যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে তার নানা ধরনের তৎপরতার কারণে ইউরোপের শাসকরা একে অপরের নিকটবর্তী হয়েছিল। কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ইউরোপের রাজনীতির সমীকরণে নতুন নতুন হিসাব নিকাশ যুক্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইউরোপের প্রধান দুই শক্তি জার্মানি ও ফ্রান্স সামরিক পরিকল্পনায় একে অপরের বিরুদ্ধে চলে গেছে। যা কিনা ইইউ ঐক্যের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সম্প্রতি সদস্য দেশগুলো বেশ কয়েক দফা এই সংস্থার ঐক্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। সর্বশেষ পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি ইইউ বাজেটে ভেটো দিলে সেই সঙ্কট এখনো সমাধান হয়নি। এর মধ্যে জো বাইডেনের আগমনী ধ্বনীতেই ফ্রান্স ও জার্মানির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পুরনো ফাটলগুলো দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইইউ’র বর্তমান সংকটে প্রধান দুই শক্তি জার্মানি ও ফ্রান্সের এই দ্বন্দ্ব সংস্থাটির অস্তিত্ত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
মূলত ইউরোপের প্রতিরক্ষা নিয়েই সামরিক পরিকল্পনায় দ্বন্দ্ব। প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বিলোপ করে ইউরোপের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পক্ষে প্যারিস। অন্যদিকে ওয়াশিংটনের ঘাড়ে ভর দিয়েই চলতে চায় বার্লিন। এই বিপরীতমুখী টানাপোড়েনেই উভয়ের মধ্যে মতানৈক্য বাড়ছে। গত কয়েকদিনে দেশ দুটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের উত্তপ্ত বক্তব্য-বিবৃতিতে তা সামনে এসেছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, প্রতিরক্ষায় ইউরোপের স্বনির্ভরতার স্বপ্নকে ‘বিভ্রান্তি’ হিসেবে দেখছে জার্মান কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এক হুশিয়ারির পর বেশ নড়েচড়ে বসেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্র্যোঁ। তিনি এতটাই ধাক্কা খেয়েছেন যে, গত এক মাসে ফ্রান্সের মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়মিত উঠে আসছে। সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের দফতর এলিসি প্রাসাদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, ‘আমরা এটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হিসেবে দেখছি এবং তা চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেলের নীতির সঙ্গে যায় না।’
গত ২ নভেম্বর পলিটিকোতে প্রকাশিত এক কলামে জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যানাগ্রে ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার লিখেন, প্রতিরক্ষার জন্য অনাগত দিনগুলোতেও ইউরোপকে ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করতে হবে। ইউরোপের ‘কৌশলগত স্বনির্ভরতার’ প্রবক্তা ম্যাক্র্যোঁ এ অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং তিনি যুক্তি দেখান, প্রতিরক্ষায় অধিকতর স্বনির্ভর ইউরোপকেই সম্মান করবে যুক্তরাষ্ট্র।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আড়ালে-আবডালে ইউরোপের দুই ক্ষমতাধর দেশের মধ্যে ফাটল কতটা তীব্র হয়েছে। ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতিতে ম্যাক্র্যোঁ যেভাবে ইউরোপীয় স্বনির্ভরতার ধারণা গত চার বছরে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, বাইডেনের জয়ে তা বড় একটা ধাক্কা খাবে। বাইডেনের জয়ে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পুরনো উষ্ণ সম্পর্ক ফিরে আসবে, স্থিতিশীল ট্রান্স-আটলান্টিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দাঁড়াবে এমনটা আশা করা হলেও ম্যাক্র্যোঁর ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে ইউরোপীয় কৌশলগত স্বনির্ভরতার ধারণা এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ম্যাক্রোঁর ঘনিষ্ঠ ওই কূটনীতিক বলেন, নিশ্চিতভাবে ট্রাম্প আমাদের সহায়তা করেছেন তার কথা ও কাজের মাধ্যমে। ট্রাম্পের অসহযোগিতা ও একলা চলো নীতির কারণে ইইউর প্রতিরক্ষা যন্ত্র ম্যাক্র্যোঁর দিকে এগিয়েছে এবং ইইউ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার হয়েছে।
তিনি আরও জানান, একটি সামরিক ডকট্রিনের প্রায় কাছাকাছি সামরিক কৌশলপত্রের খসড়া তৈরির কাছাকাছি রয়েছে ইইউ। কিন্তু জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি প্যারিস ও বার্লিনের ফাটলটা স্পষ্ট করে তুলেছে। হোয়াইট হাউসে বাইডেনের মতো একজন আন্তঃআটলান্টিক নীতির সমর্থক আসায় ম্যাক্র্যোঁর পরিকল্পনা কতদূর এগোয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। জার্মানি মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্কেই ইউরোপের নিরাপত্তা স্বার্থ সুরক্ষিত হয়।
এক জার্মান কর্মকর্তা বলেন, বাইডেনের জয়ে একদিন সুপ্ত থাকা জার্মানি-ফ্রান্স ভিন্নমত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আপনি সহজেই ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন, কারণ তিনি ইইউ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেননি কিন্তু বাইডেনের মাধ্যমে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে যাবে। ফরাসি কর্মকর্তারা বলছেন, বাইডেনের জয়ের আগে ও পরে আন্তঃআটলান্টিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিয়মিত কথা বলেছেন ম্যাক্র্যোঁ ও মের্কেল। দু’জনের ঐকমত্যের প্রসঙ্গ টেনে ম্যাক্র্যোঁ নাকি বলেছিলেন, মের্কেল প্যারিসের সঙ্গেই আছেন।
এদিকে জার্মান কর্মকর্তারা বলছেন, মের্কেল তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অবস্থানকে সমর্থন করেন। উল্লেখ্য, আগামী বছর মার্কেল দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন। সেক্ষেত্রে ম্যাক্র্যোঁ-মের্কেলের রসায়ন ততটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে না। জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওয়াশিংটনের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহের মাধ্যমে ম্যাক্র্যোঁর প্রতি বার্লিনের সন্দেহ ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন উলরাইক ফ্রাঙ্ক। থিংকট্যাংক ইসিএফআরের এ বিশ্লেষক মনে করেন ম্যাক্র্যোঁ গোপনে ন্যাটোকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন, এমন আশঙ্কা রয়েছে বার্লিনের।
আপনার মতামত জানানঃ