এবার ভয়ংকর হয়ে উঠছে ডেঙ্গু। কিছু বুঝে উঠার আগেই আক্রান্তরা চলে যাচ্ছেন সংকটাপন্ন অবস্থায়। ঝুঁকিতে পড়ছে জীবন। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশিরভাগের মধ্যেই শক সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মস্তিষ্ক, কিডনী, হৃদপিন্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেন-থ্রি সেরোটাইপের কারণেই ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহতা। যা আগের মৌসুমগুলোতে খুব একট দেখা যায়নি।
২০ বছরে ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু
চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৫৯ জন। সংখ্যার দিক থেকে ২০০০ সালের পর ডেঙ্গুতে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এক লাখের বেশি মানুষ। মারা যান ১৪৮ জন।
এর আগে ২০০১ সালে ৪৪ ও ২০০২ সালে ৫৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অন্যদিকে ২০০৭ সাল থেকে টানা চার বছর ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যু হয়নি।
তবে চলতি বছরের নয় মাসেই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে শনিবার বিকেলে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
চলতি মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৫ হাজার ছাড়ালো
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৩২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৮৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৫৯ জন। আর এই মাসে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১০৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১ হাজার ১৯৭ জন রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছে ৯৯০ জন, আর বাকি ২০৭ জন ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে। এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫ হাজার ৪৬০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং ছাড়া পেয়েছেন ১৪ হাজার ২০৪ জন।
এবার কেন ডেঙ্গু ভয়ংকর
২০১৯ সালে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিলো ডেঙ্গু। সেবার সংক্রমণ বেশি ছিলো কিন্তু জটিলতা কম। সলিমুল্লাহ মেডিক্যালের রেজিস্টার ইউসুফ আলী জানালেন, এবার হয়েছে উল্টোটা। বেশিরভাগ ডেঙ্গু আক্রান্তই সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যাচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে জটিলতা আরও বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের মধ্যে এবার ডেন-থ্রি সেরোটাইপের প্রভাব বেশি। কেউ যদি আগে আগে অন্য কোনো সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়ে পরে নতুন সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে জটিলতা বেশি হয়।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব হলে রোগী অনেক বেশি ছিল। কিন্তু রোগীদের অবস্থা এত খারাপ হতো না, জটিল হতো না। কিন্তু এবারে চট করেই রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে, চিকিৎসা করার মতোও সময়টাও পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, অন্যান্য বারের তুলনায় এবার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়েছে ডেঙ্গুর। যেসব নির্দেশনা মেনে চিকিৎসা করা হতো সেসবে আনতে হচ্ছে পরিবর্তন। তাদের বিশ্লেষণ বলছে, এবারে ডেঙ্গু তার চরিত্র বদল করেছে, হয়ে উঠেছে ভয়ংকর ও মারাত্মক। এবারে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি এবং সময়ও পাওয়া যাচ্ছে অল্প। শুরুতেই একাধিক অঙ্গ (অর্গান) আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় ২০১৯ সালে। কিন্তু সেবার অন্তত পাঁচ থেকে ছয়দিনের আগে রোগীর অবস্থা জটিল হতো না। কিন্তু এবারে চট করেই রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এবারে আর এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বিরল নয়, বরং বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে ডেঙ্গুর এই ধরন নিয়ে।শিশুদের ক্ষেত্রে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম, অর্থাৎ লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডের জটিলতা তৈরি হতে সময় লাগছে না, দ্রুত রোগী শকে চলে যাচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে, বুকে-পেটে পানি জমছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব হলে রোগী অনেক বেশি ছিল। কিন্তু রোগীদের অবস্থা এত খারাপ হতো না, জটিল হতো না। কিন্তু এবারে চট করেই রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে, চিকিৎসা করার মতোও সময়টাও পাওয়া যাচ্ছে না।
চলতি বছরে ডেঙ্গুর সবচেয়ে ক্ষতিকর ধরনগুলোর একটি ডেনভি-৩ – এ বাংলাদেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলেছেন, ডেঙ্গুর এই ধরনের কারণে দ্রুত রোগীদের রক্তের কণিকা প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। সে কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে এ কারণেই চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি, দিনকে দিন রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এবছরের ডেঙ্গু রোগীরা দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই খুব খারাপ প্রেজেন্টেশন নিয়ে আসছে। যেমন পেটে-বুকে পানি চলে আসা, রক্তক্ষরণ হচ্ছে, অতিরিক্ত বমি হওয়া, লিভার-গলব্লাডার ইনভল্ভ হয়ে যাওয়ার কারণে রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালে যত ভর্তি রোগী রয়েছে, তার মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীরই এ অবস্থা জানিয়ে ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ২০১৯ সালে যেসব রোগীদের অবস্থা খারাপ হতো, আক্রান্ত হবার ষষ্ঠ বা সপ্তম দিনে তাদের অবস্থা খারাপ হতো। কিন্তু এবারে আক্রান্ত হবার দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনেই মধ্যেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে ২০১৯ আর ২০২১ এর মধ্যে ডেঙ্গুর পার্থক্য।
অন্যদিকে করোনা আক্রান্তদের সেবা দিতে গিয়ে দিশাহারা অবস্থায় রয়েছে দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতাল। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু রোগীদের অনেকেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেতে চায় না। অনেকেই নিজেদের মতো করে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও করোনা রোগী দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
যদিও এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর চিকিৎসাসেবা দিতে আলাদা প্রস্তুতি রয়েছে, তবে বিশেষজ্ঞরা ওই প্রস্তুতিকে পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন। সামনে যেমন ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে তেমনি করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির আশঙ্কাও রয়েছে। সে জন্য আগামী দিনগুলোতে দুই ধরনের রোগী নিয়ে হাসপাতালে আরো বেসামাল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু করোনাভাইরাস নয়, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও করোনার মতোই ডেঙ্গু নিয়ে অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এখন একই সঙ্গে অনেকের মধ্যে করোনা ও ডেঙ্গু দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের রোগী দ্রুত বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায়। বিশেষ করে শিশুদের জন্য ডেঙ্গু বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সে কারণে তাদের সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই হেলাফেলা করা যাবে না। উপসর্গ বোঝা মাত্রই করোনার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩১
আপনার মতামত জানানঃ