তীব্রতম খরার কবলে পড়েছে ইউরোপ। বাড়িঘর, কারখানা, কৃষক এবং মালামাল পরিবহনের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে এই খরা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই পরিস্হিতি ইউরোপের অর্থনীতিকে মারাত্মক ভঙ্গুর পরিস্হিতির দিকে নিয়ে যাবে। এমনকি পানির ঘাটতি ‘স্বাভাবিক এক পরিস্থিতি’ হয়ে উঠবে, এই জন্য সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।
জানা গেছে, ইউরোপের ৪৫ শতাংশ অঞ্চল জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকেই খরার সতর্কতার অধীনে ছিল। ১৫ শতাংশ অঞ্চলে ইতোমধ্যেই রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। ইউরোপীয় কমিশন একাধিক অঞ্চলে ‘সংকটজনক’ পরিস্থিতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
প্রচণ্ড উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে যুক্তরাজ্যের টেমস নদীর উৎস অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় শুকিয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, খরার কবলে পড়েছে যুক্তরাজ্য। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশটির প্রস্তুতিও নেই বলে মনে করছেন তারা।
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া দপ্তর বলেছে, গড় বৃষ্টির দিক থেকে চলতি বছরের জুলাই মাসটি ছিল ১৯৩৫ সালের পর সবচেয়ে শুষ্ক। এ সময়ে ২৩ দশমিক ১ মিলিমিটার গড় বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে। দেশের কিছু অংশে জুলাই মাসটি ছিল এযাবৎকালের সবচেয়ে শুষ্ক মাস।
তীব্রতম খরার কবলে পড়েছে ফ্রান্স। দেশটি ১৯৫৮ সালে রেকর্ড উষ্ণতার পর এমন খরা এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলো। ১০০ টিরও বেশি ফরাসি পৌরসভায় লাইনে পানির সরবরাহ নেই।
ট্রাক দ্বারা বিভিন্ন এলাকায় সীমিত পানি সরবরাহ করা হচ্ছে জানিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, আমাদের এই ধরনের পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হতে হবে। এটি এখন একটি বাধ্যবাধকতা বলা চলে।
একই অবস্থা জার্মানিতেও, সেখানে পানির মজুত সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। পানির জন্য ৪০ শতাংশ বর্ধিত খরচ করতে হচ্ছে তাদের। সেখানে বাষ্পীভবন সপ্তাহে দেড় শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে।
সরকারের মতে, এটি গত ৬০ সালের মধ্যে সবচেয়ে শুষ্ক পরিস্হিতি। দেশটি গত তিন মাস ধরে প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাতের অর্ধেকেরও কম পেয়েছে।
স্পেনও এমন সংকটের মুখে। দেশটিতে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানল দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ অঞ্চলে ব্যক্তিগতভাবে পানি সংগ্রহের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। সরকারিভাবে যা যোগান দেওয়া হচ্ছে তা জনগণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। ফলে ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়েছে লোকজন। কৃষকরা সেচের পানি না পাওয়ায় ফসল মারা যাচ্ছে। কিংবা ফলানো সম্ভব হচ্ছে না।
এই বছরটি ইতালির আবহাওয়াও রেকর্ড উষ্ণ হয়ে উঠবে। ইতালীয় আবহাওয়া সমিতির সভাপতি লুকা মেরকালি এই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, গত ২৩০ বছরের কোনো অনুরূপ তথ্যের সঙ্গে আমরা এই বছর যে খরা এবং তাপ অনুভব করছি তার সঙ্গে তুলনা হয় না। তীব্র খরায় ভুগছে যুক্তরাজ্যও। সেখানেও কৃষিকাজ মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে, সুইজারল্যান্ডে খরার কারণে দুগ্ধ শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফ্রাইবার্গ, জুরা এবং নিউচ্যাটেলের কর্তৃপক্ষকে উপত্যকার তৃণভূমি খুলতে হয়েছে যা সাধারণত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গোচারণে ব্যবহূত হয় না। কারণ পাহাড়ে ওপরে চারণভূমি খুব শুষ্ক থাকে।
দাবানলে দগ্ধ ইউরোপ
ফ্রান্সে ভয়ংকর তাপপ্রবাহ চলছে। সঙ্গে দেখা দিয়েছে স্মরণকালের ইতিহাসের নজিরবিহীন খরা। চলতি বছরে এটি চতুর্থ তাপপ্রবাহ। ন্যাশনাল ওয়েদার এজেন্সি মেটিও ফ্রান্স জানিয়েছে, দক্ষিণে শুরু হওয়া এই তাপপ্রবাহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। জুলাইয়ের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশেও।
বিবিসি জানিয়েছে, নতুন এই দাবানলে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৭ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল পুড়ে ছাই হয়েছে। ভয়ংকর আগুন নেভাতে দিনরাত কাজ করছে হাজারের বেশি অগ্নিনির্বাপণকর্মী। তবে তাদের চেষ্টার মধ্যেই অসংখ্য বাড়িঘরও পুড়েছে। এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ।
দমকল কর্মীরা বলছেন, বনের মরা পাতা আর ডালপালা শুকিয়ে একদম বারুদের মতো হয়ে আছে। সেই সঙ্গে আছে তীব্র বাতাস। এ কারণেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দাবানলে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি দুঃখপ্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে আগুনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ফায়ার ফাইটারদের আর দৃঢ় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ম্যাক্রোঁ দেশটির সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলের দাবানল ও এর ভয়াবহতা মোকাবিলায় অস্ট্রিয়া, জার্মানি, গ্রিস, পোল্যান্ড ও রোমানিয়া সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। ওইসব সহায়তা অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়া যাবে।
ইউরোপে এখন যে দাবদাহ চলছে, তা আরও নিয়মিত আর স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এ প্রবণতা চলবে অন্তত ২০৬০-এর দশক পর্যন্ত।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। পূর্ব ফ্রান্সের আল্পসের কাছে চার্টরুজ পর্বতমালায় দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। গরম আবহাওয়ার কারণে দমকলকর্মীরা দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না।
আরও বেশ কয়েকটি অঞ্চলে রেকর্ড তাপমাত্রার মুখোমুখি হয়েছেন বাসিন্দারা। আশঙ্কা করা হচ্ছে তাপপ্রবাহে সয়া, সূর্যমুখী ও ভুট্টার উৎপাদন কমে যেতে পারে। কারণ পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দিনের বেলায় সেচে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।
১০০টিরও বেশি পৌরসভা কলের মাধ্যমে পানীয় জল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ট্রাকে করে পানি সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়েছে। তাপশক্তি জায়ান্ট ইডিএফ কিছু পারমাণবিক কেন্দ্রে অস্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ চুল্লি ঠাণ্ডা করতে নদীর পানি ব্যবহার করা হচ্ছিল। ব্রিটেন, স্পেনেও ভয়াবহ দাবানল দেখা দিয়েছে। হাজার হাজার বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে গেছে। পানিবাহী বিমান এবং অগ্নিনির্বাপক বাহিনী শুকনো অরণ্যে আগুনের সঙ্গে লড়াই করতে হিমশিম খাচ্ছে।
স্পেনেও চলতি বছর দাবানল ও দাবদাহে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রা পুরো ইউরোপকে গ্রাস করেছে, পর্তুগাল থেকে বলকান পর্যন্ত দাবানল সৃষ্টি করেছে। গত জুলাই মাসে একাধিক দফায় তাপপ্রবাহে ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু এলাকা ভয়াবহ দাবানলের মুখে পড়ে।
জাতিসংঘের ভাষ্য, ইউরোপে এখন যে দাবদাহ চলছে, তা আরও নিয়মিত আর স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এ প্রবণতা চলবে অন্তত ২০৬০-এর দশক পর্যন্ত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, একসময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারগুলি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এখন এই সব অঞ্চলগুলোতেও ঝড়, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বা উষ্ণতার কোনো উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ নেই। জলবায়ুর রূপান্তর ও পরিবর্তনের প্রভাব বৈশ্বিক। আর সব গোলার্ধেই তার প্রভাব দৃশ্যমান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৬
আপনার মতামত জানানঃ