যাদের হাতে টাকা আছে তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, সর্বশেষ উদ্ভাবন, চিকিৎসাসেবা, ওষুধ-পথ্য থেকে শুরু করে সুখের যাবতীয় উপকরণ কিনে নেন। ভোগ করেন। আর যাদের টাকা নেই, তারা কেবল বঞ্চিত হন, দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। করোনার টিকা নিয়েও দুনিয়ায় একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ধনী দেশগুলো বেশির ভাগ টিকা আগাম টাকা দিয়ে কিনে কুক্ষিগত করেছে। পক্ষান্তরে গরিব দেশগুলো এখন টাকা দিয়েও টিকা পাচ্ছে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, এই বছরের শেষ নাগাদ ধনী দেশগুলোর কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টিকা থাকবে প্রায় ১২০ কোটি ডোজ। এসব টিকা দরিদ্র দেশগুলোতে অনুদান দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই। খবর আল জাজিরা
আন্তর্জাতিক তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা এয়ারফিনিটির সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদেন আরও বলা হয়েছে, চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও জাপানে টিকার ডোজের মজুত পৌঁছেছে ৫০ কোটিতে, যার মধ্যে ৩৬ কোটি ডোজের ভবিষ্যৎ কী হবে— তা এখনও অনিশ্চিত। অর্থাৎ, এই ডোজগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং এগুলো দান করা হবে কি না সে ব্যাপারে এসব দেশ ও জাতিসংঘ এখনও কোনো পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত নেয়নি।
সেই হিসেবে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ এই দেশগুলোর টিকার ডোজের মোট মজুতের পরিমান পৌঁছাবে ১৬০ কোটি ডোজে এবং এর মধ্যে অতিরিক্ত ডোজের পরিমাণ থাকবে ১২০ কোটি।
চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও জাপানে টিকার ডোজের মজুত পৌঁছেছে ৫০ কোটিতে, যার মধ্যে ৩৬ কোটি ডোজের ভবিষ্যৎ কী হবে— তা এখনও অনিশ্চিত। অর্থাৎ, এই ডোজগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং এগুলো দান করা হবে কি না সে ব্যাপারে এসব দেশ ও জাতিসংঘ এখনও কোনো পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বিশ্বের বহু প্রখ্যাত স্বাস্থ্য সংস্থা এবং কর্মকর্তা বিশ্ব জুড়ে টিকা বৈষম্য নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এই বৈষম্য নিরসনে জাতিসংঘের উদ্যোগে টিকা বন্টন উদ্যোগ কোভ্যাক্স যাত্রা করে। প্রাথমিকভাবে এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিলো এই বছরের শেষ নাগাদ ১৯০টি দেশে দুইশ’ কোটির বেশি ডোজ টিকা সরবরাহ। এর মাধ্যমে বিশ্বের অন্তত ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা প্রাপ্তির লক্ষ্য ছিলো তাদের।
তবে ধনী দেশগুলো নিজেরাই টিকা উৎপাদকদের সঙ্গে চুক্তি করতে থাকায় কোভ্যাক্স টিকা কম পায়। এরপর ধনী দেশগুলো টিকা মজুদও শুরু করে।
জি২০ গ্রুপের স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের এক বৈঠকে রবিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক টেড্রোস আডানোম গেব্রিয়াসিস বলেন, বিশ্বজুড়ে টিকা বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বজুড়ে পাঁচশ’ কোটির বেশি ডোজ টিকা প্রয়োগ জানিয়ে তিনি বলেন, এর ৭৫ শতাংশই প্রয়োগ হয়েছে মাত্র ১০টি দেশে। আফ্রিকায় মাত্র দুই শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
আফ্রিকা মহাদেশভিত্তিক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা আফ্রিকা সিডিসির (আফ্রিকা সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল) প্রধান নির্বাহী জন এনকেনগাসং সম্প্রতি বলেছেন, মহাদেশে টিকাদান কর্মসূচির চিত্র খুবই হতাশাজনক।
উন্নত দেশগুলোর অতি মাত্রায় টিকার ডোজ মজুতের সমালোচনা করেছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনও। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত টিকার ডোজ মজুতের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো আদর্শিক বিচ্যুতির চরম সীমায় পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে এখন পৃথিবীতে একটি নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদ জন্ম নিচ্ছে ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’। যেখানে ধনী দেশেরা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু যদি পৃথিবীর সব দেশে টিকাকরণ প্রক্রিয়া ঠিকমতো না হয় তাহলে এই মহামারী আরও অনেক বছর প্রলম্বিত হতে পারে। বিশ্বনেতৃত্বের এখন সময় এসেছে টিকা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্যের জগতে সবার সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করার, যা অবশ্যই সবার কাছে সুলভ হবে এবং সবার কাছে পৌঁছাবে। যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা ‘ক্রিটিক্যাল মাস’-এর কাছে টিকা পৌঁছানোর এই কাজটি সফলভাবে করা যায় তাহলে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের শরীরে কৃত্রিমভাবে ইমিউনিটি তৈরি করা যাবে, যেমনটা স্মল পক্স বা পোলিওর ক্ষেত্রে হয়েছে। এর পরিণতিতে এই রোগটির বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি বা গোষ্ঠী অনাক্রমণ্যতা গড়ে উঠবে এবং রোগটি আপাতত নিস্তেজ অবস্থায় চলে যাবে (যদিও এর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা আবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে কখন পরিস্থিতি বুঝে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধা যায়)।
তারা বলেন, এ কথা ঠিক যে, করোনার টিকা সবার জন্য সহজলভ্য করার কাজটি রাতারাতি হবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যাদের সামর্থ্য আছে তারাই শুধু এই টিকা পাবে। এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে মনে রাখতে হবে যে, যেসব জায়গায় এই টিকা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেখানে যদি এটা না দেওয়া যায়, তাহলে এই মহামারী চলতেই থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত তারাও নিরাপদ থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩১
আপনার মতামত জানানঃ