রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে দুবাই। চব্বিশ ঘণ্টার বৃষ্টিতে সৃষ্ট এই বন্যার পর ‘ক্লাইড সিডিং’ বা প্রযুক্তির সাহায্যে কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানো সম্পর্কে নানা অনুমান ছড়িয়ে পড়েছে, যা এক ধরনের বিভ্রান্তিকর।
তবে অনুমান যেমন-ই হোক, দুবাইয়ের এই বৃষ্টিপাত ঠিক কতটা অস্বাভাবিক ছিল এবং এতো ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার পেছনে মূল কারণগুলো আসলে কী ছিল?
বৃষ্টিপাত কতটা ‘প্রবল’ ছিল?
মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপকূলীয় অঞ্চলে দুবাইয়ের অবস্থান। দুবাই সাধারণত খুব শুষ্ক থাকে। বছরে এখানে গড়ে ১০০ মিলিমিটারের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়। তবে মাঝে মাঝে দুবাইকে চরম বৃষ্টিপাতের সম্মুখীনও হতে হয়।
দুবাই থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরের শহর আল-আইন। সেখানে ২৪ ঘণ্টায় ২৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
আকাশে সঞ্চিত মেঘের চারপাশে একটি স্থির নিম্নচাপ তৈরি হয়। যার ফলে সেখানে উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস জমা হতে থাকে। সেখানে আবহাওয়ার অন্যান্য উপাদানগুলো আসেতে পারে না। আবহাওয়া বিজ্ঞানে এটিকে ‘কাট-অফ লো প্রেশার ওয়েদার সিস্টেম’ বলা হয়।
উপসাগরীয় অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের ধরণ নিয়ে পড়াশুনা করেছেন রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিদ অধ্যাপক মার্টেন অ্যাম্বাউম।
দুবাইয়ের এই বৃষ্টিপাত সম্বন্ধে তিনি বলেন, “পৃথিবীর এই অংশটি দীর্ঘসময় ধরে বৃষ্টিহীন থাকে, এটির বৈশিষ্ট্যই এমন। তবে এখানে অনিয়মিত ও ভারী বৃষ্টিপাত হয়। তারপরও এটি একটি খুব বিরল বৃষ্টিপাতের ঘটনা ছিল।”
ক্লাউড সিডিং ও বন্যা
ক্লাউড সিডিং হল এমন একটি প্রযুক্তিগত পদ্ধতি, যা আকাশে বিদ্যমান মেঘগুলোকে আরও বৃষ্টি তৈরির জন্য প্রভাবিত করে।
উড়োজাহাজের মাধ্যমে ক্লাউড সিডিং করা যেতে পারে। এটির জন্য উড়োজাহাজ দিয়ে সিলভার আয়োডাইডের ছোট ছোট কণা মেঘের মাঝে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর খুব সহজেই জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিতে পরিণত হয়।
গত কয়েক দশক ধরেই পৃথিবীব্যাপী এই কৌশলটি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের পানির সংকট মোকাবিলা করার জন্য ক্লাউড সিডিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছে ।
তবে দুবাইতে বন্যা শুরু হওয়ার পরের কয়েক ঘণ্টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা ওখানকার এই চরম আবহাওয়ার পেছনে শুধুমাত্র দেশটিতে চালানো সাম্প্রতিক ক্লাউড সিডিং অপারেশনকে ভুলভাবে দায়ী করছেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দেশটির দুবাইতে বন্যা শুরু হয়েছিল মঙ্গলবার। এদিকে এর আগে ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে দেশটিতে ক্লাউড সিডিং এর কাজে ব্যবহৃত বিমানগুলো মঙ্গলবার নয়, রোবার এবং সোমবার মোতায়েন করা হয়েছিল।
তবে কখন ক্লাউড সিডিং করা হয়েছিল, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি খুব বেশি হলে ঝড়ের উপর সামান্য প্রভাব ফেলতে পারে এবং বন্যার জন্য ক্লাউড সিডিংয়ের ওপর আলোকপাত করাটা ‘বিভ্রান্তিকর’।
সাধারণত বাতাসের আর্দ্রতা ও ধুলোবালি যদি বৃষ্টি ঝরাতে বাঁধা হয়, তখন ক্লাউড সিডিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু গত সপ্তাহেই উপসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে একটি তীব্র বন্যার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল আবহাওয়ার পূর্বাভাসে।
“যখন এই ধরনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়, তখন ক্লাউড সিডিং-এর মতো একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া প্রয়োগ হয় না। কারণ তখন এই ধরনের শক্তিশালী ব্যবস্থা প্রয়োগের কোনও প্রয়োজনই পড়ে না,” বলেছেন আবুধাবি’র খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভূ-পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডায়ানা ফ্রান্সিস।
বিবিসি ওয়েদার-এর আবহাওয়াবিদ ম্যাট টেইলরও বলেন যে দুবাইয়ের চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার বিষয়ে আগে থেকেই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। “এই ঘটনার আগে কম্পিউটার মডেলগুলো খুব ভালোভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে ২৪ ঘণ্টার মাঝে এক বছরের সমান বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
ম্যাট টেইলর বলেন, “আমি যদি শুধুমাত্র ক্লাউড সিডিং থেকে বৃষ্টির কথা হিসেব করি, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বন্যার প্রভাব অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল। বাহরাইন থেকে ওমান, এই বিশাল এলাকায় মারাত্মক বন্যা দেখা দেয়।”
অর্থাৎ, ক্লাউড সিডিং সংযুক্ত আরব আমিরাতে করা হলেও (যদি) স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা শুধুমাত্র ওই দেশটিতে হয় নি। বরং, তা বাহরাইন থেকে ওমান পর্যন্ত প্লাবিত হয়েছে।
আমিরাতি অঞ্চলে ক্লাউড সিডিং প্রক্রিয়া মিশন ন্যাশনাল সেন্টার অফ মেটিওরোলজি (এনসিএম) নামক একটি সরকারি টাস্ক ফোর্স দ্বারা পরিচালিত হয়।
আমিরাত কতটা প্রস্তুত ছিল?
ভারী বৃষ্টিপাত যেন প্রাণঘাতী বন্যায় পরিণত না হয়, সেজন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন।
অবকাঠামোগতভাবে দুবাই অবশ্যই উন্নত একটি শহর। কিন্তু সেখানে বাতসের আর্দ্রতা শুষে নেওয়ার জন্য সবুজ জায়গা খুব সামান্য এবং সেখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা এত প্রবল বৃষ্টিপাত সামাল দেওয়ার মতো শক্তিশালী বা উন্নত ছিল না।
অধ্যাপক ফ্রান্সিস বলেন, “এই নতুন বাস্তবতার [ঘন ঘন ও তীব্র বৃষ্টিপাতের] সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য যথাযথ কৌশল এবং অভিযোজন ব্যবস্থা থাকতে হবে।”
“উদাহরণস্বরূপ, সড়কের অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাকে বৃষ্টিপাতের উপযোগি করতে হবে, মৌসুমের বৃষ্টি থেকে পানি সঞ্চয় করার জন্য জলাধার তৈরি করতে হবে এবং বছরের অন্য সময়ে তা ব্যবহার করতে হবে।”
জানুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সড়ক ও পরিবহন কর্তৃপক্ষ দুবাইতে বন্যা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একটি নতুন ইউনিট গঠন করেছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা আছে ?
দুবাইতে এমন বৃষ্টিপাত হওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন কতটা ভূমিকা পালন করেছে, তা সঠিকভাবে পরিমাপ করা এখনও সম্ভব নয়।
সুনির্দিষ্ট করে বলার জন্য প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণগুলোর একটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যা করতে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।
কিন্তু যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, তার সঙ্গে এই বৃষ্টিপাত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সহজভাবে বললে, সাধারণত উষ্ণ বাতাস বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে। প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অতিরিক্ত প্রায় সাত শতাংশ বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখে, যা বৃষ্টির তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানের অধ্যাপক রিচার্ড অ্যালান ব্যাখ্যা করেছেন, “বৃষ্টির তীব্রতা রেকর্ড ভেঙেছে। কিন্তু জলবায়ুর উষ্ণতার সাথে এর সম্পর্ক আছে। কারণ এ ধরনের বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে, যা ঝড় তৈরিতে ও ভারী বৃষ্টিপাতের মতো ঘটনা ঘটায় এবং এর ফলে সৃষ্ট বন্যা ক্রমশ আরও শক্তিশালী হয়।”
সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেশিরভাগ বর্তমানের চেয়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
“মানুষ যদি তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে থাকে, তাহলে জলবায়ু উষ্ণ হতে থাকবে, বৃষ্টিপাত বাড়তে থাকবে এবং বন্যায় মানুষ প্রাণ হারাতে থাকবে,” বলেছেন ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জলবায়ু বিজ্ঞানের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. ফ্রেডেরিক ওটো।
আপনার মতামত জানানঃ