যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার নতুন নতুন বনাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে দাবানল। ইতোমধ্যে এই দাবানলে পুড়ে গেছে রেকর্ড পরিমাণ বনাঞ্চল। মার্কিন অঙ্গরাজ্যটির বনাঞ্চল এবং আগুন সুরক্ষা দফতরের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এই দাবানলে পুড়ে গেছে কুড়ি লাখ একরের বেশি এলাকার বনভূমি। কর্মকর্তারা বলছেন, এল ডোরাদোতে এক পার্টি থেকে শুরু হওয়া একটি দাবানলে এক স্থানেই পুড়ে গেছে সাত হাজার একরের বেশি জায়গা। বর্তমানে রেকর্ড তাপপ্রবাহের মুখে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া।
ক্যালিফোর্নিয়ায় বিখ্যাত বন সিকোইয়া পর্যন্ত ছড়িয়েছে দাবানল। সিকোইয়া জাতীয় বনে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাছগুলো। এই আগুন নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে গাছগুলো পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ। খবর বিবিসির।
এদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত সিকোইয়া ন্যাশনাল পার্কের জ্বলতে থাকা প্রাচীন শেরম্যান গাছসহ অন্যান্য সব বড় গাছের চারপাশে আগুন-প্রতিরোধী কম্বল মোড়ানোর কাজ করছে দমকলকর্মীরা।
এই বনে প্রায় দুই হাজার সিকোইয়াসহ সাধারন শেরম্যান গাছ রয়েছে। শেরম্যান গাছের একেকটির উচ্চতা প্রায় ২৭৫ ফুট এবং সেগুলো প্রায় দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৭০০ বছরের পুরোনো গাছ।
সিকোইয়া এবং কিংস ন্যাশনাল পার্কের মুখপাত্র রেবেকা পিটারসন লস অ্যানজেলস টাইমসকে বলেন, ‘এই বন মানুষের কাছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এই বন রক্ষায় সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিকোইয়া গাছগুলি খুব আগুন প্রতিরোধী এবং আগুন থেকে বাঁচতে এর আলাদা ক্ষমতা রয়েছে। কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে শিগগিরি বিখ্যাত এই বন ধ্বংস হবে।
বনের প্রাচীন গাছগুলোকে রক্ষায় কাজ করছে সাড়ে তিনশ দমকলকর্মী। তবে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকায় আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। বনটিতে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা কিছু গাছ রয়েছে।
চলতি বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলে ৩২ লাখ একর বন পুড়ে গেছে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ বছর দেশটিতে ১০ হাজার কোটি ডলার ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে চলা ও খরা পরিস্থিতির কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে দেশটিতে। প্রতি বছরই আগের চেয়ে বেশি শুষ্ক ও গরম আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে সেখানে, যার ফলে বাড়ছে দাবানলের সংখ্যাও।
ওরেগন, ওয়াশিংটন আর ক্যালিফোর্নিয়া— আমেরিকার পশ্চিম অংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলই এখন ভয়াবহ দাবানলের কবলে। গত মাস থেকে পুড়ে খাক হয়ে গেছে প্রচুর সম্পত্তি। প্রায় অর্ধ কোটি একর এলাকা পুড়ে যাবার পাশাপাশি ১৫ সেপ্টেমবর পর্যন্ত দাবানলের শিকার হয়ে মারা গেছেন মোট ৩৬ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর এসেছে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে। ওয়াশিংটনে মারা গেছেন একজন। বাকি সব মৃত্যুই ওরেগনের। বাড়ি থেকে শেষ মুহূর্তে বেরোতে না পেরেই পুড়ে মারা গিয়েছেন অনেকে। কিন্তু মৃত্যুর থেকেও প্রশাসনকে এখন বেশি ভাবাচ্ছে নিখোঁজের সংখ্যা। ওরেগনেই এখনও পর্যন্ত খোঁজ নেই বহু বাসিন্দার। ফলে মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য বলছে, ওরেগন ও ওয়াশিংটনে দাবানলে ১৫ লাখ একরেরও বেশি এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ওরিগনে ৩০টির মতো দাবানলে ৯ লাখ ৩০ হাজারের বেশি একর বনভূমি পুড়েছে। বছরের হিসেবে গত ১ জানুয়ারি থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ৪১ হাজার ৫১টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪৭ লাখ একর এলাকা পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। ২০১৯ সাল জুড়ে ৩৫ হাজার ৩৮৬টি দাবানলে ৪২ লাখ একর ভূমি পুড়েছিল। সে হিসেবে চলতি বছর পূর্বের রেকর্ড ভেঙে দাবানল তার আগ্রাসী রূপ আরো বিস্তার করছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় গত মাসে শুরু হওয়া দাবানল এরইমধ্যে ৩২ লাখ একর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায় ৪ হাজার অবকাঠামো। ওরেগন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ১৬টি বড় দাবানলের সঙ্গে লড়াই করছে। সেখানকার ৪০ হাজার মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় জরুরি ব্যবস্থাপনা দফতর (ওইএম) জানিয়েছে, দাবানলে সেখানে এ পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন রাজ্যটির কর্মকর্তারা।
ওরিগনের গভর্নর কেইট ব্রাউন বাসিন্দাদের দাবানল আক্রান্ত এলাকাগুলোর বাইরে চলে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। দাবানলের কারণে লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর কোনও কোনও এলাকায় লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। কেইট ব্রাউন বাসিন্দাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও লুটপাট ঠেকাতে ওরেগন ন্যাশনাল গার্ড ও ওরেগন রাজ্য পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ওয়াশিংটন রাজ্যে দমকলকর্মীরা ১৫টি বড় দাবানলের সঙ্গে লড়াই করছেন। এই সপ্তাহের শুরুতে আগুনে সেখানে এক বছর বয়সী একটি শিশু মারা গেছে। দমকলবাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ক্যালিফোর্নিয়ার আকাশে দু’দিন আগে যে কমলার আভা দেখা গিয়েছিল তার ফলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়েছে। এটি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করছে।
টানা ক’দিনের আগুনে বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না বহু মানুষ। ওরেগনের বিভিন্ন এলাকায় দরজায় মোটা তোয়ালে ভিজিয়ে রেখে ধোঁয়া আটকাতে হচ্ছে। আগুনের কালো ধোঁয়ায় রাজ্যের আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বেশ কিছু বিমান সংস্থা তাদের ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। স্যাটেলাইট ইমেজে প্রায় ২ হাজার মাইল জুড়ে ধোঁয়ার স্তর দেখা গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য বলছে, ওরেগন ও ওয়াশিংটনে দাবানলে ১৫ লাখ একরেরও বেশি এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ওরিগনে ৩০টির মতো দাবানলে ৯ লাখ ৩০ হাজারের বেশি একর বনভূমি পুড়েছে। বছরের হিসেবে গত ১ জানুয়ারি থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ৪১ হাজার ৫১টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪৭ লাখ একর এলাকা পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। ২০১৯ সাল জুড়ে ৩৫ হাজার ৩৮৬টি দাবানলে ৪২ লাখ একর ভূমি পুড়েছিল। সে হিসেবে চলতি বছর পূর্বের রেকর্ড ভেঙে দাবানল তার আগ্রাসী রূপ আরো বিস্তার করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কানাডাসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে দাবানল হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়তি তাপমাত্রাই দাবানলের ভয়াবহতার জন্য মূলত দায়ী বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে এখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হারিকেন, বন্যা, দাবানলসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, এখনই সময় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার। প্রস্তুতি না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে পরিণতি আরও খারাপ হবে বলেও সতর্ক করেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৬
আপনার মতামত জানানঃ