কাবুলের দখল তালিবানরা নিতেই মানুষের মধ্যে হিরিক পড়ে গেছে আফগানিস্তানের ভূমি ছাড়ার। এর জন্য কাবুলের বিমানবন্দরে মানুষের ভিড়ে তৈরী হয়েছে জনসমুদ্র। কট্টরপন্থী তালিবানের রাজত্বে দমবন্ধ করে বেঁচে থাকার ভয়ে দেশ ছাড়তেই কাবুলের বিমানবন্দরে মানুষের ভিড়। একে অপরকে ঠেলে ফেলে যে ভাবেই হোক বিমানে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। দেশ ছাড়ার জন্য কাবুলের বাসিন্দারা এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন যে বিমানের চাকার সাথে ঝুলে দেশ ছাড়তে গিয়ে উড়ন্ত বিমান থেকে ছিটকে পড়ে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঠেলাঠেলি করে বিমানে উঠতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের এবং গুলিতে নিহত হয় কমপক্ষে ৫ জন।
সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কাবুল বিমানবন্দরের পাশে উড়ন্ত বিমান থেকে পড়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা বিমানের চাকার সঙ্গে নিজেদের বেঁধে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন। এদিকে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোনো বিমান নামলে তা ভরে যাচ্ছে মুহূর্তেই। বিমানে তাড়াহুড়া করে উঠতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, কাবুল বিমান বন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনালে সোমবার গুলিতে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সংবাদমধ্যমটি বলছে, তিনজনের রক্তাক্ত লাশ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে কে বা কারা গুলি চালিয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়নি ওই সংবাদে। বিমানবন্দরটির প্যাসেঞ্জার টার্মিনালে গুলিতে এই নিহতের ঘটনা ঘটে।
আজ তালিবানদের কাবুল দখলে চলে আসার দ্বিতীয় দিন পড়েছে। প্রথম দিন থেকে রাজধানী কাবুলের পরিস্থিতির টুইট করে জানাচ্ছেন জাওয়াদ সুখানওয়ার নামে সে দেশের এক সাংবাদিক। আজ সোমবার (১৬ আগস্ট) তার টুইটে কাবুলের এই আতঙ্কের ছবি ধরা পড়েছে। তিনি টুইটে লিখেছেন, ‘কাবুলের আরও একটি দিনের শুরু। কাবুল বিমানবন্দরের দিকে জনসমুদ্র!’
কাবুল বিমানবন্দরের পাশে উড়ন্ত বিমান থেকে পড়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা বিমানের চাকার সঙ্গে নিজেদের বেঁধে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন।
আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থার কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা দেখে আঁতকে উঠতে হচ্ছে। দেখা গিয়েছে, রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা বিমান ঘিরে রয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের একাংশ নিজেদের মধ্যে মারপিট করে বিমানে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কোনও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিমানে জায়গা পেতে প্রাণপন ছুটছেন একাংশ। জনসমুদ্র সরিয়ে বিমান কী ভাবে উড়বে, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
গতকাল রবিবার সকালে দক্ষিণের জালালাবাদ দখল নেওয়ার পর দুপুরের মধ্যে বিনা যুদ্ধে কাবুল দখল করে তালিবান। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তালিবান প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বরাদরের সঙ্গে ৪৫ মিনিট বৈঠকের পরই পদত্যাগ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট গনি। তারপর তিনি নিজেও দেশ ছেড়েছেন।
আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা আরও একটি টুইট থেকে বোঝা যায়। স্টেফানি গ্লিনস্কি নামে আফগানিস্তানে কর্মরত এক মহিলা সাংবাদিক এক টুইট বার্তায় জানিয়েছিলেন, হেরটের দখল নেওয়ার পরই সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে তালিবান। হেরটের সমস্ত অফিস থেকে মহিলাদের বার করে দেওয়া হয়েছে। তাদের বাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছে এবং জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের জায়গায় এ বার পুরুষদের নিয়োগ করা হবে।
আফগানিস্তানের সশস্ত্র সংগঠন তালিবান দেশটির রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেখানে লুটপাট শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, আজ সোমবার সকালে কাবুলে অনেকের বাড়িঘর লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সেখানে গোলাগুলিও চলছে বলে জানিয়েছে গণমাধ্যমটি।
কাবুলের বাসিন্দা আয়শা খুররাম আজ সোমবার সকালে এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, গুলি ও চিৎকার–চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙেছে তার। কিছু মানুষ বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। এসব বাড়িতে থাকা গাড়ি ও বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। তবে তালিবান যখন এলাকায় যাচ্ছে, তখন তারা পালাচ্ছেন। তিনি ওই টুইটে বলেন, বিশৃঙ্খলা সবে শুরু।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, কাবুলে তালিবানরা প্রবেশের পর থেকে মানুষ আতঙ্কে। কাবুল ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, যারা এলাকা ছাড়তে চাইছেন, তাদের সুযোগ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহল ইতিমধ্যে আহ্বানও জানিয়েছে। এ জন্য ৬০টি দেশ একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। কাবুলের বিমানবন্দরে অনেককে ভিড় করতে দেখা গেছে গতকাল। আজ সকালেও এই ভিড় অব্যাহত ছিল। বিমানবন্দরে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে রয়টার্স। তবে তারা কীভাবে নিহত হলেন, তা জানা যায়নি।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের একটি ফ্লাইটে ওঠার চেষ্টা করলে ফাঁকা গুলি করেছে মার্কিন সেনারা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে এক মার্কিন সেনা জানায়, জনতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতেই ফাঁকা গুলি করা হয়েছে।’
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনেকগুলো ভিডিওতে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনেকগুলো ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষজন রানওয়ের দিকে দৌড়ে বিমানে ওঠার চেষ্টা করছে। এই বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করছে মার্কিন সৈন্যরা।
জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিমানগুলোয় কূটনৈতিক কর্মীদের আগে সরিয়ে নিতে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে, যা বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে তালিবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের সহযোগী দেশগুলোর কর্মীরা রাজধানী ছাড়তে শুরু করলেও চীন ও রাশিয়া ইঙ্গিত দিয়েছে যে, দূতাবাস বন্ধ করার কোন পরিকল্পনা নেই।
চীন তাদের নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, তারা যেন ঘরের ভেতরে থাকে এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকে। সেই সঙ্গে তারা জানিয়েছে, আফগানিস্তানের বিভিন্ন পক্ষকে তারা অনুরোধ জানিয়েছে যেন তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রবিবার সেদেশের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, তাদের আফগানিস্তান ছাড়ার কোন পরিকল্পনা নেই।
তালিবানের একটি প্রতিনিধি দল গত জুলাই মাসে চীন সফর করেছেন, যেখানে তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং লির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেই সময় ওই বৈঠককে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তালিবানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলে মনে করা হয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার’ নীতি নেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৮
আপনার মতামত জানানঃ