বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে মেট্রো রেলের যুগে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছর যাত্রী নিয়ে মাথার ওপর দিয়ে মতিঝিল থেকে উত্তরার পথে ছুটবে দেশের প্রথম মেট্রো রেল। কিন্তু বিদ্যমান রেল যোগাযোগ নিরাপদ না হলে এটি এক বড় দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে মানুষের জন্য।
দেশে জরাজীর্ণ লাইন, ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ এসব কারণে গতি বাড়ছে না রেলের। মেয়াদোত্তীর্ণ রেলব্রিজের সংখ্যাও উদ্বেগজনক। দীর্ঘ রেললাইন ও ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় ট্যাম্পিং মেশিনও নেই। যা কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা। তারপরেও নেই কোন পদক্ষেপ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের অবকাঠামোর মান বৈশ্বিক সূচকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
মেট্রো রেল চালু হবার অপেক্ষায় দেশ। অথচ দেশের বিদ্যমান রেলপথ অত্যন্ত জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। উন্নত অবকাঠামোর পাশাপাশি দক্ষ ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোয় জোর দিয়ে উন্নত দেশগুলো যেখানে তাদের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে এখনো পুরনো অবকাঠামোগুলোই ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে।
যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের বিদ্যমান রেলপথ মেরামতের জন্য ৩০টি ট্যাম্পিং মেশিন প্রয়োজন হলেও আছে মাত্র ৬টি। এর মধ্যে ৪টি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। আরও উদ্বেগজনক তথ্য হল, সচল থাকা দুটি ট্যাম্পিং মেশিন ঘন ঘন নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় ট্যাম্পিং মেশিন না থাকায় এখন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রেললাইন সংস্কার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কিছু শ্রমিক কাজ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তাও কম রয়েছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, পুরো রেলেই কংক্রিটের স্লিপার। এ ধরনের স্লিপারে তৈরি রেললাইন ট্যাম্পিং মেশিন ছাড়া সংস্কার করা সম্ভব নয়। ট্যাম্পিং মেশিন ছাড়া লাইন ঠিক রাখার কাজ করতে গিয়ে সামান্যতম ত্রুটির কারণেই ট্রেন লাইনচ্যুতসহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে।
বিদ্যমান জরাজীর্ণ লাইনগুলো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ লাইনচ্যুত ও ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে জরাজীর্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের কারণে।
সূত্র মতে, লকডাউনের সময় জরাজীর্ণ লাইন সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি; ট্যাম্পিং মেশিন থাকলে খুব সহজেই তা সম্ভব হতো। সম্প্রতি পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে স্বল্প পরিসরে ট্যাম্পিং মেশিনের ব্যবহার শুরু হলেও সেগুলো চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই। এছাড়া এটি মেরামতের জন্য নেই ওয়ার্কশপও।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, গত আড়াই বছরে দেশে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন আট শতাধিক। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরও ছয় শতাধিক। রেলওয়ে পুলিশের হিসাবমতে মৃতের সংখ্যা ৭০০।
নিয়মিত রেললাইন পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় বার বার দুর্ঘটনা হচ্ছে রেলে। দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অনেকে অফিসে বসেই পরিদর্শন প্রতিবেদন জমা দিয়ে বিল তুলে নিচ্ছেন। তাছাড়া দক্ষ চালকের অভাব, লোকবলের তীব্র সংকট, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও অবকাঠামোর উন্নয়ন না হওয়াও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
দেশের কোনো না কোনো স্থানে এখন প্রায় প্রতিদিনই রেল দুর্ঘটনা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে প্রায় দেড় হাজার বার। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, চট্টগ্রাম-সিলেট, ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পথে প্রায়ই যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে। দুর্ঘটনার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকছে রেল যোগাযোগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ট্রেন স্বাভাবিকভাবে চলবে কীভাবে? তার জন্য যে নিয়মিত পরিচর্যা দরকার, সেটিই ঠিকমতো হচ্ছে না। লাইনের সঙ্গে ট্রেনের চাকার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কিন্তু এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সবার আগে দরকার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ।’
তিনি বলেন, ‘একদিকে লোকবল সংকট, অন্যদিকে যাদের যে কাজ করার কথা তারা সেই কাজ সঠিকভাবে করছেন না। রেলওয়ের যেসব সরঞ্জাম রয়েছে, সেগুলোও যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে না।’
জনবলের সঙ্কট যে প্রতিনিয়ত বাড়ছে, সে বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. তাফাজ্জল হোসেনও স্বীকার করেছেন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঘন ঘন দুর্ঘটনা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এখন দুর্ঘটনার প্রধান কারণ লোকবল সংকট। যেখানে প্রতি ছয় কিলোমিটারে রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে ২০ জন লোক থাকার কথা, সেখানে আছেন মাত্র দুই-একজন।’
এমন দুর্বল ব্যবস্থাপনায় আর দুর্নীতির অভয়ারণ্যে মেট্রো রেল একই সাথে সম্ভাবনা আর দুর্ভাবনার জন্ম দেবে মানুষের মধ্যে। মেট্রো রেলের সুফল ভোগ করতে হলে, বিদ্যমান রেলব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও দুর্নীতিমুক্ত পরিকাঠামো প্রয়োজন; যা অনেকটাই দিবাস্বপ্ন বাংলাদেশের জন্য।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৫৬
আপনার মতামত জানানঃ