আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটার পর অনেকেই ভেবেছিলেন এবার হয়ত শান্তি ফিরবে দেশটিতে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। সশস্ত্র গোষ্ঠী তালিবান কাবুল শাসনের ক্ষমতা পেলেও এখনো মেলেনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে সাধারণ মানুষ। এবার আফগান এক টেলিভিশন উপস্থাপকের ফুটপাতে খাবার বিক্রির দৃশ্য আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে দেশটির দুর্দশার চিত্র।
একসময় ছিলেন বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করা সাংবাদিক, আর এখন সেই ব্যক্তি রাস্তার পাশে ফুটপাতে খাবার বিক্রি করেন। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে গেছে মুসা মুহাম্মদির জীবন। সাংবাদিকতা ছেড়ে জীবন বাঁচাতে রাস্তায় পাশে খাবার বিক্রি করতে হচ্ছে তাকে। এমন চিত্রের দেখা মিলেছে তালিবান শাসিত আফগানিস্তানে।
সম্প্রতি বিবিসি পশ্তুর সাবেক প্রতিনিধি কবির হাকমল টুইটারে মুসা মুহাম্মদির তিনটি ছবি শেয়ার করেছেন। ক্যাপশনে লিখেছেন ‘তালিবানের অধীনে আফগানিস্তানের সাংবাদিকদের জীবন’।
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক কবির আরো লিখেন, ‘মুসা মোহাম্মদি বছরের পর বছর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে উপস্থাপক ও রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। এখন তার পরিবারের খাওয়ানোর মতো কোনো আয় নেই। কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য রাস্তার পাশে খাবার বিক্রি করছেন তিনি’।
মুসা মোহাম্মাদি নামে ওই উপস্থাপকের ছবি ভাইরাল হয়েছে। ওই পোস্ট থেকে জানা যায় যে, তালিবানের অধীনে আফগানিস্তানে সাংবাদিকরা কেমন জীবনযাপন করছেন। মুসা মোহাম্মাদি বছরের পর বছর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে উপস্থাপক ও রিপোর্টার হিসাবেও কাজ করেছেন। এখন তার পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য কোনো আয় নেই। অর্থ উপার্জনের জন্য রাস্তার পাশে বসে খাবার বিক্রি করছেন তিনি।
‘মুসা মোহাম্মদি বছরের পর বছর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে উপস্থাপক ও রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। এখন তার পরিবারের খাওয়ানোর মতো কোনো আয় নেই। কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য রাস্তার পাশে খাবার বিক্রি করছেন তিনি’।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের আমলে সাংবাদিকতার কাজ করতেন তিনি। ভালো উপার্জন করতেন। অনেক দিন ধরেই সাংবাদিকতার পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু সেই পেশা ছেড়ে ফল বিক্রি করার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি মুসা। শুধু মুসা কেন, তার মতো আরও অনেক মেধাবী এবং উচ্চপদস্থ কর্মীর একই দশা।
গত বছরের আগস্টে কাবুল দখল নেয় তালিবান। দেশে প্রজাতন্ত্রের পতনের পর আফগানরা নজিরবিহীন দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন বিবিসির এই সাবেক প্রতিনিধি।
এদিকে এই সাবেক সাংবাদিকের এসব ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিক্রিয়া জানান তালিবান নিয়োগপ্রাপ্ত আফগানিস্তানের জাতীয় বেতার ও টেলিভিশনের বর্তমান মহাপরিচালক আহমাদুল্লাহ ওয়াসিক।
আহমাদুল্লাহ ওয়াসিক এক টুইট বার্তায় লিখেন, ‘একটি বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশনের মুখপাত্র মুসা মোহাম্মদির বেকারত্বের দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। জাতীয় বেতার ও টেলিভিশনের পরিচালক হিসেবে আমি তাকে আশ্বস্ত করছি, আমরা তাকে জাতীয় বেতার ও টেলিভিশনের কাঠামোর মধ্যেই নিয়োগ দেব। আমাদের সকল আফগান পেশাদারদের প্রয়োজন’।
মুসা মোহাম্মদিকে পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিলেও, প্রকৃতপক্ষে এটাকে ফাঁকা বুলি হিসেবে দেখছেন অন্যান্য আফগান সাংবাদিকরা। কারণ, তালিবানের অধীনে কোনো সাংবাদিক ভালো নেই বলে অভিযোগ রয়েছে আফগান সাংবাদিকদের। তারা ঠিকমতো খবর সংগ্রহ করতে পারে না, প্রায় সময় তালিবানের বাধার মুখে পড়তে হয়।
দেশটির টেলিভিশন চ্যানেল টোলো নিউজে কাজ করেন আব্দুল হক ওমর। তিনি আফগান সাংবাদিকদের চিত্র বর্ণনা করে এক টুইট বার্তা দেন।
সেখানে তিনি লিখেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে তোরখাম ও বোলদাক গেটে আফগানদের কষ্ট ও দুর্বিষহ জীবন নথিভুক্ত করা হয়েছে। তাদের এই জীবন দশার চিত্র ছবি ও ভিডিও আকারে পোস্ট করা হয়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগের বিষয়ে তালিবান নীরব কেন?`
আব্দুল হক ওমর আরো অভিযোগ করেন, ‘এমন দুর্বিষহ চিত্র নথিভুক্ত করতে গিয়ে তালিবানের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এই চিত্র কভার করতে সাংবাদিকদের বাধা দিচ্ছে তালিবান বাহিনী। তালিবানরা বোলদাক ও তোরখামের খারাপ পরিস্থিতি কতদিন লুকিয়ে রাখবে?”
আফগানিস্তানের বদঘিজ প্রদেশের ফিরোজ কোহ শহরের বাসিন্দা জাবিউল্লা ওয়াফা পেশায় সাংবাদিক। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতা করছেন। কিন্তু ১৫ অগস্ট কাবুলের গণতান্ত্রিক সরকারের পতনের পরই চাকরি হারান তিনি।
১০ সদস্যের পরিবার চলবে কী ভাবে, এই ভাবনা থেকে বিকল্প কাজ খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কিছুই পাননি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থায় মাথায় আসে ইটভাঁটায় কাজ করার কথা। কিন্তু যে হাতে কলম ধরেছেন, সেই হাতে কী ভাবে ইটের নকশা কাটবেন জাবিউল্লা? তবে অবশেষে ক্ষুধার কাছে পরাজিত তাকে হতেই হয়।
এরপর ১০ সদস্যের পরিবারের পেট চালাতে জাবিউল্লা কাজ নিয়েছেন ইটভাঁটায়। প্রখর রোদে ইটভাঁটার কাজ করতে করতে জাবিউল্লা বলেন, ‘সরকার পতনের পর থেকে আমার মতো বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আমার সংস্থা আমাকে বেতন দিতে পারেনি। এ ভাবে ২ মাস বেতনহীন অবস্থায় থাকার পর বাধ্য হয়ে ইটভাঁটায় কাজ নিই’।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের ১৫০টি সংবাদপত্রের মুদ্রণ বন্ধ হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে আইট সওব পত্রিকার উপপ্রধান আশাক আলী এহসাস জানান, প্রতিদিন ১৫ হাজার সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। এসব সংবাদপত্র রাজধানী কাবুলসহ কয়েকটি প্রদেশেও পাঠানো হতো। সরকারের পতনের পর সংবাদপত্র ছাপানো ও বিতরণ নিয়ে সমস্যার কারণে পত্রিকার মুদ্রণ বন্ধ হয়ে গেছে।
আফগানিস্তানের আরেকটি বিখ্যাত পত্রিকা আরমান মিলির মুদ্রণও বন্ধ হয়ে গেছে। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সায়েদ শোয়েক পারসা জানান, আমাদের ২২ জন কর্মী ছিল। তাদের সবাই চাকরি হারিয়েছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আফগানিস্তানে দৃশ্যত: কোনো স্বাধীন গণমাধ্যমের অস্তিত্ব ছিল না। এ সময় টেলিভিশন, সংগীত এবং সিনেমা নিষিদ্ধ ছিল। নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র গুলো প্রকাশিত হতো, কিন্তু এগুলোতে মানুষের কোন ছবি ছাপানো হতো না।
কুড়ি বছর আগে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে মার্কিন বাহিনী কাবুলের দখল নিলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। এই সময়ে চালু হয় বেসরকারি টেলিভিশন, একাধিক সংবাদ ভিত্তিক চ্যানেলের সম্প্রচার শুরু হয়; এফ এম রেডিও চালু হয়, বিশ্বিবিদ্যালয়গুলো সাংবাদিকতার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করে, মোবাইল ফোন যোগাযোগের নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করে, উন্মুক্ত হয় ডিজিটাল প্রযুক্তি।
ওই বিশ বছরে ১৭০টিরও বেশি এফএম রেডিও অনুমোদন পায়, কাবুল থেকেই প্রকাশিত হয় ৯টি সংবাদপত্র, ৭টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং ৫টি বার্তা সংস্থায় কাজ করেন কয়েক হাজার সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী। দেশটিতে প্রায় ৮৬ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে, ২২ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে।
কিন্তু গত ১৫ আগস্ট তালিবানের হাতে আফগান সরকারের পতনের পর পরিস্থিতির বদল হলো দ্রুত। তালেবানের আশ্বাস সত্ত্বেও আফগানিস্তানে স্বাধীন গণমাধ্যম সম্ভব হবে না বলে জানায় সাংবাদিকরা। কারণ আগেকার যে তালেবান সরকার গণমাধ্যমকে বিকশিত হতে দেয়নি, এখনকার নেতৃত্বে তারাই অধিষ্ঠিত; আর সাংবাদিকদের কথাই বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫১
আপনার মতামত জানানঃ