ফ্রেডরিক ওয়েস্ট-এর জন্ম হয়েছিল ১৯৪১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। ৩ বোন এবং ছোট ২ ভাইয়ের মাঝে ফ্রেড তার মায়ের সবচেয়ে পছন্দের ছিল। গুজব আছে, ফ্রেডের বয়স যখন মাত্র ১২ বছর তখন তার মা তাকে যৌনকর্মে প্রলুব্ধ করেছিল।
ফ্রেডের বাবার নাম ওয়াল্টার ওয়েস্ট, গ্লোচেস্টাশায়ার ফার্মে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। সে তার সন্তানদেরকে যৌন-খেলনা হিসেবে বিবেচনা করতো এবং ফ্রেড ছোটবেলা থেকেই অজাচারের (রক্তের সম্পর্ক থাকা ব্যক্তির সাথে যৌন সঙ্গম যেমন : মায়ের সাথে ছেলের, বাবার সাথে কন্যার, ভাইয়ের সাথে বোনের ইত্যাদি) সাথে পরিচিত ছিল। ফলে ফ্রেড তার বাবা-মায়ের মতো নিজেও অজাচার কর্মে দীক্ষিত হয়েছিল, সে ভাবতো অজাচার একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। ১৯৬১ সালে ১৩ বছরের এক মেয়েকে গর্ভবতী করার অপরাধে ফ্রেডকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
গ্রেফতার হওয়ার পর ফ্রেডকে মোটেও উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়নি, বরং সে বলেছিল, “সবাই তো এভাবেই করে, তাই না?” দুঃখের বিষয়, কেসটি কখনো আদালতে যায়নি কারণ ভীত-সন্ত্রস্ত কিশোরী মেয়েটি আদালতে গিয়ে তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তবে ফ্রেডের মা ডেইজি এই কেলেংকারীর পর ফ্রেডকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ফ্রেড তার খালা ভায়োলেট-এর সাথে মাচ মারকেল, হার্টফোর্ডশায়ার-এ থাকতে শুরু করে।
ফ্রেড ১৯৬২ সালের ১৭ নভেম্বর রেনা কস্টেলো নামের এক নারীকে বিয়ে করে। রেনা’র আসল নাম ছিল ক্যাথরিন। অবশ্য বিয়ের সময় রেনা ইতিমধ্যে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত¡া ছিল। অন্য একজন প্রেমিক কর্তৃক গর্ভবতী হয়েছিল রেনা। তবে সেই সন্তানের পিতা হিসেবে ফ্রেড নিজের নাম দিতে কোনো কার্পণ্য করেনি। ফ্রেড ও রেনা দম্পতির ঘরে শারমেইন নামের এক কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছিল। তারপর অল্প সময়ের ব্যবধানে রেনা’র গর্ভ থেকে ফ্রেডের নিজের সন্তান অ্যান-মেরি জন্ম লাভ করে। বাচ্চাদের লালন-পালন করার ব্যাপারে সাহায্য করতে রেনা’র বান্ধবী অ্যান ম্যাকফল তাদের বাড়িতে এসে উঠেছিল।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফ্রেডের দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসে। রেনাকে নিজের স্যাডিস্টিক সেক্স গেমসে অংশগ্রহণ করার জন্য জোরাজুরি করতে শুরু ফ্রেড। কিন্তু রেনা ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ করেনি। অন্যদিকে অ্যান ম্যাকফল ফ্রেডের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে তার সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসিতে অংশগ্রহণ করে। ফলে রেনা ফ্রেডের বাড়ি ছেড়ে স্কটল্যান্ডে ফিরে যায়। নিজের সন্তানদেরকে রেখে যায় ফ্রেড এবং অ্যানের কাছে।
কিছুদিন না যেতেই অ্যান গর্ভবতী হয়ে পড়ে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সে ফ্রেডকে প্রতিনিয়ত রেনাকে ডিভোর্স দেওয়ার ব্যাপারে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু ফ্রেড উল্টো অ্যানকে হত্যা করে এবং তার হাত-পায়ের আঙুলগুলো কেটে নেয়। এধরনের অঙ্গহানি করার ব্যাপারটি পরবর্তীতে ফ্রেডের ট্রেডমার্ক বা প্রতীক হয়ে যায়। মাচ মারকেলের কাছে অবস্থিত ‘ফিঙ্গারপোস্ট ফিল্ড’-এ অ্যানের লাশ পুঁতে রাখে ফ্রেড ওয়েস্ট। অ্যানের সাথে তার গর্ভে থাকা বাচ্চাটিরও সলিল সমাধি ঘটে।
১৯৬৯ সালে ফ্রেড ও রোজমেরি’র সাক্ষাৎ হয়। তখন রোজের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। ইতোমধ্যে সে ওই বয়সেই পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছিল। চেলহেনহ্যাম-এ নিজের মা ও ছোট দুই ভাইয়ের সাথে থাকতো সে। তার বাবার নাম উইলিয়াম লেটস। রোজের বাবা স্বভাবে একই সাথে ছিল হিংস্র এবং অজাচারী। তার হাত থেকে বাঁচতে রোজের পুরো পরিবার পালিয়ে এসেছিল। ফ্রেডের বয়স তখন ২৭ বছর। কিশোর বয়সী রোজের বড় স্তনঅলা বুক দেখে সে তৎক্ষণাৎ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই তারা একে অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং রোজ ফ্রেডের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। সেখানে গিয়ে সে শারমেইন এবং অ্যান-মেরি’র পালক মা হিসেবে দায়িত্ব নেয়।
১৯৭০ সালে নিজের একটি কন্যাসন্তান জন্ম দেয় রোজ। মেয়েটির নাম : হেদার। তবে গুজব আছে, এই হেদার আসলে রোজের অজাচারী বাবা উইলিয়ামের ঔরসজাত সন্তান। ফ্রেডের সাথে থাকতে শুরু করার পর রোজ আবার তার বাবার সাথে পুনরায় যোগাযোগ করতে আরম্ভ করেছিল। কথিত আছে, স্বামী ফ্রেড ওয়েস্টের সম্মতি নিয়েই রোজ তার বাবার সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হতো! এমনকি ১৯৭২ সালে ফ্রেডের সাথে বিয়ে হওয়ার পরেও রোজের সেই যৌনলীলা জারি ছিল!
ওয়েস্ট দম্পতির সাথে শারমেইনের শৈশবটা ছিল টর্চারে ভরপুর। ফ্রেড ও রোজ নিয়মিত তার ওপর নির্যাতন চালাতো এবং মারধর করতো। আদালতের রোজের বিচার চলাকালীন সময়ে হাজির বিভিন্ন সাক্ষীর কাছ থেকে জানা যায় তারা দেখেছেন- শারমেইনকে দাঁড় করিয়ে, তার হাত দুটো পিঠের পেছনে নিয়ে চেয়ারের সাথে চামড়ার বেল্ট দিয়ে বেঁধে, রোজ ওয়েস্ট একটা কাঠের চামচ দিয়ে তাকে পেটাচ্ছিল।
শারমেইনের দুঃসহ জীবনের ইতি ঘটেছিল ১৯৭১ সালে। ফ্রেড ওয়েস্ট তখন চুরি করার অভিযোগে কিছুদিনের জন্য জেলে ছিল। তাই ধারণা করা হয়, রোজ ওয়েস্টই ৮ বছর বয়সী শারমেইনকে অমানবিকভাবে পিটিয়ে খুন করার কাজটা করেছিল। স্বামী জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগপর্যন্ত লাশটি লুকিয়ে রেখেছিল সে। পরবর্তীতে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ফ্রেড এসে শারমেইনের লাশ থেকে হাত-পায়ের আঙুলগুলো কেটে নেয় এবং তাকে তাদের তৎকালীন বাড়ি ২৫ মিডল্যান্ড রোড, গ্লোচেস্টাশায়ার-এ পুঁতে রাখে।
যখন শারমেইনের মা রেনা তার মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল তখন ওয়েস্ট দম্পতি তাকেও খুন করে এবং মাচ মারকেল-এর ‘লেটারবক্স ফিল্ড’-এ পুঁতে রাখে। তবে মা, মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে কেউ কোথাও কোনো রিপোর্ট করেনি। অবশ্য শারমেইন নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কারণ দর্শানোটা খুব সহজ ছিল। “সে তার মায়ের কাছে চলে গেছে,” বলেছিল রোজ ওয়েস্ট।
১৯৭২ সালে ফ্রেড এবং রোজরেমি বিয়ে করে, একই বছর তাদের দ্বিতীয় কন্যা সন্তান মেই জন্মগ্রহণ করে এবং তারা জুন মাসে ২৫ ক্রমওয়েল স্ট্রিটের বাড়িতে ওঠে। মূলত এটা ছিল তাদের প্রথম প্রকৃত বাড়ি বা নিজের বাড়ি। এই বাড়িতে তারা মনের সুখে তাদের সহিংস স্যাডিস্টিক ফ্যান্টাসিগুলো পূরণ করেছিল। বিকৃত যৌনচর্চার কারণে হরেক রকম শেকল, চাবুক ইত্যাদি দিয়ে ভরে গিয়েছিল বাড়িটা। ফ্রেড তার বাড়ির ভূগর্ভস্থ কক্ষটিকে টর্চার চেম্বার হিসেবে ব্যবহার করতো এবং সেখানে ৮ বছর বয়সী অ্যান-মেরি’র ওপর নিয়মিত নির্যাতন চালানো হতো। সেই কক্ষে সে অ্যান-মেরিকে ভয়ঙ্করভাবে ধর্ষণ করতো, রোজ তখন অ্যান-মেরিকে ধরে রাখতো এবং হুমকি দিতো যদি অ্যান কাউকে কিছু বলে তাহলে তার ওপর আরো নির্যাতন চালানো হবে। বিয়ে হওয়ার পরেও রোজ ওয়েস্ট তখন পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত ছিল। তার বেডরুমের দরজার বাইরে লাল বাতি জ্বলতো। সেই বাতি দেখে বাচ্চারা বুঝতো মা এখন ‘কাজ’ করছে, তাকে বিরক্ত করা যাবে না।
১৯৭২ সালে ১৭ বছর বয়সী ক্যারোলিন ওউইনসকে ন্যানি হিসেবে কাজে নেয় ওয়েস্ট দম্পতি। তারপর তারা তাকে ড্রাগ দেয়, প্রচুর মারধোর করে এবং ধর্ষণ করে। ক্যারোলিন কথা দিয়েছিল তার সাথে হওয়া এসব নির্যাতনের কথা সে কাউকে বলবে না। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ওয়েস্ট দম্পতি তার কথা বিশ্বাস করেছিল এবং তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর ক্যারোলিন ঠিকই ঘটনাটা পুলিশকে জানায় এবং ওয়েস্ট দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। ১৯৭৩ সালে মামলাটা যখন আদালতে ওঠে তখন ফ্রেড ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সেদিন যা যা ঘটেছিল তাতে ক্যারোলিনের সম্মতি ছিল! পরবর্তীতে ওয়েস্ট দম্পতি কিছু জরিমানা দিয়ে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পায়।
২৫ ক্রমওয়েল স্ট্রিটের বাড়িটা আকারে বেশ বড় ছিল। তাই বিল মেটানোর জন্য বাড়িতে ভাড়াটিয়া তুলতো ওয়েস্ট দম্পতি। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সেই বাড়িতে ওঠে ১৯ বছর বয়সী তরুণী লিন্ডা গফ। বাড়িতে থাকা অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের সাথে তার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সে মারা যায়। বাথরুমের মেঝের নিচে পাওয়া গিয়েছিল তার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন লাশটি। বাদামী টেপ দিয়ে শক্ত করে তার মাথা পেঁচানো ছিল, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো একটা আরেকটার ওপর স্তুপ করে রাখা ছিল।
পরবর্তী ৫ বছর জুড়ে নৃশংসভাবে আটজন অল্পবয়সী মেয়েকে হত্যা করেছিল ওয়েস্ট দম্পতি। সেক্স গেমস খেলার জন্য তারা মেয়েদেরকে ফুসলিয়ে ক্রমওয়েল স্ট্রিটে নিয়ে আসতো। গাড়িতে রোজ থাকায় ভিকটিমরা নিরাপদ বোধ করতো। তারা ভাবতেও পারতো না সে ফ্রেডের অপকর্মের সাথে জড়িত। অথচ রোজ শুধু জড়িতই নয় বরং নিজের ভেতরেও ফ্রেডের বিকৃতরুচিকে ধারণ করতো। ভিকটিমদেরকে নির্যাতন এবং ধর্ষণ করার সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতো সে। টর্চার চেম্বারে মেয়েদের মাথা টেপ দিয়ে মুড়িয়ে, নাক দিয়ে ব্রিদিং টিউব ঢুকিয়ে তাদের যন্ত্রণা দীর্ঘ করে, নিজের বিকৃত যৌনচাহিদা চরিতার্থ করতো ফ্রেড। শুধু তা-ই নয়, পাশবিকতা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পাশাপাশি সে নিজের কিছু কীর্তিকলাপ ভিডিও করে রাখতো।
ওয়েস্ট দম্পতির পাঁচ নাম্বার ভিকটিমের নাম ছিলÑ ক্যারল কুপার, বয়স ১৫ বছর। বাচ্চাদের আশ্রমে থাকতো সে। তাকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১০ নভেম্বর। নানুর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশে বাসে উঠছিল। ১৯৯৪ সালের সেই ভয়ংকর দিনে, ২৫ ক্রমওয়েল স্ট্রিটের ভূগর্ভস্থ কক্ষের মেঝের নিচ থেকে ক্যারলের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। ফ্রেড ওয়েস্ট পরবর্তীতে ক্যারলকে খুন করার বিষয়টি স্বীকার করলেও খুনের সাথে রোজের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছিল।
একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর ক্রিসমাসের দাওয়াত খেয়ে ফেরার পথে, ওয়েস্ট দম্পতি ২১ বছর বয়সী লুসি পারটিংটন-কে চেলহেনহ্যাম বাস স্টপ থেকে তুলে নিয়েছিল। লুসি’র ছিল গ্রেটন, গ্লোচেস্টাশায়ার-এর বাসিন্দা। সে এক্সিটার ইউনিভার্সিটিতে প্রাচীন ইংলিশ নিয়ে পড়াশোনা করতো। সে-রাতে লুসি নিখোঁজ হয় এবং তার দেহাবশেষ ক্রমওয়েল স্ট্রিটের সেই ভূগর্ভস্থ কক্ষের মেঝের নিচে পাওয়া গিয়েছিল।
১৯৭৪ সালের ৩ জানুয়ারি ফ্রেড তার হাতে একটা কাটার ক্ষত নিয়ে স্থানীয় ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত নিজের ভিকটিমদের লাশ টুকরো টুকরো করতে গিয়ে আঘাত পেয়েছিল সে।
থেরিয়েস জিনথালার নামের ২১ বছর বয়সী সুইডিশ মেয়েটি থাকতো লন্ডনে। তাকে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল ১৯৭৪ সালে। ছুটি কাটাতে আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার উদ্দেশে সে হিচ-হাইকিং (বিভিন্ন জনের গাড়িতে লিফট নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো) করছিল। চেপস্টো থেকে তাকে নিজের লরিতে তুলে নিয়েছিল ফ্রেড। সেখান থেকে তাকে নিয়ে এসেছিল ২৫ ক্রমওয়েল স্ট্রিটে। অন্য মেয়েদের মতো তাকেও খুন করার আগে আটকে রেখে হিংস্র যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছিল। ভূগর্ভস্থ কক্ষের মেঝের নিচে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তার শরীরে সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিল না। হয়তো ফ্রেড তার ভয়ংকর নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন রাখার জন্য সেগুলো কেটে নিয়েছিল।
ওয়েস্ট দম্পতির টর্চার চেম্বার মারা যাওয়ার সময় শার্লি হাবার্ড-এর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। ১৯৭৪ সালের ১৪ নভেম্বর, বাসে চড়ে ড্রয়েটউইচ-এ অবস্থিত বাড়িতে ফিরছিল সে। কিন্তু কখনো বাড়িতে পৌঁছাতে পারেনি। তার লাশটিও অন্য মেয়েদের সাথে ভূগর্ভস্থ কক্ষের মেঝের নিচে পাওয়া গিয়েছিল। তার মাথাটা টেপ দিয়ে পেঁচানো ছিল। তার নাকের ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ব্রিদিং টিউবস (শ্বাস নল) ঢোকানো ছিল।
ফ্রেডের পরবর্তী ভিটটিমের নাম- উনিটা মট, বয়স ১৮ বছর, নিউয়েন্ট, গ্লোচেস্টাশায়ার-এর বাসিন্দা। উনিটা ১৯৭৫ সালের ১১ এপ্রিলে গ্লোচেস্টারশায়ারে হিচ-হাইকিং করছিল। তখন ওয়েস্ট দম্পতি তাকে লিফট দেয়। গাড়িতে রোজকে দেখে উনিটা লিফট নেওয়ার সাহস পেয়েছিল কিন্তু সেটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বাজে সিদ্ধান্ত। ওয়েস্ট দম্পতি তাকে প্লাস্টিক ক্লথস-লাইন দিয়ে টাইট করে বেধে, নিজেদের বিকৃত চাহিদা পূরণ করার পর তাকে হাতুড়ি নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। উনিটা’র শরীর থেকে মাথাটাকে বিচ্ছিন্ন করে তারপর লাশটাকে ভূগর্ভস্থ কক্ষের মেঝের নিচে রেখেছিল তারা।
পরবর্তী ভিকটিম নিজেই ২৫ ক্রমওয়েল স্ট্রিটে এসেছিল। শার্লি রবিনসন মূলত ওয়েস্ট দম্পতিকে বাচ্চা দেখাশোনার কাছে সাহায্য করতো। প্রাথমিকভাবে যারা ওয়েস্ট দম্পতির চাইল্ড কেয়ারে কাজ করতো তাদের মধ্যে একজন ছিল সে। কিন্তু কাজ করতে এসে সে ফ্রেডের প্রেমে পড়ে যায় এবং এক বিছানায় থ্রিসাম (রোজ-ফ্রেড-শার্লি) যৌন-মিলনে অংশগ্রহণ করে।
১৯৭৮ সালে শার্লি ফ্রেড কর্তৃক গর্ভবতী পড়ায় রোজ তার ব্যাপারে ঈর্ষানিত্ব হয়ে ওঠে। অথচ তখন রোজ নিজেও ফ্রেডের এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ‘অতিথি’ কর্তৃক প্রেগনেন্ট হয়ে রয়েছে! ফ্রেড তার শ্যালক জিমি টাইলারকে বলেছিল, শার্লির এত ‘লেপ্টালেপ্টি’ দেখতে দেখতে সে বিরক্ত হয়ে গেছে। শার্লিকে যেতে হবে। পরবর্তীতে শার্লি ও তার গর্ভে থাকা বাচ্চার দেহাবশেষ ক্রমওয়েল স্ট্রিটের বাগানের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল।
কয়েক মাস পরে বেশ সহজেই শার্লি’র জায়গা পূরণ হয়ে গিয়েছিল। ১৬ বছর বয়সী অ্যালিসন চেম্বার প্রায়ই ক্রমওয়েল স্ট্রিটে বেড়াতে আসতো। কারণ তার এক বন্ধু থাকতো এখানে। অ্যালিসন ছিল সোয়ানজি, ওয়েলস-এর বাসিন্দা কিন্তু গ্লোচেস্টাশায়ার-এর একটি চিল্ড্রেন’স হোমে থাকতো সে। ওয়েস্ট দম্পতি তাকে নিজেদের চাইল্ড কেয়ারে ন্যানি (শিশু পরিচর্যাকারী) হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং ওখানে ওঠার কথা বলে। ১৯৭৯ সালের ৫ আগস্ট শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল তাকে। পরবর্তীতে তার লাশও ক্রমওয়েল স্ট্রিটের বাগানের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল।
সৌভাগ্যবশতঃ ওয়েস্ট দম্পতির কন্যা সন্তান অ্যান-মেরি ক্রমওয়েল স্ট্রিটের সেই নরকতুল্য বাড়ি ছেড়ে তার প্রেমিকের সাথে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিল। তখন ফ্রেড তার যৌনদৃষ্টি হেদার এবং মেই-এর ওপর নিয়ে আসে এবং তাদের ওপর যৌন-নির্যাতন চলতে থাকে। তবে হেদার বেশ মারাত্মকভাবে মার খেয়েও যেকোনোভাবে ফ্রেডের হাতে নিজেকে ধর্ষণ হওয়া ঠেকাতে পেরেছিল।
১৯৮৭ সালের ১৭ জুন হেদার নিখোঁজ হয়ে যায়। বিষয়টা নিয়ে বন্ধু ও প্রতিবেশীদের মাঝে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। ওয়েস্ট দম্পতির পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয়, হেদার কোথাও পালিয়ে গিয়েছে। তবে এবার প্রতিবেশীদের অনেকেই ক্রমওয়েল স্ট্রিটের বাড়িতে কারা আসে-যায় তা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করো। দুঃখের বিষয়, বাড়ির সামনে থাকা উঠোনের নিচেই হেদারকে পুঁতে রাখা হয়েছিল। এটা নিয়ে ওয়েস্ট দম্পতি খুল্লামখুল্লা কৌতুকও করতো। ফ্রেড অন্য বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে বলতো, যদি তারা কথা না শোনে তাহলে তাদেরকেও হেদারের মতো উঠোনে পুঁতে রাখা হবে।
শিশু নির্যাতনের অভিযোগটি সামনে আসার পর ওয়েস্ট দম্পতিকে ১৯৯২ সালে গ্রেফতার করা হয়। সেসময় তাদের পাঁচজন সন্তানকে কেয়ার ইউনিটে নেওয়া হয়েছিল কারণ তাদের সবার বয়স ছিল ১৬-এর নিচে। ফ্রেড ও রোজের বিরুদ্ধে একাধিক যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ এবং পায়ুকামীতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার, তারা সাজার হাত থেকে বেঁচে যায়। কারণ কেসের প্রধান দুইজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
তদন্ত দলের একজন সদস্য কেসটাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারেননি। তিনি হলেন ডিটেকটিভ কন্সটেবল হ্যাজেল স্যাভেজ। এই নারী কর্মকর্তা গ্লোচেস্টাশায়ার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। তিনি জানতেন ২৫ ক্রমওয়েল স্ট্রিটে অবশ্যই কোনো গন্ডগোল আছে। তিনি ওয়েস্ট দম্পতির বাড়িতে থাকা বাচ্চাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং ধীরে ধীরে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন। বাচ্চারা তাকে হেদার গায়েব হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছিল। বাড়ির সামনে অবস্থিত উঠোনের নিচে হেদারকে পুঁতে রাখার রেফারেন্সটিও উল্লেখ করেছিল তারা। সিনিয়র অফিসারদের মনে হয়েছিল, ওই বাড়িতে সার্চ করার জন্য অফিসিয়াল ওয়্যারেন্ট পেতে হলে আরো প্রমাণ প্রয়োজন। কিন্তু হ্যাজেল স্যাভেজের জেদের কারণে ১৯৯৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ২৫ ক্রমওয়েল স্ট্রিটে হানা দেয় এবং সেখানকার ভয়ানক সব রহস্য উন্মোচন করে।
গ্রেফতার হওয়ার পর ফ্রেড ওয়েস্ট বলেছিল সবগুলো খুন সে করেছে এবং এখানে তার স্ত্রী রোজের কোনো হাত নেই। শুধু তা-ই নয়, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে পুঁতে রাখা আরো ২০টি লাশের দায়ও স্বীকার করেছিল। সে কথা দিয়েছিল পুলিশকে সবগুলো স্থানের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ফ্রেড জেলে থাকাবস্থায় আত্মহত্যা করেছিল। তাই নিখোঁজ হওয়ার মেয়েদের পরিবারগুলোকে আর কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব হয়নি।
১৯৯৫ সালের পহেলা জানুয়ারি তথা নিউ ইয়ার’স ডে-তে সে উইনসন গ্রিন প্রিজনের একটি সেলে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে এবং তার লাশের সাথে অপ্রকাশিত গোপন সব তথ্যেও মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। রোজ প্রথমে খুনোখুনির সাথে নিজে জড়িত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করলেও শারমেইন-এর দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার পর তার জড়িত থাকার ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কারণ শারমেইন-এর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৭১ সালে, অথচ তখন ফ্রেড একটা অপরাধের শাস্তি হিসেবে কারাভোগ করছিল।
১৯৯৫ সালের অক্টোবরে রোজের বিরুদ্ধে ১০টি খুনের অভিযোগ আনা হয়। আদালতে অ্যান-মেরি তার মা রোজের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল। জানিয়েছিল ৮ বছর বয়স থেকে কীভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল সে। আদালতে এভাবে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অ্যান এতটাই চাপবোধ করছিল যে, দ্বিতীয় দিন আদালতে আসার আগে সে পিলের ওভারডোজ নিয়ে ফেলেছিল। যা হোক, ১৯৯৫ সালের ২৩ নভেম্বর কোর্টে আবার মা রোজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল সে। রোজের বিরুদ্ধে আনিত ১০টি খুনের অভিযোগে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেছিল। বিচারক মিস্টার জাস্টিস ম্যানটেল সুপারিশ করেছিলেন, রোজ যেন তার জীবদ্দশায় কখনো কারাগার থেকে মুক্তি না পায়।
ফরেনসিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মাইকেল স্টোন-এর ‘টপ টেন অব ইভল’ নামের একটি কুখ্যাত তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল ওয়েস্ট দম্পতি। কারণ হিসেবে ডক্টর স্টোন বলেছিলেন, “তারা ভিকটিমদের ওপর দীর্ঘসময় নিয়ে, সবচেয়ে নারকীয় উপায়ে নির্যাতন করতো। মানসিকভাবে যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতি অবলম্বন করতো তাদের সাথে। শুধু তা-ই নয়, এসব অপকর্ম করার সময় তাদের মাঝে কোনোরকম অনুশোচনা কাজ করতো না, তারা বরং ব্যাপক আনন্দ পেতো, উল্লাস করতো।” ডক্টর স্টোন তার তালিকায় রোজমেরি ওয়েস্টকে তার স্বামীর সাথে “প্রায় একই পর্যায়ের” সহযোগী হিসেবে জায়গা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তার স্বামী অন্তত অপরাধবোধ থেকে আত্মহত্যা করার মতো নুন্যতম শিষ্টাচার দেখিয়েছেন!”
পুলিশের ধারণা, আরো অনেক তরুণী এই ওয়েস্ট দম্পতির হাতে মারা গিয়েছিল। অ্যালিসন চেম্বার (১৯৭৯) এবং হেদার ওয়েস্ট (১৯৮৭)-এর খুনের মাঝে ৮ বছরের বিরতি রয়েছে। এই ৮ বছরে আরো অনেকেরই ওয়েস্ট দম্পতির শিকারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কোনো লাশ না পাওয়া গেলে সেই সম্ভাবনার আড়ালে থাকা প্রকৃত সত্য হয়তো আর কখনোই সামনে আসবে না।
অনুবাদ : সাঈম শামস্
তথ্যসূত্র : bbc, criminalminds
আপনার মতামত জানানঃ