প্রচণ্ড দাবদাহে বিপর্যস্ত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মানুষের জনজীবন। সেখানে এখন যে দাবদাহ চলছে, তা আরও নিয়মিত আর স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এই প্রবণতা চলবে অন্তত ২০৬০-এর দশক পর্যন্ত। জাতিসংঘ গতকাল মঙ্গলবার এসব কথা জানিয়ে দাবদাহ নিয়ে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছে। খবর এএফপি
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বলছে, বায়ুমণ্ডলে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত করে, এমন দেশগুলোর জন্য বর্তমান তাপপ্রবাহটি একটি সতর্কসংকেত।
ডব্লিউএমওর প্রধান পেত্তেরি তালাস জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এটা (দাবদাহ) আরও বেশি স্বাভাবিক ও নিয়মিত হয়ে উঠবে এবং নেতিবাচক এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। অন্ততপক্ষে ২০৬০-এর দশক পর্যন্ত।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা তাপমাত্রার একের পর এক রেকর্ড ভাঙছি। ভবিষ্যতে এমন দাবদাহ স্বাভাবিক হতে যাচ্ছে। এমনকি এর চেয়ে আরও বেশি দাবদাহ দেখতে হতে পারে আমাদের।’
পেত্তেরি তালাস আরও বলেছেন, ‘কার্বন নিঃসরণ এখনো বাড়ছে। আমরা যদি কার্বন নিঃসরণকে একটা সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে না পারি, তাহলে ২০৬০-এর দশকে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকতে পারে। বিশেষ করে এশিয়ার বড় দেশগুলোকে তাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। কারণ, এসব দেশ বড় কার্বন নিঃসরণকারী।’
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে চলমান প্রচণ্ড দাবদাহ নিয়ে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সঙ্গে যৌথভাবে এই সংবাদ সম্মেলন করে ডব্লিউএমও।
ডব্লিউএইচওর স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক পরিচালক মারিয়া নেইরা বলেন, ইউরোপে ২০০৩ সালের দাবদাহে ৭০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
মারিয়া নেইরা বলেন, ‘আমাদের শরীরে তাপমাত্রা ঠিক রাখার যে সক্ষমতা, এই তাপ শরীরের সেই সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। এতে নানান রোগে আক্রান্ত হবে মানুষ।’
বিপন্ন গোটা পশ্চিম
ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে বয়ে যাওয়া তীব্র দাবদাহ এখন মহাদেশটির উত্তরাঞ্চলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন। সোমবার ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য অতি উষ্ণতাজনিত সতর্কতা জারি করে এবং স্পেনের উত্তরাঞ্চলে ৪৩ সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। মঙ্গলবার পশ্চিম ইউরোপের তাপমাত্রা আরো বাড়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। তীব্র তাপদাহের কারণে যুক্তরাজ্য রেকর্ডকৃত ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম দিন দেখার অপেক্ষায় আছে আর ফ্রান্সের কিছু অংশ ‘বিপর্যয়মূলক উষ্ণতার’ মুখোমুখি বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
ফ্রান্সের জাতীয় আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, দেশটির বেশ কয়েকটি অংশ তাদের সবচেয়ে উষ্ণতম দিনগুলো পার করছে এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নঁতে ৪২ সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে।
দেশটিতে দাবানলের কারণে গত কয়েক দিনে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং তাদের জন্য জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার থেকে ফ্রান্সের দক্ষিণপশ্চিমের পর্যটন অঞ্চল জিঁহন্দের প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর এলাকা দাবানলে পুড়ে গেছে, দমকল কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জিঁহন্দ অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট জ্যঁ লুক গ্লেজ এ সম্পর্কে বলেছেন, আমার কাছে এটিকে দানব মনে হচ্ছে, যেন একটি অক্টোপাস। এটি সামনে, পেছন উভয় দিক থেকে কেবল বাড়ছে আর বাড়ছে। তাপমাত্রা, বাতাস ও বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্প না থাকায় এমনটি হচ্ছে। এই দানবের বিরুদ্ধে লড়াই করা অত্যন্ত কঠিন।
সোমবার যুক্তরাজ্য অন্যতম একটি উষ্ণ দিন দেখেছে। এদিন ইংল্যান্ডের সাফেকে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ দশমিক ১ সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। মঙ্গলবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ সেলসিয়াস ছাড়াতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়।
প্রচণ্ড উত্তাপে লন্ডনের লুটন বিমানবন্দরের রানওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর বেশ কয়েকটি ফ্লাইট স্থগিত করতে হয়। এর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ট্রেন সূচি বাতিল হওয়ায় যাতায়াতে গুরুতর ব্যাঘাত ঘটে।
সোমবার নেদারল্যান্ডসে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। দেশটির দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ওয়েস্তদোর্পে তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ৬ সেলসিয়াসে উঠে। মঙ্গলবার তাপমাত্রা আরো বেড়ে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে সর্বোচ্চ ৩৯ সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।
এ দাবদাহের মধ্যে স্পেন ও পর্তুগালে এ পর্যন্ত ১ হাজার জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্তুগালে তাপমাত্রা ৪৭ সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়, যা জুলাইয়ের সর্বোচ্চ।
দেশটির জাতীয় আবহাওয়া দপ্তর আইপিএমএ দেশের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে সর্বোচ্চ অগ্নি সতর্কতা জারি করেছে। দাবানলের বিপদ থেকে বাঁচাতে উত্তরাঞ্চলীয় মুর্সা শহর থেকে ৩০০ বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দাবদাহ উত্তর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে বেলজিয়াম ও জার্মানি ৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখতে পারে। স্পেনে অন্তত ২০টি দাবানল নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় আছে। উত্তর দিকে পর্তুগাল সীমান্তের কাছাকাছি পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে।
বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমণ হ্রাসের উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
তীব্র গরমে কী হবে?
ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল এবং উত্তর আফ্রিকার এক বড় অংশ জুড়ে তাপপ্রবাহ চলছে। তীব্র্র দাবদাহের ফলে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস, মরক্কোসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে দাবানল যা সামাল দিতে দেশগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ব্রিটেনের ইতিহাসেও এতো গরম কখনো পড়েনি। এর ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি জরুরি সতর্কতা ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও বৃষ্টিপাতের অভাবে আবহাওয়া রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে যার ফলে গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ।
নজিরবিহীন এই তীব্র গরমের কারণে কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং আরো বহু মানুষ মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সবার স্বাস্থ্যের উপরেই এই গরমের প্রভাব পড়তে পারে, তবে কিছু কিছু মানুষের, বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের ঝুঁকি বেশি। তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের শরীরও গরম হয়ে যায়। এর ফলে রক্তনালীগুলো খুলে যায়। এর জের ধরে রক্ত চাপ কমে যায় যে কারণে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা হৃদপিণ্ডের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
এসব কারণে মৃদু কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে যার মধ্যে রয়েছে ত্বকে ফুসকুড়ি পড়া, চুলকানি এবং পা ফুলে যাওয়া যা রক্তনালী উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে হয়ে থাকে।
এছাড়াও প্রচুর ঘাম হওয়ার কারণে শরীরে তরল পদার্থ ও লবণের পরিমাণ কমে যায়, গুরুতর ক্ষেত্রে দেহে এ-দুটো জিনিসের মধ্যে যে ভারসাম্য আছে তাতেও পরিবর্তন ঘটে।
এসব কিছু একসাথে মিলিয়ে গরমে শরীর পরিশ্রান্ত হয়ে যেতে পারে এবং তার লক্ষণগুলো হচ্ছে মাথা চক্কর দেওয়া, বিবমিষা বা বমি বমি ভাব, নিস্তেজ হয়ে পড়া, মূর্ছা যাওয়া, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়া, পেশি সংকুচিত হওয়া, মাথা ব্যথা, প্রচণ্ড ঘাম হওয়া ও ক্লান্তি। আর রক্তচাপ খুব বেশি কমে গেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০৭
আপনার মতামত জানানঃ