলে, এই সংখ্যা পৌঁছেছে ৫১২তে।
জুলাই মাস থেকে অতিবৃষ্টির জেরে ফসল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর পরেও কৃষকরা ক্ষতিপূরণের জন্য অতিরিক্ত শস্যবীজ পাননি বলে অভিযোগ। এদিকে ব্যাংক ও পাওনাদাররা তাদের ছাড়েনি।
অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ত্রিপুরা, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, চণ্ডীগড় এই সমস্ত কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলিতে কিন্তু আত্মহত্যার সংখ্যা শূন্য, বলছে এনসিআরবি-র তথ্য।
কৃষির আধুনিকায়নে ভারত সরকারের পদক্ষেপের শ্লথগতির জন্য কৃষকদের মনঃকষ্ট দূর হচ্ছে না। ভারতে ঝরছে অসংখ্য কৃষকের প্রাণ। তাদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ ঋণের বোঝা। কয়েক দশক ধরে চলমান ঋণের বোঝা মেটাতে পেরে না উঠে কৃষকরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতে কৃষকদের আত্মহত্যার কারণ ঋণসুরক্ষার প্রশ্নে নীতি ও পরিকল্পনার অভাব। এটিই কৃষকদের মানসিকভাবে পীড়া দিচ্ছে এবং আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিচ্ছে।
তারা বলেন, ‘এটা টেকসই কৃষির অভাব ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, যার ফলে কৃষকরা সবসময় ঋণের আওতায় থাকছেন।’
তারা আরও বলেন, ‘যখন আয় কমে যাওয়া ও ফসলহানির মতো বিষয়গুলো একসঙ্গে ঘটে তখন পুরো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কৃষকের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। ঋণদাতাদের অর্থ ফেরতের জন্য অব্যাহত চাপের পাশাপাশি অনেক সময় তাদের হাতে কৃষককে অপমান হতে হয়। এমনকি সম্পদ কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। এসব কারণে ভারতে কৃষকরা প্রায়ই আত্মহত্যা করেন।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৬
আপনার মতামত জানানঃ