আফগানিস্তানের গণমাধ্যম বিষয়ে তালিবান নিশ্চয়তা দিলেও অনেক সাংবাদিক শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। প্রতিদিন যে হাজার হাজার মানুষ দেশটি ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যে সাংবাদিকেরাও রয়েছেন। অনেকেই বলছেন, তাদের জীবন এখন হুমকিতে। এক দিকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে দোলাচল, মহিলা সাংবাদিকদের উপরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা এবং নামী সাংবাদিকদের দেশ ছাড়ার হিড়িক, অন্য দিকে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত দেশের সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিয়ো স্টেশন।
এর আগে তালিবান বাহিনীর শাসনের সময় দেশটিতে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধই ছিল বলা চলে। এরপর মার্কিন অভিযানে তালিবানের পতন হওয়ার পর গণমাধ্যম খাতে অগ্রগতি শুরু হয়। এখন আবার ফিরে এসেছে তালিবান শাসন। তাই ভীতিমুক্ত হতে পারছেন না দেশটির সাংবাদিকেরা।
টোলো নিউজ়ের ডিরেক্টর লোতফুল্লা নজফিজ়াদা বলেছেন, ‘কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছি। কাজ চলবে না কি বন্ধ রাখা হবে, বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার চ্যানেল চালু রাখতে সেই সব নিয়ে ভাবনার অবকাশ নেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, দম ফেলার সুযোগ মিলছে না’।
তিনি জানিয়েছেন, ‘সংবাদ পরিবেশনের বাধ্যবাধকতা থেকে এখনও চ্যানেল বন্ধ রাখা হয়নি’।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান শাসনে গণমাধ্যম বলতে কিছু ছিল না। বাহিনীটি টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যমকে ইসলামি মতাদর্শের বিরোধী বলে গণ্য করত। এমনকি সে সময় কিছু কিছু বৈদ্যুতিক পণ্যও অনৈসলামিক হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
কেউ টেলিভিশন দেখলে তাকে শাস্তি দেওয়া হতো এবং টিভিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়া হতো। ভিডিও প্লেয়ারের মালিককে গণপিটুনি দেওয়া হতো।
ক্যাসেট ধ্বংস করে এর ফিতা কাবুলের কিছু কিছু এলাকার গাছে ঝুলতে দেখা গেছে। তখন শুধু একটিই রেডিও স্টেশন ছিল। নাম ভয়েস অব শরিয়া। এটি শুধু প্রপাগান্ডা ও ইসলামিক অনুষ্ঠান প্রচার করত।
২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তালিবান উৎখাত হলে দেশটির গণমাধ্যম খাতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। সে সময় অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও নেটওয়ার্ক আসে। শুধু যে সংবাদের চ্যানেল তা নয়, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রতিভা খোঁজে বের করার অনুষ্ঠান ও মিউজিক ভিডিও তৈরি হয় প্রচুর।
ন্যাশনাল প্রেস ফেডারেশনের কথা উল্লেখ করে চলতি মাসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানায়, আফগানিস্তানে এখন ৫০টি বেশি টেলিভিশন চ্যানেল, ১৬৫টি রেডিও স্টেশন ও কয়েক ডজন প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল গণমাধ্যমে মেয়েদের কাজ করার সুযোগ দান। যেখানে তালিবানের শাসনকালে নারীদের পরিবারের বাইরে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে তালিবান পরবর্তী সময়ে শত শত নারী সাংবাদিকতা, প্রডিউসার, আয়োজক ও পারফর্মার হিসেবে পর্দার সামনে ও পেছনে কাজ করে গেছেন। এমনকি ডজন ডজন সাংবাদিক বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন।
তবে এবারে মসনদ দখলের পরে অবশ্য নিজেদের অন্য রূপ প্রতিষ্ঠা করতেই মরিয়া হিবাতুল্লা আখুন্দজ়াদারা। ইতিমধ্যেই তালিবান নেতৃত্ব জানিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই কাজ করতে পারবে সংবাদমাধ্যম। তাদের উপরে কোনও বলপ্রয়োগ করা হবে না। এমনকি ভাবমূর্তি বদলাতে বেহেশতা আরঘান্ড নামে এক মহিলা সাংবাদিককে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন এক তালিবান নেতা। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ মানুষই। টোলো গ্রুপের সিইও সাদ মহসেনির কথায়, ‘আমরা প্রত্যেকেই বিনিদ্র রজনী যাপন করছি’।
‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, একটা প্রজন্ম, যারা সাংবাদিক হয়ে ওঠার জন্য তিলে তিলে নিজেদের গড়ে তুলেছিলেন, তারা হয় দেশ নয়তো পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। আগামী দু’দশকে এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয়’।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, শতাধিক বেসরকারি চ্যানেল আপাতত পরিষেবা বন্ধ রেখেছে। সংবাদ সংস্থা দ্য পাজওক জানিয়েছে, অধিকাংশ চ্যানেল বন্ধের কারণ আর্থিক সঙ্কট। এ ছাড়া বহু মহিলাকে সংবাদমাধ্যম ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানাচ্ছে, ২০২০ সালে যেখানে কাবুলে অন্তত ৭০০ মহিলা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তালিবানের প্রত্যাবর্তনের পরে সেই সংখ্যা দাড়িয়েছে ৭৬। তালিবান সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার বার্তা দিলেও হেনস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। কাবুল দখলের পরে বহু সাংবাদিকের বাড়িতে হানা দিয়েছে তালিবান যোদ্ধারা। জার্মান সংবাদমাধ্যমের এক সাংবাদিকের পরিজনকে হত্যাও করা হয়েছে। এমনকি লাইভ টেলিভিশন শোয়ে সংবাদ পাঠককে ঘিরে রয়েছে বন্দুকধারীরা, সেই দৃশ্যও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার্থে তালিবান নেতৃত্ব কতটা আন্তরিক। এমনই পরিস্থিতিতে দলে দলে দেশ ছেড়েছেন আফগান সাংবাদিকরা। সেই তালিকায় শামিল বেহেশতা আরঘান্ডও। এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, ‘প্রাণভয়েই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন’।
এই পরিস্থিতিতে একটি সংবাদ সংস্থা আগামী দিনে বিদেশের মাটি থেকে সংবাদ পরিবেশনের পরিকল্পনা নিয়েছে। টোলো নিউজ়ের সিইও সাদ মহসেনি জানান, মহিলা সাংবাদিকদের উপরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বা সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে। এরই প্রতিফলন বেহেশতাদের দেশ ছাড়ার ঘটনা। বহু নামি সাংবাদিক দেশ ছাড়ায় সংবাদের গুণমান বজায় রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ কর্তৃপক্ষের।
মহসেনির কথায়, ‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, একটা প্রজন্ম, যারা সাংবাদিক হয়ে ওঠার জন্য তিলে তিলে নিজেদের গড়ে তুলেছিলেন, তারা হয় দেশ নয়তো পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। আগামী দু’দশকে এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয়’।
এখনো ভীতি কাটছে না আফগানিস্তানের সাংবাদিকদের। দেশটিতে গণমাধ্যম খাতে বেশ অগ্রগতি হলেও বিশ্বে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান একটি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের তথ্যমতে, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে কমপক্ষে ৫৩ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে গণমাধ্যমকর্মীরা ছিলেন এই তালিবান বাহিনীর টার্গেট; যা ছিল স্বাধীন গণমাধ্যমের সূচকে আফগানিস্তানের নিচের দিকে থাকার বড় কারণ।
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আরটিএর নারী সাংবাদিক শবনম দাওরান সম্প্রতি জানান, তাকে কাজ ছেড়ে ঘরে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। কারণ, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের জীবন এখন হুমকিতে।’
আফগানিস্তানের অনেক সাংবাদিক এখন আত্মগোপনে আছেন। অনেকে দেশ ছাড়তে উদ্ধারকারী ফ্লাইট পাওয়ার চেষ্টা করছেন। যারা বিদেশি গণমাধ্যমের জন্য কাজ করতেন, তাদের বেশির ভাগই দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু যারা বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন না, তাদের জন্য দেশ ছেড়ে যাওয়া বেশ ঝক্কির বিষয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ