কথিত আছে, data is the new oil. আধুনিক যুগে ডেটার মাধ্যমেই ইউজারদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এর অর্থ, স্যোশাল মিডিয়ায় ইউজারদের সাইকোলজি হ্যাক করা হচ্ছে। কম্পিউটার হ্যাকিং এখানে পুরোপুরি নস্যি যেখানে মানুষের আস্ত মস্তিষ্ককেই হ্যাকিং করা সম্ভব। যখন ইউজাররা কোন একটি পণ্য সম্পর্কে গুগলে জানতে চান এর পরপরই সেই প্রণ্যের বিজ্ঞাপন গুগলের সঙ্গে যুক্ত ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট সবখানে দেখতে পান। এই তথ্যগুলো সব সংরক্ষণ করা হয়, যা নিয়ন্ত্রণ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা AI; টার্মিনেটর মুভিতে দেখা যায় পৃথিবীকে এক সময় যন্ত্রেরা নিয়ন্ত্রণ করবে যাদের থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কিন্তু নেটফ্লিক্সের ডকুমেন্টারি স্যোশাল ডেলাইমা আমাদের বলছে সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতোমধ্যে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ইউজারদের পুরো সাইকোলজি আগে এমনটা ছিল না যেমনটা এখন আছে। একারণেই এডওয়ার্ড টাফটি বলেছেন, There are only two industries that call their customer ‘user’, Illegal drug and software.
স্যোশাল ডেলাইমা ডকুমেন্টারিতে কী কী দেখানো হয়েছে, ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেসবই আমি আলোচনা করব। এখানে স্পয়লারের কোনো ভয় নেই। বরং এই লেখা ডকুর জটিল ব্যাখ্যাকে বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করবে। এই ডকুমেন্টারিতে ফেসবুক, গুগল, এপলের সাবেক ইঞ্জিনিয়াররা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন যারা তাদের কাজের মাধ্যমে এর ইউজারদের মেনিপুলেটিং করে। তাদের মতে মুষ্টিমেয় কিছু ইঞ্জিনিয়ার ফেসবুকের লাইক বাটন, নোটিফিকেশন সিস্টেম, গুগলের ইনবক্স আর্কিটেকচার বানিয়েছে যার মাধ্যমে ইউজারদের এই সমস্ত সাইটগুলোর সঙ্গে আরও বেশি পরিমাণে এঙ্গেজ করা যায়, প্রথম দিকে সব দারুণ চলছিলো। এরপর আরও ভালো করার জন্য যুক্ত হয় কমেন্ট সেকশন ও বাকী সব আনুষাঙ্গিক অপশন। শুরুটা হয় ২০০৯ সালে। এর পূর্বে সমস্যা এতটা গুরুতর ছিল না। এরপরই ইন্সটাগ্রামকে ফেসবুক রিক্যুয়ার করে। গুগল তো আগে থেকেই ছিল, তবে এটা সর্বজন স্বীকৃত ছিল যে ফেসবুক গুগল ও বাকীদের কাছে ইউজাদের ডেটা সংরক্ষিত থাকে। গুগল স্ল্যাশ হিস্টোরিতে একজন ইউজারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা যা করেছে সব সংরক্ষণ করে রাখা আছে।
শুরুর দিকে ইঞ্জিনিয়াররা এই সাইটগুলোর পেছনে এমনভাবে লেগে থাকতেন যেন এর ইউজাররা আরও বেশি এগুলোর প্রতি এডিক্টেড হতে থাকে। কেউই এমন কিছু করত না যেন ইউজাররা অপেক্ষাকৃত কম এডিক্টেড হয়। গুগলের মাত্র ৫০ জন ইঞ্জিনিয়ার ২ বিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করে এর নোটিফিকেশন কেমন হবে, লোগো কেমন হবে শুধু এই সামান্য জিনিসগুলোর মাধ্যমে, সবই করা হয়েছে এর ইউজারদের জন্য। সিলিকন ভ্যালি তার জন্মের প্রথম পঞ্চাশ বছর ধরে কম্পিউটারের বিভিন্ন সফটওয়্যার-হার্ডওয়্যার বানিয়েছে, বিক্রি করেছে ও দুই হাতে অর্থ উপার্যন করেছে। একদম সহজ ব্যবসা ছিলো। কিন্তু শেষ দশ বছরে সিলিকন ভ্যালি বিক্রি করেছে ইউজার।
ইউজাররা যে পণ্যের জন্য কিছুতেই তাদের গাঁটের পয়সা খরচ করতে চায় না, বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো ঠিক একই পণ্যের জন্য কাড়ি কাড়ি পয়সা খরচ করে শুধু সেগুলো ইউজারদের স্ক্রিনে ভেসে ওঠার জন্য। বিজ্ঞাপন সংস্থা ইউজারদের ব্যাবহারের জন্য অর্থ ব্যয় করে, এই অর্থ পাচ্ছে স্যোশাল সাইটগুলো। অর্থাৎ এখানে ক্রেতা হল বিজ্ঞাপন সংস্থা, বিক্রেতা স্যোশাল প্ল্যাটফর্ম ও পণ্য সাধারণ ইউজারগণ। একারণেই গুগলের ফরমার ডিজাইন ইথিসিস্ট ও সেন্টার ফর হিউম্যান টেকনোলজি এর কো-ফাউন্ডার ট্রিস্টেন হ্যারিস বলেছেন: If you are not paying for the product, then you are the product.
বেশিরভাগ মানুষ ভাবে গুগল একটি সার্চ বক্স, তার ফেসবুক বন্ধুদের সমাবেশ যেখানে ছবিতে লাইক কমেন্টের মাধ্যমে বা ইনবক্স চ্যাটে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। কিন্তু এই সাইটগুলো আসলে মানুষের মনোযোগ আটকে রাখে। ফেসবুক টুইটার স্ন্যাপচ্যাট সহ সমস্ত স্যোশাল সাইটের কাজই হল মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করে রাখা। ইউজাররা কতটা সময় এসমস্ত সাইটগুলোতে ব্যয় করে, জীবনের কতটা অংশ সাইটগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখে এখানে এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ।
লোকের ধারণা ইন্টারনেট ফ্রি, ফেসবুক ফ্রি, গুগল ফ্রি, স্ন্যাপচ্যাট ফ্রি। বিনামূল্যে তারা এসব ব্যবহার করছে। আসলে এসবের কোনটাই ফ্রি না। এরা বিজ্ঞাপন দাতাদের টাকায় চলে। কেন বিজ্ঞাপন দাতারা এদের টাকা দিবে? কারণ ইউজাররা বিজ্ঞাপন দেখে। এই কোম্পানিগুলো ইউজারদের বিজ্ঞাপন দেখানোর বদলে টাকা পায়। ফলে এখানে আমরা যারা ইউজার তারাই হয়ে উঠেছি পণ্য, বিজ্ঞাপন দাতা ও স্যোশাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে ক্রেতা ও বিক্রেতা। এরা বিজ্ঞাপনগুলো প্রচারের মাধ্যমে আপনি কী ভাববেন, কী খাবেন, আপনার পরিচয়, খাদ্যাভাস সামান্য এবং ক্ষীণভাবে হলেও বদলে দিচ্ছে। প্রতিটা ব্যবসায়েরই উদ্দেশ্য হল তার ভোক্তাদের প্রভাবিত করা। আর স্যোশাল মিডিয়া এমন প্ল্যাটফর্ম যেখানে এতটুকু নিশ্চয়তা আছে যে কোন নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন প্রচার করা হলে তা সফল হবেই। এই বিষয়টিকে বলে, Selling the certainty; বিক্রয়ের নিশ্চয়তা আসে গ্রেট প্রেডিকশন থেকে। সফল ব্যবসার মূল চাবিই হল গ্রেট প্রেডিকশন, পণ্য বা সেবাটি ভোক্তা গ্রহণ করবে কিনা করলেও কতটুকু করবে এর স্বচ্ছ অনুমান থাকা। গ্রেট প্রেডিকশনের প্রথম শর্ত হলো কাস্টমার বা ভোক্তার সম্পর্কে বিপুল পরিমাণ তথ্য জানা।
ভোক্তার তথ্য জানাকে আধুনিক অর্থনীতির ভাষায় সার্ভেল্যান্স ক্যাপিটালিজম বলে। এটা একধরণের ইনফিনিটি ট্র্যাকিং এর ক্যাপিটালিজম প্রফিটিং। ইউটিউব, গুগল, ফেসবুকের মতো বড় বড় কোম্পানিগুলো তার ইউজারদের উপরে সার্ভেল্যান্সের কঠিন কাজটা করছে। মানুষ অনলাইনে যা করছে তা নজরদারি করা হয়, মাপা হয়, ট্র্যাক করা হয়। আপনি যাই করেন না কেন তা অতি সুক্ষ্মভাবে মনিটরিং ও রেকর্ড করে রাখা হয়। স্ক্রলিং করতে গিয়ে কোন ছবি কতটা সময় নিয়ে দেখছেন সেটাও রেকর্ড হয়। তারা জানে কখন ইউজাররা একাকিত্ব ও বিষাদে ভোগে, কখন প্রাক্তন প্রেমিক অথবা প্রেমিকার রোমান্টিক ছবি দেখে, রাতের আঁধারে ইউজারের মনোযোগ কোথায় থাকে। তারা সব জানে, সব তাদের নখদর্পনে। আপনি ইন্ট্রোভার্ট নাকি এক্সট্রোভার্ট, কোন ধরণের স্নায়বিক সমস্যা আপনার রয়েছে, কোন ধরণের ব্যক্তিত্ব আপনার পছন্দ। আপনার ব্যাপারে ওদের কাছে এত পরিমাণে তথ্য রয়েছে ততটা তথ্য সম্ভবতঃ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিকটেও নেই। তারা সব সময় এই তথ্যগুলো হিউম্যান সুপারভিশনের জন্য কাজে লাগায়। আপনি যত ফেসবুক ঘাটবেন, যত ইউটিউবে ভিডিও দেখবেন, যত ব্রাউজিং করবেন তারা আপনার ব্যাপারে আরও বেশি জানবে, এই সুপারভিশনে আপনার ব্যাপারে তাদের অনুমান আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে। সুপারভিশনের ফলে তারা আগের থেকে আরও ভালো প্রেডিকশন করে আমরা কী করব, আমরা কী হতে পারি এসব নিয়ে।
স্যোশাল মিডিয়ার কোম্পানিগুলোর ক্রেতা হলেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতারা (Advertisers)। ইউজারদের পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর সর্বোচ্চ লাভ নিশ্চিত করা। এটি নতুন ধরণের বাজার, যে বাজারের অস্তিত্ব আগে কখনোই ছিলো না। এই বাজারে বিশেষভাবে ক্রয় বিক্রয় করা হয় হিউম্যান ফিউচার। ঠিক যেমন অন্যান্য মার্কেট প্লেস বা বাজারে ক্রয় বিক্রয় হয় পোর্ক বেলি ফিউচার। শুধু এটা বিক্রি করেই ইন্টারনেট বেজড কোম্পানিগুলো মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী সম্পদশালী কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
বেশিরভাগ মানুষের ভুল ধারণা ফেসবুক বুঝি আমাদের তথ্য অন্যের নিকট বিক্রি করে। তথ্যের উপরে ফেসবুকের কোন ব্যবসায়িক আকর্ষণ নেই। তারা তথ্য নিয়ে করবেটা কী? বরঞ্চ তারা মডেল বানিয়ে আমাদের একশনের অনুমান করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে যার মডেলের অনুমান সবচেয়ে বেশি মিলে যায়, সবচেয়ে বেশি নিখুঁত হয় সে-ই জয় লাভ করে। বিজ্ঞাপনদাতারাও তাদের নিকট টাকা ঢালে আরও বেশি পার্ফেক্ট প্রেডিক্টেড ইউজারের জন্য। বহু টেকনোলজি কোম্পানিগুলোর তিনটি গোল বা মূল উদ্দেশ্য থাকে। প্রথমত, ইউজারদের ইউসেজ অব্যাহত রাখা তারা যেন স্ক্রলিং করতেই থাকে। দ্বিতীয়ত, গ্রোথ গোলের মাধ্যমে আরও ইউজারদের বন্ধু বান্ধবদের ইনভাইট করে সাইটের এঙ্গেজ বৃদ্ধি করা, তারাও আরও বেশি ইনভাইটের মাধ্যমে এই ধারা অব্যহতা রাখে। এবং সবশেষে থাকে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য। ইউজাররা যা কিছু করছে তার মাধ্যমে বিজ্ঞাপনদাতাদের যতটা সম্ভব অর্থ আয় নিশ্চিত করা। গোলগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় এলগোরিদমের মাধ্যমে। এর কাজই হল আপনাকে যা দেখানো হবে তা যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতেই থাকে।
আপনি যে ছবি দেখেন, যে সাইট ভিজিট করেন, যে ভিডিও দেখেন সেই তথ্যগুলো সংগ্রহ করার মাধ্যমে আপনার কল্পিত মডেলটিকে আরও নিখুঁত বানায়। সেই মডেল দ্বারাই কোম্পানিগুলো অনুমান করতে পারে আপনি এখন কী করবেন, কোন ভিডিও দেখতে চাইবেন, কোন ছবি দেখতে চাইবেন, কোন সাইট ভিজিট করতে চাইবেন, কোন মিউচুয়াল ফ্রেন্ডকে পিপল ইউ মে নৌ-তে দেখালে আপনি আগ্রহী হবেন, কোন ধরণের আবেগে আপনি আপ্লুত হয়ে উঠবেন।
স্যোশাল মিডিয়ার কোম্পানিগুলো এমন একটা জগৎ তৈরি করেছে যেখানে অনলাইনে একজন অপরজনের সঙ্গে পরিচিত হয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। যখনই দুইজন ইউজার পরিচিত হয় তখনই এদের দুজনের পরিচিত হওয়ার পেছনে তৃতীয় আরেকজন অনাকাঙ্ক্ষিত নাক গলানো ব্যক্তি থাকে যার অর্থায়নে ঐ দুইজন ইউজার পরিচিত হতে পেরেছে। অর্থাৎ আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে এই মাত্র যে সুন্দরী নারী বা হ্যান্ডসাম পুরুষ যুক্ত হলেন তাকে আপনার ফ্রেন্ডলিস্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে টাকা ঢেলেছে তৃতীয় অন্য আর একজন। ইনি হতে পারেন কোনো এডভারটাইজার। অতএব, তারা এমন একটি গ্লোবাল জেনারেশন তৈরি করেছে যারা বড়ই হয়েছে এমন কনটেক্সটে যেখানে কমিউনিকেশন ও কালচারাল অর্থই হল মেনিপুলেশন।
তাহলে কোম্পানিগুলো তার ইউজারদের মেনিপুলেশন করে কীভাবে? বা এটা কাজ করে কীভাবে? ঠিক সেভাবেই কাজ করে যেভাবে নিউরোসায়েন্টিস্টরা করে, ম্যাজিশিয়ানরা বা জাদুকরেরা করে। সাইকোলজিক্যাল পারসুয়েডের মাধ্যমে। ডাক্তার, উকিল বা পাইলট অথবা যারা মিসাইল তৈরির মতো জটিল সব কাজ করে তারা নিজেরাই জানে না তাদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে। এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে চলে যা মানুষের মাঝেও প্রয়োগ করা সম্ভব। পারসুয়েসিভ টেকনোলজি ল্যাবগুলোয় এসবই শেখানো হয়। সাইকোলজির ব্যাপারে মানুষ যা কিছু জানে তার দ্বারা কীভাবে ইউজারদের প্ররোচিত করা যায় এবং প্রযুক্তিতে কাজে লাগানো যায়। সিলিকন ভ্যালির বহু প্রভাবশালী লোকজন প্রযুক্তিকে আরও বেশি পারসুয়েসিভ করতে ক্লাস ও ট্রেনিং করেছে যার মাধ্যমে ফেসবুক, উবার এবং অন্যান্য খ্যাতনামা কোম্পানির ইউজার ফিগার বৃদ্ধিতে অবদান রেখে যাচ্ছে।
পাসুয়েসিভ টেকনোলজি হলো প্রযুক্তির মাধ্যমে অন্যের বাহ্যিক আচরণে পরিবর্তন আনা। এই টেকনোলজির মাধ্যমে টেক জায়ান্টরা তার ইউজারদের দিয়ে পছন্দ সই কোন কিছু করিয়ে নেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফেসবুক তার ইউজারদের দ্বারা নিউজ ফিড স্ক্রলিং করিয়ে নেয়। প্রতিবার তারা স্ক্রল করতে করতে নিচে চলে গেলে আবার এক রিফ্রেশেই পুরো প্রসেসটা প্রথম থেকে শুরু করতে পারে। সাইকোলজির ভাষায় একে বলা হয় পজিটিভ ইন্টারমিটেন্ট রিইনফোর্সমেন্ট। ইউজাররা জানে না রিফ্রেশের পর তার নিউজ ফিডে কী আসবে। কোথায় গিয়ে থামবে এর কোন ধারণাই তাদের নেই। ঠিক যেমনটা লাস ভেগাসের জুয়ার স্লট মেশিনে দেখা যায়৷
ইউজাররা প্রোডাক্টটি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছে এটা যথেষ্ট না, ইউজারের মস্তিষ্কের গভীরে এটাকে স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেওয়া হয় যেন সেটা একটি অসচেতন অভ্যাসে পরিণত হয়। অর্থাৎ মনের গভীর থেকেই ইউজারের অজান্তেই প্রোগ্রামাইজ করা সেটা করার জন্য। প্রতিবার যখন ইউজার সেটা দেখে সে নিজেই বুঝতে পারে তাকে কী করতে হবে। মোবাইল ফোন হয়তো হাতের কাছে রাখা আছে, ইউজার মোবাইল ডেটা সচল করলেই সঙ্গে সঙ্গে কিছু না কিছু পাবে। তারা সেটাই করতে থাকে স্লট মেশিনের মতো এবং খুঁজতে থাকে তার জন্য কী রাখা আছে। এটা কোন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় ঘটছে না। এটাকে ঠিক স্বাভাবিক ক্রিয়ার মতো কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে৷
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ফটো ট্যাগিং এর কথাই ধরা যাক। নোটিফিকেশন বা ইমেইলের মাধ্যমে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে আপনার বন্ধু আপনাকে একটি ফটো ট্যাগ করেছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ইমেইলে ক্লিক করে ছবিটি দেখে নিবেন। আপনি দেখেও ইগ্নোর করে যাবেন এমন ঘটনা কদাচিৎ ঘটতে পারে তবে স্বাভাবিকভাবে আপনি ইমেইল চেক করবেনই। আপনি এখানে প্রশ্ন করতেই পারেন: ইমেইলের সঙ্গে ছবিটিও কেন দেখা যায় না তবে প্রসেসটা আরও সহজ ও কমে আসে তাই না? এটা করা হয় কারণ এর মাধ্যমে ফেসবুক বা মেইলের একটিভিটি আরও বৃদ্ধি পায়, গ্রোথ হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় গ্রোথ হ্যাকিং। ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দলই থাকে যাদের কাজ মানুষের সাইকোলজি হ্যাক করা। এটা করা হয় যেন তারা নিজেদের স্যোশাল সাইটের আরও বেশি গ্রোথ পায়, আরও বেশি ইউজার সাইনআপ করে, সাইটের এঙ্গেজমেন্ট বৃদ্ধি পায়। নতুন যারা আসবে তারাও আরও লোকজন ইনভাইট করে এই কার্যক্রম সক্রিয় রাখে।
সিলিকন ভ্যালিতে এমন অনেকেই আছেন যারা পারসুয়েসিভ টেকনোলজিতে ও গ্রোথ হ্যাকিংয়ে কিংবদন্তী চরিত্র। তাদের প্রণীত পদ্ধতি অনুসরণ করে স্যোশাল সাইটগুলোর গ্রোথ হয়েছে। তাদের একটি স্ট্যান্ডার্ড প্লেবুক রয়েছে যা অনুসরণ করা হয় টেকনোলজিকে দাঁড়া করাতে। তারা একেকজন একেক ধরণের টেস্টিং প্রণয়ণ করেন যা প্রয়োগ করা হয় স্যোশাল মিডিয়ায়। এমনই একটি স্মল ফিচার চেঞ্জের টেস্টিং হলো সায়েন্টিফিক এ/বি টেস্টিং। গুগল এবং ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো তার ইউজারদের উপরে এধরণের বহু ছোটখাটো এক্সপেরিমেন্ট অবিরাম করতেই থাকে। একটা সময়ে গিয়ে ইউজারদের নিয়ন্ত্রণ করতে এই ছোটখাটো এক্সপেরিমেন্টগুলোই একটা অপটিমাল পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়। ফেসবুকের এধরণের এক্সপেরিমেন্টগুলোকে Massive-scale contagion experiment বলে। আমরা যেভাবে ফেসবুকের পেইজের সাবমিনিমাল ক্যু ব্যবহার করি সেগুলো কাজে লাগিয়ে একটি রাজনৈতিক দল তাদের মিডটার্ম ইলেকশনে আরও বেশি ভোট পেতে পারে। ফেসবুক কতৃপক্ষ বুঝতে পেরেছে যে তারা এখন ফেসবুকের ইউজারদের না জানিয়েই বাস্তব পৃথিবীর ইমোশন ও বিহেভিয়ার বদলে দিতে পারে। এটাই মেনিপুলেশন। ইউজাররা এখানে এক একটি গিনিপিগ মাত্র। এসব গিনিপিগ দ্বারা ক্যান্সার চিকিৎসার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না ঠিকই কিন্তু তারা টেকনো জম্বি হয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকে। এবং টেকনো জায়ান্টদের উদ্দেশ্য হল এই টেকনো জম্বিদের আরও বেশি পরিমাণে তাদের বিজ্ঞাপন গেলানো যাতে বিজ্ঞাপনদাতাদের নিকট থেকে তারা আরও বেশি অর্থ উপার্যন করতে পারে।
কিন্তু পারসুয়েসিভ টেকনোলজির এলগোরিদম কারা নিয়ন্ত্রণ করে? এর উত্তর হল অতি সংক্ষেপ ও বিস্তারিত। AI বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এগুলো ইঞ্জিনিয়াররাই বানিয়েছে। বানিয়েছে অনেকটা প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট পদ্ধতিতে। তারা একটি সাবজেক্ট ধরে টান দিয়েছে এবং খেয়াল করে দেখেছে ঠিক কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া ঘটে। যেমন কোন মাকড়সার নার্ভ সেলে গুতো দিয়ে বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করে মাকড়সার ঠিক কোন ঠ্যাংটি নড়ে ওঠে এটি দেখার জন্য। তারা যেন মানুষকে ইউজার বানিয়ে রোপিং করে স্যোশাল মিডিয়ার ম্যাট্রিক্সে আটকে রেখেছে। আর ইউজারদের অজাতেই একটিভিটিকে কাজে লাগিয়ে মানি হার্ভেস্টিং বা টাকার চাষ করেছে। এভাবেই স্যোশাল মিডিয়া মানুষের মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা বানিয়েছে। ইনভেন্টর, ক্রিয়েটর সকলে মিলে এই কাজ সচেতনভাবেই করেছে।
ট্রিস্টেন হ্যারিস, গুগলের ফরমার ডিজাইন ইথিসিস্ট ও সেন্টার ফর হিউম্যান টেকনোলজি এর কো-ফাউন্ডার
ট্রিস্টন হ্যারিস বলেছেন, পণ্য যদি কোন যন্ত্র হয় বা বস্তু হয় তবে সেটিকে কোন না কোনভবে কাজে লাগানো যায়। যদি সেটি টুল বা যন্ত্র না হয় তবে বুঝতে হবে এটি আপনার থেকে কিছু চায়। এটি আপনাকে সিডিউস করছে, মেনিপুলেটিং করছে। আমরা যন্ত্র নির্ভর প্রযুক্তি থেকে এডিকশন ও মেনিপুলেটিং নির্ভর প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছি। এটাই পরিবর্তন হয়েছে। স্যোশাল মিডিয়া কোন টুল বা যন্ত্র না যে সেটিকে ব্যবহার করা যাবে। বরং এরই একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে, আর এটি মানুষকে তার সাইকোলজির বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়ে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে নিচ্ছে।
এটাও AI এর একটি কাজ। আজকের পৃথিবী চালিত করছে AI; গুগলের বিশাল সব রুম রয়েছে। কিছু হয়তো মাটির উপরে, কিছু মাটির নিচে, কিছু পানির নিচে। সেগুলো কম্পিউটারে ভর্তি। যত দূর চোখ যায় শুধু কম্পিউটারই দেখা যাবে। কম্পিউটারগুলো একটি অপরটির সঙ্গে সংযুক্ত এবং ভীষণ জটিল সব প্রোগ্রাম চালাচ্ছে। একই সঙ্গে তথ্যও আদান-প্রদান করছে। এগুলো বিভিন্ন ধরণের প্রোগ্রাম চালায়। কোনটা হয়তো সাধারণ এলগোরিদম দিয়েই বর্ণনা করা যায়, আবার কোনটা হয়তো এতটাই জটিল যে সেটাকে সেগুলোর নিজেস্ব ইন্টেলিজেন্সের ফসল বলা যায়।
এলগোরিদম কোন প্রকার অবজেক্টিভ না। একে সফলতার অপটিমাইজেশন বলা যায়। বিষয়টা হল কমার্সিয়াল কোম্পানি এলগোরিদম ডেভেলপই করে তাদের পণ্যের সফলতার জন্য। এটা সেই কোম্পানির কমার্সিয়াল ইন্টারেস্ট। তারা কম্পিউটারকে একটি গোল সেট করে দেয় যে, “আমি এত পরিমাণ আউটকাম চাই।” তখন কম্পিউটার নিজেই শিখতে থাকে সেই পরিমাণ আউটকাম এনে দিতে তাকে কী কী করা লাগবে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন “মেশিন লার্নিং।” তাই রোজ এটি সঠিক অর্ডার থেকে সঠিক পোস্টটা বাছাই করে করে নিয়ে উত্তরোত্তর আরও দক্ষ হয়ে উঠতে থাকে যেন ভোক্তারা আরও বেশি করে সেই পণ্য ব্যবহার করতে থাকে। প্রোগ্রামারের সেট করে দেওয়া গোল অর্জনের জন্য কম্পিউটার কী করছে এটা কেউ জানেও না। এলগোরিদমের নিজস্ব একটি মাইন্ড আছে। একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি সেটি পড়তেও পারেন। কেননা এটি লিখিত থাকে। সেই কোড দিয়েই মেশিন তৈরি করা হয় এবং মেশিন গোল অর্জনে নিজের প্রয়োজনে তা বদলেও নেয়।
ফেসবুক টুইটার ও অন্যান্য কোম্পানির মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি এটা বোঝে যে কীভাবে এই সিস্টেম কাজ করে। অবশ্য তাদের প্রয়োজনও নেই এর পুরোটা বোঝার বা জানার। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে মানুষ হিসেবে আমরা ইতোমধ্যে এই সিস্টেমের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। কারণ তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে সেই তথ্যের ভিত্তিতে যা আমরা তাদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। ফলে আমরা মেশিনকে যতটা নিয়ন্ত্রণ করছি মেশিনেরা তার থেকে বেশি আমাদেরই নিয়ন্ত্রণ করছে।
আপনি যখন ফেসবুক ব্রাউজ করেন তখন ধরে নেওয়া যায় আপনি ফেসবুকের AI এর সাথে খেলছেন। আপনার ব্যাপারে সে সব জানে, এটা আপনার পরবর্তী মুভ অনুমান করতে পারে অথচ আপনি এর ব্যাপারে কিছুই জানেন না। কিছু ক্যাট ভিডিও আর এর নির্মাণকারীর নাম ছাড়া। এটা তো কোন ন্যায্য লড়াইয়ের মাঝে পড়ে না।
ফেসবুকের মতো একটি সাইট যে কতটা ক্ষতি করে দিতে পারে এটা ভাবাটা খুব কষ্টকর কিছু না। উইকিপিডিয়ার কথা ধরা যাক। আপনি যখন উইকিপিডিয়ার পেইজে যান তখন সেটাই দেখেন যা অন্যেরা দেখে। এই পেইজের কিছু জিনিস সব সময় একই রকম থাকে। কখনোই ইউজার ভেদে বদলে যায় না। কিছু সময়ের জন্য ভাবুন, উইকিপিডিয়া বলল, “আমরা প্রতিটা মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন কাস্টোমাইজড পেইজ দিব।” এর জন্য লোকে পয়সা খরচ করতেও দ্বিধা করবে না। তখন উইকি এর ইউজারদের উপরে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করবে, সার্ভেল্যান্স শুরু করবে, ক্যালকুলেট করবে একজন নির্দিষ্ট ইউজারের কাছে কমার্শিয়াল লাভের জন্য তারা তাদের পেইজের কোন জিনিসটা সামান্য বদলে দিবে। তখন কী হবে ভাবতে পারেন? উইকিপিডিয়ার তথ্যের কী হাল হবে? অথচ এই জিনিসটাই ফেসবুকে ঘটছে। ইউটিউবে ঘটছে। তারা ব্যক্তিভেদে একই জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দেখায়। একেক শহরের নামে তারা একেক ধরণের অটোকমপ্লিট দেখায়। আপনি যদি লেখেন “Climate change” তবে অটো কমপ্লিট যেমন দেখাবেন “Climate change is hoax’, একই সঙ্গে আপনি দেখবেন “Climate change causing the destruction of nature.” অথচ দুটোর কোনটাই ক্লাইমেট চেঞ্জের ব্যাপারে সত্য না। কিন্তু গুগলিং করে আপনি এসবই পাচ্ছেন। গুগল নির্দিষ্ট বিষয়ে আপনার ইন্টারেস্ট জানে। আর সেভাবেই আপনাকে ব্যবহার করছে।
দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথাই ধরা যাক। যাদের একই ধরণের একই মেন্টালিটির আলাদা ফ্রেন্ড সার্কেল আছে। আপনি ভাবতে পারেন আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে যে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রয়েছে তারা নিউজ ফিড স্ক্রল করে যা দেখবে আপনিও সেটাই দেখবেন। আসলে তা দেখবেন না। ফেসবুকে কম্পিউটার হিসাব নিকাশের উপর ভিত্তি করে আপনাদের ভিন্ন ভিন্ন জগৎ গড়ে উঠেছে যা আপনাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে একদম পার্ফেক্ট।
ট্রুম্যান শো মুভিতে এটাই দেখানো হয়েছে। ট্রুম্যানকে ঘিরে প্রতিটা মানুষের আলাদা আলাদা বাস্তবতা গড়ে উঠেছে তাও আবার নিজেদের ফ্যাক্ট বিবেচনা করে। আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টের ব্যাপারে আপনার দীর্ঘদিন ভুল ধারণা থাকে যে সকলে আপনার সঙ্গে একমত। কারণ আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে যারা আছে তারা আপনারই মতো কথা বলে, আপনারই মতো ভাবছে। আপনি যদি কনস্পাইরেসি থিয়োরিস্ট হয়ে থাকেন তবে তারাও কনস্পাইরেসি থিয়োরিস্ট। আপনি যদি এথেইস্ট হয়ে থাকেন তবে তারাও এথেইস্ট, আপনি যদি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তবে তারাও বিশ্বাসী। আপনি যখন এটা ভাবতে শুরু করবেন বা এই পর্যায়ে পৌঁছে যাবেন তখন আপনাকে সহজেই মেনিপুলেট করা যাবে।
ঠিক একইভাবে আপনি জাদুকরদের দ্বারা মেনিপুলেটেড হোন। জাদুকরেরা তার ডেকের কার্ড থেকে একটি বেঁছে নিতে বলে আপনি সেটা বেঁছে নেন। অথচ পুরো ব্যাপারটাই সাজানো থাকে তা আপনি বুঝতেও পারেন না। আপনি সেই কার্ডটি পছন্দ করেন তারা আপনাকে দিয়ে যে কার্ডটি পছন্দ করাতে চায়। ফেসবুকও এভাবেই কাজ করে। আপনি বন্ধু পছন্দ করেন, নিউজ ফিড থেকে লিঙ্ক ফলো করেন। পুরোটাই জাদুকরের ভাঁওতাবাজির মতোই। নিউজ ফিডের নিয়ন্ত্রণ থাকে ফেসবুকের এলগোরিদমের হাতে। তারা ভিন্ন ভিন্ন ফ্যাক্টকে অপারেটিং করে মাত্র।
সেকারণে যেটা আপনার কাছে সত্য তা অন্যের কাছেও সত্য এটা ভাবার কোন কারণ নেই। একই জিনিসের ব্যাপারে দুইজন ভিন্ন ভিন্ন ইউজার ভিন্ন তথ্য পায়। লোকে ভাবে এলগোরিদম তাই করে যেটা তারা দেখতে চায়। আসলে সত্যটা হল এলগোরিদম ইউজারকে সেই র্যাবিট হোলেই ঢুকিয়ে দেয় যেটায় ইউজারের সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্ট থাকে, সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। একবার এলগোরিদমের সাজেস্টেড ভিডিও দেখা শুরু করলে এরপর থেকে বারবার সেটাই রেকমেন্ড করতে থাকে।
স্যোশাল মিডিয়া কীভাবে সাইকোলজি হ্যাক করছে এসবই ব্যাখ্যা করা হয়েছে স্যোশাল ডেলাইমায়। এর আরও উদাহরণ দেওয়া যাক। গুগলে আপনি যা সার্চ করেছেন অন্য কোন সাইটে প্রবেশ করলে সেই সার্চ সম্পর্কিত তথ্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জিনিসের বিজ্ঞাপন দিতে থাকবে। ধরা যাক আপনি একটি টিকিট কাটার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়েবসাইট ভিজিট করেছেন। এরপর ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যখন ফেসবুকে বা অন্য যেকোনো স্যোশাল সাইটে প্রবেশ করলেন তখনই বিভিন্ন ট্রাভেল ব্যাগ, সান স্ক্রিন লোশন, সানগ্লাস, মানিব্যাগ ওয়ালেট ইত্যাদি আনুষাঙ্গিক পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখতে শুরু করবেন। এটা সব ধরণের সাইটেই দেখা যায়। আপনি যখনই একটি কিউট বিড়ালের ভিডিও দেখবেন, পরক্ষণেই আপনার টাইমলাইন ভরে যাবে বিড়ালের বিভিন্ন ভিডিওতে। এটার পেছনে কাজ করে এলগোরিদম সেটা আগেই বলা হয়েছে। এই এলগোরিদম নিয়ন্ত্রণ করে ফিউচার টেকনোলজি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হয়তো সায়েন্স ফিকশন মুভিতে যেমনটা দেখা যায় তেমনটা না, মানুষকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ না করলেও মানুষের পছন্দ অপছন্দের অনুমান করতে সক্ষম। গুগলের সার্ভারের সুপার কম্পিউটার সার্ভেল্যান্সের কাজটা করে। ডকুমেন্টরিতে তারা এক পর্যায়ে উল্লেখ করেছে খোদ টেকনোরাই এটা বোঝেন না। বহু ইঞ্জিনিয়ার এই সেক্টরে কাজ করলেও তারা নিজেরাই এই টেকনোলজির ব্যাপারে সম্পূর্ন অবগত না। তাই এই সার্ভেল্যান্সের কাজটা পুরোপুরি যন্ত্রই করে থাকে। সেই যন্ত্রই নিয়ন্ত্রণ করছে ইউজারদের। কীভাবে? সেই উদাহরণটাই উপরে দেওয়া হয়েছে। যখনই আপনি নির্দিষ্ট ইমোশনের ভিডিও দেখছেন তখন সার্ভার জেনে ফেলে আপনি কোন বিষয়ের উপরে ইন্টারেস্ট, সার্ভার বুঝতে পারে ইউজার দুঃখী নাকি সুখী। তাকে আরও বেশি দুঃখের ভিডিও দেখালে তার দুঃখের ইমোশন ট্রিগার্ড হবে। এলগোরিদম অনবরত একই ধরণের ভিডিও ইউজারের কাছে পাঠাতে থাকে। যখনই আপনি গুগলে How to লিখেন তখনই গুগল কীওয়ার্ডস নিজে থেকেই আপনাকে অনেক অপশন প্রেফার করে। ইউজারকে বাকীটা লেখার প্রয়োজনই থাকে না। অর্থাৎ আপনার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে আর উক্ত ইউজার কী সার্চ দিতে পারে এটার একটা প্রিডেকশন গুগলের এলগোরিদম করে রেখছে। এভাবেই একটি জিনিস ভাইরাল হয়। কেননা যে ইউজার যে বিষয়ের প্রতি আগ্রহী না তার নিকট সেই ভিডিও পৌঁছানোর সম্ভাবনা অনেকাংশেই কম। যত বেশি ইউজার একই বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হবে সেই ভিডিও তত বেশি ভিউ হবে। বা সেই ভিডিও ঐ ধরণের, ঐ ক্যাটাগরির ইউজারদেরই সাজেস্ট করবে। এই বিষয়টিকেই ইমোশনাল ট্রিগার বলে উল্লেখ করেছে স্যোশাল ডেলাইমা ডকুমেন্টারি।
ইউজারদের ইমোশন হ্যাক করা হয় ডেটার মাধ্যমে। স্যোশাল মিডিয়া জানে কোন জিনিস ইউজারকে দুঃখী করবে, কোন জিনিস ইউজারকে আনন্দিত করবে। একজন দুঃখী মানুষকে সুঃখী বানানো গুগল বা ফেসবুক এলগোরিদমের কাজ না। বরং একজন দুঃখী মানুষকে কন্টিনিউয়াসলি দুঃখী করে রাখাতেই তাদের নির্দিষ্ট ধরণের ভিডিওর ওয়াচ বৃদ্ধিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তারা দুঃখী ভিডিওর খাদক। ওরা এভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইউজারদের মস্তিষ্ক। তাদের পছন্দ অনুযায়ী আপনাকে বানিয়ে নিতে পারবে। একারণেই মর্ডান ওয়ার্ল্ড এতটা ডিপ্রেসড। ডিপ্রেশনই হালের ক্রেজ। ২০০৯ এর পর একটি রিপোর্টে দেখা গেছে সুইসাইডাল রেট দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে টিনএজারদের মাঝে। এদের মাঝে স্যোশাল ইন্টারাকশন কম, বাইরে গিয়ে লোকের সঙ্গে মেশার দক্ষতা কম একারণে সামাজিক ভাবে তারা মূলত একা। গবেষকরা বলেন স্যোশাল মিডিয়া হল একটি মাদক। মানুষের একটি নির্দিষ্ট বেসিক বায়োলজিক্যাল ইম্প্যারেটিভ রয়েছে তা দিয়ে মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে। এই সরাসরি যোগাযোগের ফলে মানুষের শরীরে ডোপামিন নিসৃত হয়। মানুষের শরীরে এই সিস্টেম গড়ে উঠেছে লক্ষ কোটি বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে৷ এই সিস্টেমের কারণেই আমরা একত্রিত হই, সমাজের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি, সঙ্গি খুঁজি, আমাদের প্রজন্মের বৃদ্ধিতে অবদান রাখি। তাই এটা বলতে কোন বাঁধা নেই যে স্যোশাল মিডিয়ার মতো রেলগাড়ী মানুষের মাঝের এই কানেকশনকে অপটিমাইজ করছে সম্ভব্য নেশার জন্য।
কারও সুন্দর হাসি খুশি ট্যুরের ছবি দেখলে ডিপ্রেসড ইউজাররা বিচলিত হয়ে ওঠে। সেই কাঙ্ক্ষিত ইমেজে নিজেকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যায়। আর স্যোশাল মিডিয়ার এলগোরিদমের ফলে সে যত বেশি এসব ছবি দেখবে তত বেশি এসব ছবির সঙ্গে এঙ্গেজ হয়ে যাবে। এলগোরিদম জানে তার ইমোশনাল ট্রিগার্ড পয়েন্ট কোনটা। এলগোরিদম নতুন নতুন ইমেজ বার বার প্রদর্শনের মাধ্যমে নতুন মেমোরি তাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করায়। ফলে এমন একটি জিনিসের প্রতি তারা ম্যানিপুলেট হয় যা তাদের নেই। মানুষের জেনেটিক ইতিহাস পুরোটাই তার ডিএনএ আরএনএতে সংরক্ষিত রয়েছে। এর থেকে টেকনোলজিস্টরা ডিএনএ টেকনোলজির ব্যাপারেও ভাবতে শুরু করেছেন। আগামী বিশ বছর পর হয়তো সেই ডিএনএ টেকনোলজিও মানুষ পেনড্রাইভের ভেতরে ঢুকিয়ে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। এবং পুরো জিনিসটা একারণেই মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঞ্জিনিয়াররা যে টেকনোলজি নিয়ে কাজ করছেন তারা নিজেরাই সেটা পুরোপুরি বোঝেন না।
যেকোনো একটি এপ থাকে যেটার পেছনে ইউজাররা পাগলের মত আকৃষ্ট হয়ে থাকে। সেটা হতে পারে হোয়াটসএপ, ফেসবুক মেসেঞ্জার, ইন্সটাগ্রাম বা টুইটার অথবা ইউটিউব। অনেকে এপের প্রতি এডিকশন না হলেও ফোনের প্রতি হতে পারে।
বেশ কয়েকবার বিগ ফোর জায়ান্টস অর্থাৎ ফেসবুক গুগল, টুইটার এমাজন/এপল এদের ডেকে জেরা করা হয়েছে ইউজার সার্ভেল্যান্স ও ডেটার মিসইউজের বিষয়ে।
ফেসবুকের থেকে কিছুক্ষণ দূরে থেকে দেখুন নিউজফিড থেকে অবিরাম নোটিফিকেশন আসতে থাকবে। যেন আপনি সেদিকে আকৃষ্ট হোন। এরপর আপনি নোটিফিকেশন চেক করার জন্য ফোনটা হাতে নিলেন মাঝখানে ত্রিশ থেকে ষাট মিনিট উধাও হয়ে যাবে। আপনাকে এক ধরণের খাঁচায় আটকে ফেলা হয়। খাঁচাটি হল স্যোশাল মিডিয়া। নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ব্যবহার না করলে যেকারও জন্য সমস্যা হতে পারে। আপনাকে খাঁচায় আটকে রাখার কাজটা কোন আজেবাজে প্রতারক চক্র করে না। এরা পৃথিবীর সেরা মেধাবী মস্তিষ্ক। তারা গুগল বানিয়েছে, ফেসবুক বানিয়েছে, টুইটার বানিয়েছে। তারা নিজেরাই বলেছে স্যোশাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ খুব বেশি জরুরি। তা না হলে মানুষ টেকনিক্যাল জম্বিতে পরিণত হবে, পরিণত হবে ল্যাব র্যাটে। যে ত্রিশ মিনিট ষাট মিনিট উধাও হয়ে যায় সেটা আপনার হিসাবেরও বাইরে। সেসময়ে মস্তিষ্ক পুরোটাই ব্ল্যাঙ্কে চলে যায়। এটাও একধরণের মস্তিষ্ক হ্যাকিং। ব্ল্যাঙ্ক মুহূর্তে ইউজারের সাথে যা যা ঘটে তা তাকে ডিপ্রেশনের দিকে ধাবিত করে।
পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি, এর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ স্যোশাল মিডিয়ার সাথে কানেক্টেড। মানুষ ফোন খুলে সবার প্রথমে জিমেইলে একাউন্ট খুলে ফেসবুকে একাউন্ট খুলে, এরপর সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী ইন্সটা, টুইটারও চলে আসে। কিছু কিছু এপ তো ইন্সটলও দিতে হয় না। সেসব প্রি ইন্সটলড থাকে। তারা আগে থেকেই জানে লোকে ফোন কিনলে এসব এপ ব্যবহার করবে। একাউন্ট খোলার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপন আসা শুরু করে। এডের উপরেও বিডিং হয়। ইউটিউবে এখন তো শুধু শুরুতেই না মাঝেও বিজ্ঞাপন আসে। ইউজার যখন একটা ভিডিওতে পুরোপুরিভাবে প্রবেশ করে তখনই এলগোরিদম বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে দেয়। একারণেই বলা হয়, Data is the new oil; আপনার তেলে আপনাকেই ভাজা হবে। আপনার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আপনাকেই নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
মানসিক সমস্যা ছাড়াও বহু মানুষের ঘুমের বিঘ্ন ঘটায় স্যোশাল মিডিয়া। মনোবিজ্ঞানীরা অনুরোধ করেন শোয়ার এক ঘণ্টা পূর্বে মোবাইল রেখে দিতে, ঘুম থেকে ওঠার পর নোটিফিকেশন চেক করতেও মানা করেন। অনেক সময় গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে লোকে অনলাইনে প্রবেশ করে বাকী রাত জেগেই কাটিয়ে দেয়। পারিবারিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। প্রতি ৫/১০ মিনিট পরপর আমরা ফোন চেক করি যেন আমরা মোবাইল ফোনের দাস হয়ে গেছি, এপসের দাস হয়ে গেছি। অনেকের কাছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই এক প্রকার বাস্তবতা হয়ে গেছে।
এসব তো গেলো ব্যক্তি পর্যায়ের ক্ষতি। এছাড়াও এর একটি ব্যপক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। স্যোশাল মিডিয়া পুরো সোসাইটিকে নষ্ট করছে। কীভাবে? ফেক নিউজের মাধ্যমে। ফেসবুক ইউনিভার্সিটি, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি এসব ফেক নিউজেরই ফসল। একটি হৃদয় ভঙ্গকারী রিপোর্ট সাম্প্রতি সামনে এসেছে। রিয়াল নিউজের চাইতে ফেক নিউজ ছয়গুণ বেশি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই এতটা বুদ্ধিমান না যে তারা পত্রিকা কিনে পড়তে পারে, বা কোনো ফ্যাক্ট চেক করে সত্য মিথ্যা যাচাই করতে পারে। ১% মানুষ যদি পড়ে তো বাকী ৯৯% লোক সেসব ছুঁয়েও দেখে না। গ্রামে বা পিছয়ে পড়া সমাজে ফেক নিউজ বেশি প্রভাব ফেলে। কনস্পাইরেসি থিয়োরিগুলো এলগোরিদমের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রেকমেন্ড হতে থাকে। সবাই ভাবে ফ্লাট আর্থ থিয়োরির মত আবর্জনা মুষ্টিমেয় কিছু বোকা মানুষ গ্রহণ করবে, কিন্তু এর এলগোরিদম বারবার ভিউ পেয়ে, এটেনশন পেয়ে ধীরে ধীরে আরও স্মার্ট হয়ে উঠে। ফলে কনস্পাইরেসি থিয়োরিস্টদের শক্তপোক্ত দল এখন দেখা যাচ্ছে। আপনি যে ফ্লাট আর্থ থিয়োরিকে আবর্জনা ভেবে ফেলে দিচ্ছেন কাল হয়তো তারা অন্য কোন ভুল তথ্য দিয়ে আপনাকেই কনভিন্স করে ফেলবে।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ফেসবুকে ফেক নিউজ পাথর শূন্যে ভাসছে, বা অমুক হিন্দু কোরান অবমাননা করেছে, ইসলাম অবমাননা করেছে সেটার সত্যটা যাচাই না করে কেউ কিছু করার আগেই দুই চারটি হিন্দু গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়। হটাৎ শোনা গেল ইউনোস্কো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণা করেছে। সত্যতা যাচাই করার আগে দুই চারটা জেলা শহরে বিজয় মিছিল ও খিচুড়ি পার্টি আয়োজন সম্পন্ন হয়ে যাবে। এমনও নিউজ হয় যা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায় না সেটা ভুয়া নাকি সত্য। লিঞ্চিং প্রবলেমও ঘটে ফেক নিউজের কারণেই। ভারতে গত বছর কয়েকটি মব লিঞ্চিং এর ঘটনা ঘটেছে ফেক নিউজের কারণে। পদ্মা সেতুতে বাচ্চারা কাটা মাথা লাগবে, এর জন্য ছেলে ধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। গণ পিটুনিতে নিহতের ঘটনাও ঘটেছে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে। ফেক নিউজ বয়ে এনেছে জেনোসাইড পর্যন্ত। আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জেনোসাইড ঘটেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ফেক নিউজকে কেন্দ্র করে। মিয়ানমারে ফোন ক্রয় করা হলে সেটায় ফেসবুক প্রি ইন্সটলড থাকে। দোকানদারই ফেসবুক একাউন্ট খুলে দেয়। সেখানকার সমাজে ফেসবুকের একটা আলাদা ডিম্যান্ড রয়েছে যেটা দেশের ভ্যালিড মিডিয়ারও নেই। এটা মার্ক জাকারবার্গের জন্য একটা ইতিবাচক দিক কেননা মিয়ানমার তার জন্য একটি মানি মেকিং মেশিন। ফেক নিউজকে কেন্দ্র করেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপরে নতুন করে হামলা শুরু হয়। পাশের দেশ ভারতে ফেক নিউজ সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান নেহরুকে মুসলমান বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এটা মানব মস্তিষ্ককে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলাফল হয়তো আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু বাটারফ্লাই ইফেক্ট হয়ে কিছুদিন পর আমাদের সমাজে ঠিকই ফিরে আসবে।
মানুষ এখন আগের তুলনায় বেশি রাগন্বিত থাকে, ইমোশনালি ট্রিগার্ড থাকে। মানুষ যত কম জানে তত বেশি কনফিডেন্ট হয়। ফেক নিউজ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এখানে হাইয়েস্ট বিডাররা জেতে। সেই বিডার যদি কোন রাজনৈতিক দলের হয় তবে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে দমন করছে প্রপাগান্ডার মাধ্যমে। এক দেশ আরেক দেশে আক্রমণ না চালিয়েই সহজে মেনিপুলেটিং করছে। বিডিং এর সবচেয়ে বড় ইম্প্যাক্ট পড়েছে আমেরিকায়, তাদের নির্বাচনে। সমস্যা শুধু আমেরিকায় না, সমগ্র বিশ্বে। রাজনীতিতে অনেক বড় বড় দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফ্রিডম নষ্ট হচ্ছে, কনস্পাইরেসি থিয়োরিস্টদের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে। ফেসবুক এনালিটিকার কন্ট্রোভার্সেরি অনেকেরই জানা। তাদের উপরে অভিযোগ আনা হয় তারা ইলেকশনকেও প্রভাবিত করে। পৃথিবীর বহু রাজনৈতিক দলের উপরে অভিযোগ রয়েছে স্যোশাল মিডিয়ায় অর্থ লগ্নি করার। ফেসবুক গুগল চাইলে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পোস্ট ইউজারদের অপেক্ষাকৃত বেশি দেখাতে পারে। ফলে সেই হিসাবে নির্বাচনও ম্যানিপুলেট হতে পারে। বর্তমানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প। স্বভাবতই জো বাইডেনের তুলনায় তার পাবলিসিটি ফেসবুক ইউজারদের সাথে বেশি এঙ্গেজ করবে। কীভাবে কাজ করে এর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুণ মাত্র একজন হিংসাত্মক কার্যকলাপে বিশ্বাস করে। একজন মানুষ চায় আমেরিকায় অভিবাসীদের প্রবেশ বন্ধ করতে পারলে আমেরিকা গতকালের থেকে আজকে একটু বেশি নিরাপদ হবে। আপনাকে কিছু করতে হবে না, ফেসবুক এলগোরিদমের মাধ্যিমে এমন আরও ১০০ জন ব্যক্তি খুঁজে বের করুন। ১০০ জন মানুষ অবিরাম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালাতেই থাকল। মানসিক ভাবে আমরা বড় লেখা সব সময় এড়িয়ে চলি। মানুষ এমন কিছু চায় যা তাকে অল্প সময়ে আনন্দিত করবে। এসব কিছু আমাদের ইমোশনকে সহজেই ট্রিগার্ড করে। পরিশেষে জন্ম নেয় ঘৃণা। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ১০ বছরের মাঝে পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রগুলো থেকে গণতন্ত্র বিলুপ্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের মতে আগামী ১০ বছরের মাঝে বহু দেশে মিয়ানমারের মতো গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে, বা কোন একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে টার্গেট করে গণহত্যা হতে পারে। এর দায় চলে যায় সম্পূর্ণরূপে স্যোশাল মিডিয়ার উপরে।
২০১০ সালে পৃথিবী আজকের মতো ছিল? ছিল না। আজ আমাদের ইমোশনকে হ্যাক করা হয়েছে, সাইকোলজিকে হ্যাক করা হয়েছে। আপনি যে ভিডিও দেখেছেন সেটাই দেখতে থাকবেন। আপনি হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখেছেন অবিরাম সেটাই দেখতে থাকবেন। এসব নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। এক সময় কোম্পানিগুলো দাস ব্যবসা করেছে, সেটাও ক্যাপিটালিজম ছিলো। সেই সমস্ত সরকারের সদিচ্ছায় সেসব বন্ধ হয়েছে। তেমন আধুনিক যুগে যে কোম্পানিগুলো সার্ভেল্যান্স ক্যাপিটালিজম করছে তাদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একজন ব্যক্তি কোন ভিডিও দেখবে এটা সে নির্ধারণ করবে। গুগল বা ফেসবুক এলগোরিদম না। একবার একজন ডিরেক্টরকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “আপনি এত মারদাঙ্গাওয়ালা ওয়েব সিরিজ বানাচ্ছেন এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তরুণ সমাজের উপরে পড়ে।” তিনি জবাব দেন, “আমি বানিয়েছি তাতে কী? রিমোট তো আপনার হাতে। আপনি বন্ধ করে দিন।” এধরণের তর্কগুলো হল কুতর্ক। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। ধরুণ আপনি কোনো রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন দেখলেন পাশেই মারামারি চলছে। ৯৯% পথচারী থেমে সেই মারামারি দেখছে। আমাদের সাইকোলজিই এমন যে আমরা দাঁড়িয়ে তা দেখবো। এখানে নিজের নিজের চরকায় তেল দেওয়ার মানুষ খুবই কম। এখানে যার হাতে দেখানোর চাবিটা থাকে তার উপরে নৈতিক দায়িত্ব থাকে সেটা না দেখানোর। একজনের ব্রেকআপ চলছে। সে খুবই দুঃখী। এমন সময় তাকে আরও দুঃখের ভিডিও দেখানো কারও নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। ভুক্তভোগী তো টেম্পোরারি এস্কেপিজমে আক্রান্ত। সে চাইলেও এর থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। ইমোশনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্যোশাল মিডিয়ার সাহায্য নেওয়া উচিৎ হবে না। তার বাহিরের পৃথিবীর সাথে আরও বেশি এঙ্গেজ হতে হবে। অপরদিকে যারা নিজেদের ধ্বংসের কোডিং লিখে দিয়েছে তাদেরও নিয়ন্ত্রণে আনা উচিৎ।
আপনার মতামত জানানঃ