আশি ও নব্বইয়ের দশকেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে নোয়াখালীর চাটখিল- রামগঞ্জ উপজেলার বাণিজ্যিক যোগাযোগের সহজ মাধ্যম ছিল মহেন্দ্র খাল। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এ খাল দিয়ে মেঘনা ডাকাতিয়া নদী হয়ে ছোট-বড় ট্রলারে পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া করতো ব্যবসায়ীরা। এ খালের পানি সেখানকার কৃষিজমির সেচের কাজেও ব্যবহার করা হতো। তবে অবৈধ দখলদারদের দখলে ও ময়লা আবর্জনায় হারিয়ে যাচ্ছে খালটি। এক সময়ের খরস্রোতা খালটি এখন নালায় পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, ৫০০ বছরের পুরনো মহেন্দ্র খালটি মোঘল আমলের। ভারতের ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢল থেকে নোয়াখালী ও কুমিল্লার আংশিক অঞ্চলকে রক্ষায় পানি নিষ্কাশন ও সেচ কাজের সুবিধার জন্য এ খালটি খনন করা হয়। ১৯০৫-১৯১০ সালের মধ্যে স্থানীয় জমিদার প্রথম খালটি সংস্কার করেন। সংস্কার করে জমিদার এ খালের নামকরণ করেন মহেন্দ্র খাল। সর্বশেষ ১৯৮০-৮১ সালে মহেন্দ্র খালের আংশিক অংশের সংস্কার করা হয়।
স্থানীয় প্রভাবশালীরা জেলা পরিষদের অস্থায়ী একসনা লিজের অপব্যবহার করে খালের উপর পাকা ভবন নির্মাণ করে পুরো খাল দখল করে নেয়। খাল দখলের ফলে পানি সরতে না পারায় মারাত্বক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। খালের মাঝখানে সিমেন্টের পাকা পিলার দিয়ে ভবন নির্মানের ফলে ময়লা আবর্জনা জমে খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আর এসব আবর্জনা পচে নষ্ট হওয়ার কারণে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে পানি। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে খনন না করায় হাটবাজার ও আবাসিক এলাকার পতিত আবর্জনায় বন্ধ হয়ে আছে খালের প্রবহমান স্রোতধারা।
এর একটি শাখা সোনাইমুড়ি-চাটখিল রামগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে মিলিত হয়েছে। খালের অপর শাখাটি চন্দ্রগঞ্জ লক্ষীপুর রামগঞ্জ হয়ে ডাকাতিয়া নদীতে মিলিত হয়েছে। খালের একটি শাখা চাটখিল পৌরসভার সোনাইমুড়ি-রামগঞ্জ সড়কের দক্ষিন দিকে বাজার ও আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে।
এলাকার কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি জানান, বৃটিশ আমলে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদী হয়ে ছোট-বড় ট্রলারে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল আনা-নেয়া করতেন এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। ঐ সময়ে চাটখিল ও সোনাপুর বাজারের সামনের ঘাটে ভিড়ত মালবাহী শত শত নৌকা ও ট্রলার।
বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র চৌমুহানি থেকে নৌকা ও ট্রলার যেগে মালামাল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেত পাইকাররা। মহেন্দ্র খাল মালামাল পরিবহনের সহজতর মাধ্যম হওয়ায় চৌমুহানি ও সোনাপুর বাজারটি ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিল। পাকিস্তান আমল এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরও এ খাল দিয়ে ব্যাবসা-বানিজ্য যোগাযোগ ব্যাবস্থার কেন্দ্রবিন্দ ছিলো এই মহেন্দ্র খাল।
সুদূর ঢাকা, চাঁদপুর ও নারায়নগঞ্জ থেকে বড় বড় নৌকা ও সাম্পানে করে মালামাল আসতো চৌমুহনী, চাটখিল ও সোনাপুরে। যা শুধু এখন স্মৃতি। একসময় এই খালগুলো ছোটখাটো নদীর আকৃতি থাকলেও গত দুই দশক ধরে খালের দুই পাড় দখলদারদের কবলে পড়ে পর্যায়ক্রমে এই খাল নালায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া কৃষিনির্ভর এ অঞ্চলের কৃষকরা এ খালের পানি দিয়ে ফসল ফলাতেন। নান্দনিক সৌন্দর্যের সেই খাল এখন অবৈধ দখল আর দূষণে অবহেলা-অনাদরে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
চাটখিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সালেহ মোহাম্মদ মোসা এক জাতীয় দৈনিককে জানান, মহেন্দ্র খালের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যাপারে জেলা পরিষদ এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
চাটখিল পৌরসভার মেয়র ভিপি নিজাম উদ্দিন ঐ দৈনিককে বলেন, মহেন্দ্র খালের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা খুব শিগগিরই করা হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য এইচএম ইব্রাহিম, জেলা প্রশাসকসহ সবার সহযোগিতা নিয়ে খালটি খননের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেন, আমরা অলরেডি টেন্ডার করেছি। করোনার কারণে পিছিয়ে আছি। করোনা প্রাদুর্ভাব যদি না থাকে তাহলে আমরা আগামী শুকনো মৌসুম থেকে কাজ শুরু করব। আগামী অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হবে।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান বলেন, খালটি সরু হয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছি। উন্নয়ন সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। শিগগির অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা দেশের অবৈধ দখলদারদের দখলে চলে যাচ্ছে নদী, খাল, ফুটপাত, সড়ক এমনকি পাহাড়ও। প্রভাবশালীদের এই অরাজকতায় বিঘ্নিত হচ্ছে সাধারণ জীবনযাপন। প্রশাসনের যথাযথ কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। আশ্বাসের বাণী অব্দিই আটকে আছে সমস্ত কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুতই মহেন্দ্র খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং সংস্কার করা না গেলে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই খালটি হারিয়ে যাবে চিরতরে।
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/০৯০৫
আপনার মতামত জানানঃ