করোনার পাশাপাশি বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দিন দিন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আলোচনা সভা এবং জরিমানার মত পদক্ষেপ নিলেও এতে কোনো কাজ হচ্ছে না। ফলত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ বেড়েই যাচ্ছে হাসপাতালগুলোতে। চলতি আগস্ট মাসের ২৮ দিনেই দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৯১১ জন।
ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারণ (ডেডিকেটেড) করে দেওয়া রাজধানীর ৫ টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ৪ টিই এখনো সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। এসব হাসপাতালে রোগী এলে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
যে ৫টি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড করা হয়েছে সেগুলো হলো— রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, কমলাপুরের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজারের ২০ শয্যা হাসপাতাল, মিরপুর মাজার রোডের লালকুঠি হাসপাতাল ও কামরাঙ্গীরচরের ৩১ শয্যার হাসপাতাল। এর মধ্যে চারটিতেই রোগী ভর্তি না করায় চাপ বেড়েছে মিটফোর্ড হাসপাতালে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিটে শয্যা আছে ৮০টি। গতকাল শনিবার রোগী ভর্তি ছিলেন ২২৬ জন। এ কারণে অনেক রোগীকে মেঝেতে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ও ডেঙ্গু ইউনিটের ফোকাল পারসন মিজানুর রহমান এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্য হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি না করায় ডেঙ্গু রোগীরা এখানে আসছেন।
আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতালের নিচতলার কয়েকটি কক্ষে বহির্বিভাগের কার্যক্রম চলছে। রোগীদের টিকিট কাউন্টারের সামনে আটজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। অবশ্য তাদের কারও জ্বরের সমস্যা ছিল না। হাসপাতালের দোতলায় অন্তর্বিভাগের পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড, দায়িত্বরত নার্স ও চিকিৎসকদের কক্ষ ছিল তালাবদ্ধ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দৈনিক রাজধানীর ১২টি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দেয়। এর মধ্যে ডেঙ্গুর জন্য নির্ধারিত পাঁচটির মধ্যে শুধু মিটফোর্ড হাসপাতালের তথ্য দেওয়া হয়। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৯৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৫৮৩ জন। আর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে মিটফোর্ড হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন ২২৬ রোগী।
মিরপুর মাজার রোডে অবস্থিত লালকুঠি হাসপাতাল (মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান) পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়। সেখানে মা ও শিশুদের নিয়মিত চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে জ্বরের রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য ‘ফ্লু কর্নার’ চালু করা হয়েছে। তবে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির কোনো ব্যবস্থা নেই।
ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতালটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। এখানে গতকাল পর্যন্ত চিকিৎসা শুরু হয়নি। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহেলী শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, এখনো কোনো জনবল পাওয়া যায়নি। তবে আগামীকাল (আজ রোববার) নিজস্ব জনবল দিয়েই ডেঙ্গুর চিকিৎসা শুরু করা হবে।
হাসপাতালের পাশের সিয়াম টি স্টোরের দোকানি ইমরান হোসেন বলেন, এই হাসপাতালে তো করোনার টিকা দেওয়া হয়। ডেঙ্গুর চিকিৎসা হয়, এমনটা তারা জানেনই না।
অন্যদিকে মতিঝিলের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার রিপন দাস জানান, ডেঙ্গু চিকিৎসা শুরু করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি এখনো পাননি তাঁরা। কোনো লোকবল, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও দেওয়া হয়নি।
ঘোষণা দেওয়ার পাঁচ দিন পরও কেন চারটি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার জন্য এখনও প্রস্তুত করা যায়নি, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, যে হাসপাতালগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি রেলওয়ের এবং আরেকটি পরিবার পরিকল্পনার। যে কারণে সেগুলো প্রস্তুত করতে দেরি হচ্ছে। বাকি দুটি হাসপাতাল দ্রুত প্রস্তুত করা হচ্ছে।
অন্যদিকে মতিঝিলের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার রিপন দাস জানান, ডেঙ্গু চিকিৎসা শুরু করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি এখনো পাননি তাঁরা। কোনো লোকবল, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও দেওয়া হয়নি।
এ বছর এখন পর্যন্ত (২৮ আগস্ট) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪১ জন, যা গত ১৮ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ বছরের জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে দুই হাজারের বেশি রোগী আক্রান্ত হন। আর চলতি আগস্ট মাসের ২৮ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৯১১ জন। ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর ৭০ শতাংশই হয়েছে গত ২৮ দিনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯ হাজার ৫৬৯ জন। এর মধ্যে ৮ হাজার ৮৪৮ জনই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁদের মধ্যে ৭১ শতাংশই ভর্তি হন বেসরকারি হাসপাতালে।
চিকিৎসক, নার্স, সরঞ্জাম ছাড়া পাঁচটি হাসপাতাল ডেঙ্গুর জন্য নির্ধারিত—এমন ঘোষণা দেওয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ডেঙ্গু রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয়বহুল সেবা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনার চিকিৎসা নিয়ে অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে, এখন ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
এদিকে মগবাজার-ইস্কাটন-বাসাবো-গোড়ান: দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা কমে এলেও এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার গত ২৯শে জুলাই থেকে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির যথাক্রমে পাঁচটি করে সর্বমোট ১০টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় সর্বোচ্চ এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া যায়।
ঢাকা উত্তরের পাঁচটি ওয়ার্ডের মধ্যে মগবাজার, নিউ ইস্কাটনে মশার ঘনত্ব শতকরা ৫৬ দশমিক ৭ ভাগ, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, নিকুঞ্জে ৪৮ দশমিক ৪ ভাগ, কল্যাণপুর, দারুস সালামে ৪৬ দশমিক ৭ ভাগ, মিরপুর-১০, কাজীপাড়ায় ৪৩ দশমিক ৩ ভাগ, মহাখালী, নিকেতনে ৪০ ভাগ ব্রুটেক্স ইনডেক্স পাওয়া যায়। অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণের বাসাবো, গোড়ানে ৭৩ দশমিক ৩ ভাগ, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ৬৬ দশমিক ৭ ভাগ, আর কে মিশন রোড, টিকাটুলিতে ৫০ ভাগ, বনশ্রীতে ৪০ ভাগ, মিন্টো রোড, বেইলী রোডে ৪০ ভাগ এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে। তবে উত্তর সিটির আফতাবনগর ও মেরুল বাড্ডা এবং দক্ষিণে বংশালে ব্রুটো ইনডেক্স শূন্য পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতাল প্রস্তুতে ধীরগতি থাকার কারণে বেসরকারি হাসপাতালে অনেক টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ভোগান্তির পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু রোগীদের ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়বে। প্রতিবছর এই সময়ে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও, আগাম ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। অজুহাত হিসেবে করোনা মহামারিকে দাঁড় করিয়েছে। এখন ঘোষণার পরও কর্তৃপক্ষ এই অযথা বিলম্বের কারণ হিসেবে কী দর্শাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আপনার মতামত জানানঃ