বাংলাদেশে ঘুষ ছাড়া সরকারি চাকুরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা যেন বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো! কোনোভাবেই দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না, বরং সময়ের সাথে সাথে নিত্য-নতুন কলাকৌশল অবলম্বন করে জালিয়াতি করা হচ্ছে। ৮০ নাম্বারের লিখিত পরীক্ষায় জালিয়াতি করে অস্বাভাবিক স্কোর (৭৮, ৭৯ এমনকি ৮০) পাচ্ছে অসৎ পরীক্ষার্থীরা। অন্যদিকে মেধাবী পরীক্ষার্থীরা নিজের মেধার জোরে ৮০ তে ৭২ নাম্বার পেয়েও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না। সারা বছর ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন ধাপে চলছে জালিয়াতির মেলা। স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে হচ্ছে এত জালিয়াতি?
ফাঁকা খাতা কৌশল
সাম্প্রতিক সময়ে এই কৌশল অবলম্বন করে প্রচুর জালিয়াতি করা হচ্ছে। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও তারা পুরো খাতা/ উত্তরপত্রটি ফাঁকা রেখে দেয় এবং খাতার ওপরে সাংকেতিক কোনো চিহ্ন, কোড, সংখ্যা লিখে খাতাটি জমা দেয়।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সেই রাতেই অসৎ সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় সেই কেন্দ্রের খাতার বান্ডিল থেকে নির্দিষ্ট কয়েকজন পরীক্ষার্থীর ফাঁকা খাতা বের করে এবং সেই পরীক্ষার্থীদের দিয়ে সেই খাতায় সঠিক উত্তর লিখিয়ে নেওয়া হয়। উত্তর লেখা সম্পন্ন হলে সেই রাতেই খাতাগুলো পুনরায় যথাস্থানে ফেরত দিয়ে আসা হয়। এই জালিয়াতি করার জন্য পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছাকাছি কোনো হোটেলে অবস্থান করে। তাদের সামনে সঠিক উত্তর সম্বলিত একটি শিট থাকে। তারা সেখান থেকে দেখে দেখে মূল উত্তরপত্রে নকল করে।
পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষার সময় লিখিত পরীক্ষার খাতা পুনরায় নিরীক্ষণ করা হলেও যেন হাতের লেখা মিল পাওয়া যায়, সেই বিষয়টি মাথায় রেখে মূল পরীক্ষার্থী কর্তৃক ফাঁকা খাতা পূরণ করিয়ে নেওয়া হয়। যে পরীক্ষায় হাতের লেখা নিরীক্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেক্ষেত্রে অসৎ সরকারি কর্মচারী বা দালালরাই খাতা পূরণ করে দেয়।
পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত গার্ডকে হাত করা
কয়েকজন চাকরি প্রার্থী উদ্যোগ নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রের কোনো কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক/গার্ডকে অর্থের বিনিময়ে হাত করে নেয়। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে তারা নকল করলেও শিক্ষক/গার্ড তা দেখেও না দেখার ভান করেন। এক্ষেত্রে কক্ষে থাকা অন্যান্য পরীক্ষার্থীরা প্রতারিতবোধ করে। নকল করার প্রস্তুতি না নিয়ে আসায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ পরীক্ষার্থীরা কোনো বাড়তি সুবিধা নিতে পারে না। অন্যদিকে অসৎ পরীক্ষার্থীরা নকল করে তাদের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে চাকরি পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে যায়।
পরীক্ষার হলে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ঢোকা
প্রথম দেখায় মনে হবে জিনিসটা কোনো ব্যাংকের ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড কিন্তু তা আসলে একটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। এর ভেতরে সিম রয়েছে। এই ডিভাইসের সাহায্যে পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে থেকে তথ্য পরীক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো হয়। এমসিকিউ বা নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই যন্ত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। পরীক্ষা কেন্দ্রে কোনো ধরনের মোবাইল, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নেওয়া নিষিদ্ধ, তাই অসৎ পরীক্ষার্থীরা কৌশলে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের আদলে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে পরীক্ষা কক্ষে প্রবেশ করে।
যেসব পুরুষ পরীক্ষার্থীদের চুল বড় এবং যেসব নারী পরীক্ষার্থীরা হিযাব পরিধান করে তারা কানের ভেতরে অত্যাধুনিক ব্লু-টুথ ইয়ারপিস/ইয়ার বাড ঢুকিয়ে রাখে। আধুনিক ইয়ারপিসগুলো আকারে ছোট এবং সম্পূর্ণ তারবিহীন হওয়ায় ঢেকে রাখা সহজ হয় এবং শিক্ষক/গার্ডের চোখ এড়িয়ে যায়। এই ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে থেকে তাদের কাছে উত্তর পৌঁছে দেওয়া হয়।
পোশাক এবং দেহের গোপনাংশে নকল রাখা
দুঃখজনক হলেও সত্য, পরীক্ষার হলে কিছু নারী পরীক্ষার্থী বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার অপব্যবহার করে থাকে। তারা সালোয়ার-কামিজ, বোরকা ইত্যাদির আড়ালে তাদের দেহের স্পর্শকাতর স্থানে চিরকূট, নকল ইত্যাদি লুকিয়ে রাখে। পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়োজিত শিক্ষক/গার্ডের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে নকল করে কিংবা বাথরুমে গিয়ে নকলের সহায়তা নেয়। কিছু পুরুষ পরীক্ষার্থীরা জুতো বা মোজার ভেতরে নকল সংরক্ষণ করে এবং সুযোগ বুঝে তা ব্যবহার করে।
অর্থের বিনিময়ে রোল নম্বর জালিয়াতি
এমনও হয়েছে যে পরীক্ষার্থীর রোল নাম্বার লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকায় দেখা যায়নি সেই পরীক্ষার্থীর রোল নাম্বার মৌখিক পরীক্ষার তালিকায় কিংবা সরাসরি চূড়ান্ত তালিকায় চলে এসেছে! এমনকি চাকরির জন্য আবেদন না করেও চাকরি পাওয়া এবং চাকরি করার রেকর্ড আছে। অন্যদিকে খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েও অনেকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না।
এসব ক্ষেত্রে মূলত মোটা অংকের অর্থ বিনিময়ে যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের সুযোগ করে দেওয়া হয়। পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পরীক্ষার খাতায় কোডিং করা হয়। কাজেই খাতা মূল্যায়নের সময় খাতা মূল্যায়নকারী এটা বুঝতে পারেন না খাতাটি কার। তবে যারা কোডিংয়ের সঙ্গে জড়িত শুধু তারাই পছন্দের প্রার্থীকে শনাক্ত করতে পারেন। সেক্ষেত্রে যাদের পরীক্ষায় ঠেকানো হবে তাদের খাতাগুলো আলাদা করে পছন্দের অথবা অনুগত মূল্যায়নকারীকে দিয়ে খাতাগুলো মূল্যায়ন করিয়ে লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর দিয় দেন অথবা যারা ভাল পরীক্ষা দিয়ছেন তাদের খাতার কভার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে পছন্দের প্রার্থীদের খাতায় লাগিয়ে দেন। ফলে অনেকে অনেক ভাল পরীক্ষা দিয়েও চান্স পান না। আবার অনেক অযোগ্যরা টিকে যান। আর এই কাজগুলো করা হয় গভীর রাতে, যখন মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা পরিচালনা টিম চলে যান।
ছাপাখানা থেকে প্রশ্নফাঁস
ছাপাখানায় কর্মরত তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বা টেকনিশিয়ানদের এক বা একাধিক সদস্য ছাপাখানা থেকে প্রশ্ন ফাঁস করার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে জড়িত থাকে। তারা এককালীন ১ থেকে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রশ্নের একটি কপি মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে মন্ত্রণালয় বা ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয় এই মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি সেই প্রতিষ্ঠানে মাঝারি মানের কোনো পদে কর্মরত। সে তার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পুরো প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে বিভিন্ন ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে চাকরি প্রার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাবধানতাবশতঃ পুরো প্রশ্নপত্রটি কাউকে দিয়ে হাতে লিখে তারপর ছবি তুলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি থেকে চাকরি প্রার্থীদের কাছে প্রশ্নপত্র পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় আরেক হাত ঘুরে আসে। তখন প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করার জন্য আরো বেশি টাকা দিতে হয়।
চাকরির মান ও পদ সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রশ্নপত্র কিনতে চাকরি প্রার্থীরা ১ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, এই টাকাটা চাকরি প্রার্থীরা নিজে এককভাবে না দিয়ে ৫ জন বা ১০ জন মিলে যৌথভাবে পরিশোধ করে। তাই মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি ৩০ জনের কাছে প্রশ্ন বিক্রি করলেও প্রকৃতপক্ষে সেই প্রশ্নপত্র পৌঁছে যায় ১০০ বা তারচেয়েও বেশি মানুষের কাছে।
যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এভাবে ফাঁস হয়ে এ-হাত, ও-হাত ঘুরে যত বেশি ব্যক্তির কাছে পৌঁছায় যায় সেই পরীক্ষা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেড়ে যায়। কারণ প্রশ্নপত্রটি এভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকের হাতে চলে আসে এবং তিনি একটি রিপোর্ট লিখে প্রকাশ করলেই সেই পরীক্ষা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা প্রশ্নের মুখে পড়ে এবং কর্তৃপক্ষ নিজের পিঠ বাঁচাতে পুরো পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়।
জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
গত সপ্তাহে, মঙ্গলবার (১১ জানুয়ারি) দুপুর দুইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত এক মানববন্ধনে চার দফা দাবি জানায় সর্বদলীয় চাকরি প্রত্যাশী ঐক্য পরিষদ। নিয়োগ পরীক্ষায় সবধরনের জালিয়াতি বন্ধ ও সব চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নসহ মোট চারটি দাবি উপস্থাপন করে সংগঠনটি।
সর্বদলীয় চাকরিপ্রত্যাশী ঐক্য পরিষদের দাবিগুলো হলো:
১. সব চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে বাড়ানো।
২. নিয়োগ দুর্নীতি ও জালিয়াতি বন্ধ করা, নিয়োগ পরীক্ষার (প্রিলি ও রিটেন) মার্কসহ ফলাফল প্রকাশ করা।
৩. চাকরিতে আবেদনের ফি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা করা।
৪. একই সময়ে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ করে সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।
তথ্যসূত্র :
মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান
স্বশরীরে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ
পরীক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ
ব্যাংক নিয়োগ বাতিল
স্বাস্থ্য মন্ত্রাণলয়ের প্রায় ৩ হাজার পদের নিয়োগ বাতিল
পরীক্ষা না দিয়েও উত্তীর্ণ
পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও বৈজ্ঞানিক সহকারী
ফসকা গেরো
ক্রাইম রিপোর্ট
আপনার মতামত জানানঃ