ট্রেন ভ্রমণের প্রতি মানুষের আগ্রহের কমতি না থাকলেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ও ভয়ংকর ঘটনা যাত্রীদের মনে মারাত্মক ভীতির সঞ্চার করছে। বিভিন্ন স্থানে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শুধু পাথরই নয়, এর পাশাপাশি কেউ কেউ ময়লা-আবর্জনাও নিক্ষেপ করছে। পাথরের আঘাতে ট্রেনের চালক, সহকারী চালকসহ যাত্রীদের অনেকেই গুরুতর আহত হচ্ছেন।
গতকাল শুক্রবারও ঢাকা থেকে সিলেটগামী আন্তনগর উপবন এক্সপ্রেস নামের ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। এতে নরসিংদীর দুজনসহ ট্রেনটির অন্তত চার যাত্রী আহত হয়েছেন।
নরসিংদীর আহত দুজন হলেন সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের টাওয়াদী এলাকার দেলোয়ার মিয়ার ছেলে কবির মিয়া (৩৮) ও করিমপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের হাসান আলীর ছেলে শুক্কুর আলী (৩২)। এ ঘটনায় আহত অন্য দুজনের পরিচয় জানা না গেলেও তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় বলে ট্রেনটির যাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেছে।
জানা যায়, উপবন এক্সপ্রেস ঢাকার কমলাপুর থেকে শুক্রবার রাত ৮টা ৩০ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ট্রেনটি পৌনে ১০টার দিকে গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশনে পৌঁছায়। ট্রেনটি স্টেশনে প্রবেশ করার আগমুহূর্তে মাঝখানের একটি বগিতে পরপর বেশ কিছু ঢিল ছোঁড়া হয়। দুর্বৃত্তরা ঢিল হিসেবে স্লিপারে থাকা পাথর ব্যবহার করে। এতে বগিটির ভেতরে অবস্থান করা চার যাত্রী আহত হন।
পাথর নিক্ষেপে নরসিংদীর দুই যাত্রী কবির মিয়া ও শুক্কুর আলীর চোখের নিচে গালের ওপরের অংশে জখম হয়েছে। প্রায় ৩০ মিনিট পর ট্রেনটি নরসিংদী স্টেশনে যাত্রাবিরতি দিলে আহত ব্যক্তিদের স্বজন ও স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় তাদের নরসিংদী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আহত বাকি দুজন ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেবেন বলে যাত্রীরা জানিয়েছেন।
চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ১৫ আগস্ট নীলফামারীর সৈয়দপুরে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার ঘটনায় পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। চলতি মাসে পাথর ছোঁড়ার অন্তত তিনটি পৃথক ঘটনায় আহত হয়েছেন তিনজন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এর ফলে যাত্রীরা আহত হচ্ছেন, অঙ্গহানি ঘটছে অনেকের। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে ভাটিয়ারী এলাকায় চলন্ত ট্রেনে ছোঁড়া ঢিলে প্রীতি দাশ নামে এক প্রকৌশলী মারা যান।
রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, অনেক সময় শিশু-কিশোররা খেলার ছলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে পাথর ছোঁড়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে ডাকাতি ও ট্রেনের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে দুর্বৃত্তরা চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়ে। কিন্তু এদের কাউকেই সাধারণত শনাক্ত করা যায় না। যাত্রাপথে চলন্ত ট্রেন থামানো হয় না। পরে ঘটনাস্থলে গিয়েও অপরাধের সঙ্গে জড়িত কারও হদিস পাওয়া যায় না। ফলে কারা এই ঢিল ছুঁড়েছে, তাদের শনাক্ত করা যায় না। কারণ, বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বা রাতের অন্ধকারে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করলেও কার্যকর কোন ফল পাওয়া যায়নি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এ ব্যাপারে ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় শাস্তির বিধান আছে। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। আর কোনো রেলযাত্রী মারা গেলে ৩০২ ধারায় ফাঁসিরও বিধান আছে। পাথর নিক্ষেপকারী অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে সেক্ষেত্রে তার অভিভাবকের শাস্তির বিধান আছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
এ ব্যাপারে ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় শাস্তির বিধান আছে। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। আর কোনো রেলযাত্রী মারা গেলে ৩০২ ধারায় ফাঁসিরও বিধান আছে। পাথর নিক্ষেপকারী অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে সেক্ষেত্রে তার অভিভাবকের শাস্তির বিধান আছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেলওয়ের পরিদর্শক বায়েজিদ হোসেন। পাথর নিক্ষেপের পর তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ৪১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তার মৃত্যু হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনে কর্তব্যরত গার্ড নাজমুল ইসলাম সোলেমান গুরুতর আহত হন।
পাথর নিক্ষেপের ফলে এভাবে যাত্রীদের পাশাপাশি ট্রেনের চালকসহ অন্যান্য দায়িত্বরতদেরও জীবন ঝুঁকিতে পড়ে। ২০১৯ সালের ৫ মে রাতে সিরাজগঞ্জের জামতৈল ও মনসুর আলী স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে পদ্মা আন্তঃনগর ট্রেনে পাথর হামলায় জিসান নামে চার বছরের এক শিশু গুরুতর আহত হয়। তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। জিসান যখন এই হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখন জুঁথি (১২) নামে আরেক শিশু পাথর হামলায় আহত হয়ে ভর্তি ছিল।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে জানিয়েছে, এক বছরে ৭৪টি পাথর হামলার ঘটনায় ৬৩টি ট্রেনের দরজা-জানালার কাচ ভেঙেছে। আহত হয়েছেন ২০ জন। এর মধ্যে দুজন চালক ও একজন সহকারী চালকও ছিলেন। এছাড়া দুজন গার্ড, একজন সহকারীও আহত হয়েছেন। অন্যরা শিশুসহ নানা বয়সের যাত্রী। পাথর নিক্ষেপের কারণে ট্রেনে এখন যাত্রীরা জানালার পাশে বসতেই ভয় পায়।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সারা দেশের ২০ জেলার ৭০টি স্থানকে পাথর নিক্ষেপের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ১৫টি জেলা পড়েছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মধ্যে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে আছে— দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, পার্বতীপুর, পঞ্চগড়, সৈয়দপুর, ডোমার, পাকশী, ঈশ্বরদী বাইপাস, পোড়াদহ জং, মিরপুর, ভেড়ামারা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট, খুলনার দৌলতপুর, ফুলতলা, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, দর্শনা হল্ট, আলমডাঙ্গা, লালমনিরহাট, নোয়াপাড়া, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, পাঁচবিবি ও চাটমোটর।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানান, শিশু-কিশোরেরা ট্রেন যাওয়ার আগে লাইনে কান পেতে শোনে। এতে তারা বুঝতে পারে ট্রেন আসছে। তখন রেললাইন থেকে পাথর নিয়ে তারা প্রস্তুত থাকে। কে কোন বগিতে মারবে, কে কাচ ভাঙবে, কে ইঞ্জিনে মারবে—এসব প্রতিযোগিতা করে। এটা তারা খেলা মনে করে। এ জন্য যাত্রী ও রেলের চালক-সহকারীদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। যেহেতু শিশু-কিশোরেরা কাজটি করে, তাই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে সচেতনতায় জোর দেওয়া হচ্ছে।
আরও জানান, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ না করার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে লিফলেট তৈরি করে বিতরণ করা হয়। রেললাইনের পাশের মসজিদের ইমামদের এসব লিফলেট দেওয়া হয়। তারা জুমার দিন পড়ে শোনান। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়ে কাজ করা হয়। আরএনবি ও জিআরপি পুলিশও কাজ করে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সভা করা হয়। পাশাপাশি ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে এর কুফল সম্পর্কে শিশুদের অবগত করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়া রোধে কর্তৃপক্ষকে কৌশলী হতে হবে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় রাতের আঁধারে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এসব এলাকা চিহ্নিত করে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে রেল কর্তৃপক্ষকে টহলের ব্যবস্থা করতে হবে।
তারা বলেন, যেসব স্থানে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা ঘটে সেসব স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা যেতে পারে। দুর্বৃত্তরা যাতে রাতের আঁধারে সুযোগ নিতে না পারে সেজন্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ চলে গেছে। তাছাড়া সৌর বিদ্যুতের মতো অনেক বিকল্প আছে। কাজেই কাজগুলো কঠিন হওয়ার কথা নয়।
প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে অপরাধী শনাক্ত করা সাধ্যাতীত কাজ নয়। অপরাধী শনাক্তকরণে অনেক দেশই ড্রোনপ্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে পারে।
আরও বলেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়া যেকোন মূল্যে বন্ধ করতে হবে। যাত্রী নিরাপত্তার স্বার্থে তো বটেই, রেলওয়ের সম্পদ রক্ষার জন্যও এটা জরুরি। যাত্রী সুরক্ষা ও ট্রেনের সম্পদ রক্ষায় রেল কর্তৃপক্ষ সর্ব্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সেটা আমরা দেখতে চাই।
যেসব স্থানে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৫
আপনার মতামত জানানঃ