মামুন আব্দুল্লাহ :: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে হেফাজতে ইসলাম ও অন্যান্য সমমনা ইসলামী সংঘটনগুলোর প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলো প্রমাণ করে বাংলাদেশে হিন্দু বিদ্বেষ কতটা ভয়াবহ। গরু জবাই, সাধারণ জনগণ ও হিন্দুদের বাড়ি ঘর মন্দিরে হামলা যদিও নৈমিত্তিক ঘটনা কিন্তু এটা ইঙ্গিত দেয় আরও সাংঘাতিক কিছুর। একথা স্পষ্ট যে হেফাজতের নেতাদের পদত্যাগ ও সরকার দলীয় ছাত্র নেতাদের পদত্যাগ আমাদের জানান দিচ্ছে যে হেফাজতে ইসলাম সরাসরি বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। খুব সম্ভবত আমরা দ্রুতই তাদের রাজনীতিতে দেখতে পাব।
শুধু প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ১০ জন হেফাজত কর্মীর মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু এর টার্গেট যে হিন্দু সংখ্যালঘুরা তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন ৫০ তম স্বাধীনতা দিবস পালনের জন্য। উপহার স্বরূপ এনেছিলেন কোভিড-১৯ এর ১২ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন যখন ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কোভিডের ভ্যাকসিন আর রপ্তানি করবে না। কিন্তু ইসলামী দলগুলো সাম্প্রদায়িক মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদে অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মাঝেই তা রক্তপাতে ও হিন্দুদের উপরে হামলার দিকে গড়ায়। মোদি চলে যাওয়ার পরও দলগুলো রাজপথ না ছেড়ে বরং আরও মারমুখো হয়ে ওঠে তাদের সদস্যদের মৃত্যুর কারণে।
সমগ্র পৃথিবীর প্রায় ২.২% মানুষ এই ছোট্ট দেশটিতে বাস করে। পুরো জনসংখ্যার ৯০% মুসলমান, ৮.৫% হিন্দু, ০.৮% বৌদ্ধ, ০.৪% খ্রিস্টান ও ০.১% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। বিগত ষাট দশকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমেছে আশংকাজনক হারে। ২২% হিন্দু থেকে তা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে ৮.৫ শতাংশে। ১১% হিন্দু কমেছে শুধু মাত্র স্বাধীনের সময় পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৭৪ থেকে ২০১১ পর্যন্ত হিন্দুদের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫%, অথচ এই সময়ের মাঝে কোন যুদ্ধ পরিস্থিতি সময় বাংলাদেশ কাটায়নি। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে তুরস্কের সংবাদ মাধ্যমও হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়া ও নির্যাতনের উপরে আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। TRT WORLD নামের একটি পত্রিকা “Do Hindus feel threatened in Bangladesh” নামে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছে গত ২৯ শে মার্চ।
বাংলাদেশের সরকার দলীয় প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবুল বারকাত এর মতে, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে। ড. বারকাত তার বই “Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with Vested Property” উল্লেখ করেছেন কীভাবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের টার্গেট করা হয়, কেন হিন্দুরা নিজেদের জমি-জায়গা বিক্রি করে অথবা ফেলে রেখে কিংবা দখল হওয়ার পর বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। হিন্দুরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কোথায় যায়? ভবিষ্যতে কোথায় যাবে?
সানডে গার্ডিয়ানের মতে, বর্তমানে হিন্দুদের উপরে যে বিদ্বেষ পোষণ করছে সমগ্র দেশের মুসলমানরা, এবং যে পরিমাণে হিন্দুরা বাংলাদেশ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে তাতে করে আগামী ৩০ বছরের মাঝে হিন্দু শূন্য রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সমস্ত হিন্দুদের কিন্তু হত্যা করা হবে না, তারা হয় পলাতক হবে নয়তো শরণার্থী। এক্ষেত্রে হিন্দুদের পালানোর মত একটি রাষ্ট্রই অবশিষ্ট রয়েছে। সেটা হ’ল ভারত। ২০১৮ সালে ভারতের বিএসএফ বা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স জানিয়েছিল বাংলাদেশী হিন্দুরা ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে। হেফাজত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার সাথে সাথে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের চলে যাওয়ার হার পর্যায়ক্রমে বাড়বে শুধু মাত্র নিরাপত্তা হীনতার কারণে। কিন্তু ভারতও ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দুদের জন্য কঠিন একটা স্থান হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক ভারতে সিটিজেনশিপ এমেনমেন্ড অ্যাক্টের মাধ্যমে নাগরিকত্ব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ এর পূর্বে ভারত আগত হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যারা ভারতে গিয়েছে তারা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন, কিন্তু এরপর যারা গেছেন তাদের নাগরিকত্ব পেতে বেশ ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এছাড়া ভারতও এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে হজম করতে পারবে এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশ। একজন শরণার্থীও যদি এই দেশ দুটিতে প্রবেশ করে তবে তার প্রতিক্রিয়া হয় অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। দেশ দুটির রিসোর্স কম, বাজেট কম, চাকরি কম, কর্মক্ষেত্র কম, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে স্থানের অভাব দেখা দেবে, এবং ভারতে দেখা দেবে পানির অভাব।
বাংলাদেশ শুধু মাত্র দুইটি দেশের সাথে সীমান্ত ভাগাভাগি করেছে; মায়ানমার ও ভারত। মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা খুবই কম। এছাড়া মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য নিজেই একটি যুদ্ধে আক্রান্ত প্রদেশ। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ আগে থেকেই ঝামেলা পোহাচ্ছে। তাহলে বলা যায় সংখ্যালঘু হিন্দুরা ভয় পেয়ে আর যাই হোক, অন্তত রাখাইনে যাবে না। ৯৯% হিন্দুরা আসলে পালিয়ে যাচ্ছে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে। বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারত সরকার অফিশিয়ালি এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না, কারণ এটা বাংলাদেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। পশ্চিম বঙ্গ সরকারের সাথে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের রেষারেষি এই বিষয়টিকে আরও জড় পদার্থে পরিণত করেছে। ভারতের কংগ্রেস ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দিচ্ছে তারা যেন এই ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনায় বসে। কিন্তু যতটা সহজ মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে আলোচনায় বসা মোদি সরকারের জন্য ততটা সহজ নয়। এটা আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় বিষয়ে সীমিত নেই, ধীরে ধীরে তা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হচ্ছে। আর একটি দেশের সংখ্যালঘু জনগণের উপরে হওয়া নিপীড়নকে শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে ধামাচাপা দেওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে মুখ বুজে থাকলে মানুষের মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হতে থাকবে, চাপ বাড়তে থাকবে, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অবনতি হতেই থাকবে। পৃথিবীর যেকোনো স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন হলে মালয়েশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান, পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতি সংঘ থেকে নিন্দার ঝড় ওঠে। কিন্তু ঘরের কোণায় সংখ্যালঘু নির্যাতনে সকলের মুখে কুলুপ এঁটে থাকার ভঙ্গি দেখে বরং সন্দেহ জাগে। সকলের নিশ্চুপ অবস্থান বাংলাদেশের হিন্দুদের দিনের পর দিন করছে আরও বেশি নিরাপত্তাহীন। এই নিরাপত্তা হীনতায় হিন্দুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
আপনার মতামত জানানঃ