কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশে ২২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছেন। আর দারিদ্র্যের হার ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার থেকে কমে ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
শনিবার (৭ আগস্ট) ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এই পর্যালোচনা তুলে ধরে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। তবে অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথভাবে কাজ করা একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, দেশের জনগণকে করোনা মহামারি থেকে সুরক্ষা দিতে টিকা প্রদান গ্রামীণ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কর, শুল্কসহ অন্যান্য নীতিতে সংস্কার ও যুগোপযোগীকরণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনসহ অর্থনীতির অন্যান্য খাতে হালনাগাদ তথ্যের অপর্যাপ্ততার কারণে নীতিমালা প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এটি নিরসনে অর্থনীতির সব স্তরের সমন্বিত তথ্যপ্রাপ্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করার কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, করোনা মহামারি মোকাবিলায় বিধিনিষেধ আরোপের ফলে সমাজের অনেক মানুষ নতুনভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসতে পারে, যা মোকাবিলায় আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ করে কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিকট কীভাবে পৌঁছানো যায়, তার প্রতি আরও যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
করোনায় কাজ হারানো মানুষের কষ্ট বাড়ছে
করোনার প্রভাবে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে। বেড়েছে দারিদ্র্য। অনেকে সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া ও লকডাউনের কারণে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তাদের কষ্ট বাড়ছে। তবে আয় এবং কাজ হারানো মানুষের জন্য রাষ্ট্রের পর্যাপ্ত সহায়তার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ নেই।
করোনার প্রভাবে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে। বেড়েছে দারিদ্র্য। অনেকে সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া ও লকডাউনের কারণে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তাদের কষ্ট বাড়ছে। তবে আয় এবং কাজ হারানো মানুষের জন্য রাষ্ট্রের পর্যাপ্ত সহায়তার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানবিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে। মানুষের আয় যেমন কমেছে, তেমনি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে চিকিৎসা ও যাতায়াত খরচ। একদিকে আয় কমে যাওয়া, অন্যদিকে খরচ বেড়ে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন এসব মানুষ। এসব সমস্যাগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা না হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা প্রকট হবে। এ জন্য তারা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো অথবা বিশেষ সহায়তা কর্মসূচি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে সরকার কিছু লোকের তালিকা করেছে। সাধারণ মানুষ, পরিবহন শ্রমিক, প্রবাসফেরত ব্যক্তি, নন এমপিও শিক্ষক, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মীসহ প্রায় ৫০ লাখ লোকের তালিকা তৈরি হয়েছে। এসব মানুষকে সরকারের পক্ষ থেকে আড়াই হাজার টাকা করে দু’বার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কম দামে চাল, আটা বিক্রি করছে সরকার। সরাসরি খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে যারা সহায়তা পেয়েছেন, তাদের বাইরেও লাখ লাখ মানুষ রয়েছে, যাদের সহায়তা দরকার। সবাইকে তালিকাভুক্ত করে একটি নীতিমালার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় অন্তর সহায়তা দিতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে যে নগদ ও খাদ্য সহায়তা দিয়েছে এবং চলমান রয়েছে, তা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে অপ্রতুল।
চলতি অর্থবছরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে এক কোটি ২২ লাখ ৮১ হাজার মানুষকে ভাতা হিসেবে নগদ টাকা দিতে বরাদ্দ রেখেছে সরকার। এর মধ্যে সারাদেশে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হবে ৫৭ লাখ ব্যক্তিকে। বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা ২৪ লাখ ৭৫ হাজার নারীকে ভাতা দেওয়া হবে। আর ২০ লাখ ৮ হাজার অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতা পাবেন। মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া হবে ৭ লাখ ৭০ হাজার জনকে। এ ছাড়া যাদের সন্তান দুধ পান করে এমন ২ লাখ ৭৫ হাজার কর্মজীবী মাকেও ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। মাসিক ২০ হাজার টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান ২ লাখ ১৩ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা। এসব কর্মসূচিতে সরকার ১২ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এসব স্থায়ী ভাতা, মাসিক ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত ভাতা দেওয়া হয়। সরকার এসব বরাদ্দ রাখলেও দেশের সব বয়স্ক, বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন না।
এ ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি কর্মসূচির আওতায় তিন কোটি ৫৯ লাখ ২৫ হাজার লোক সুবিধা পাবেন বলে চলতি অর্থবছরের বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কর্মসূচিতে ভিজিডি, ভিজিএফ, খাদ্য সহায়তা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা), টিআর ও খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচি রয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এসব কর্মসূচি বাবদ ১৫ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় হোক অথবা বিশেষ কর্মসূচির অধীনে হোক, সমস্যাগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করতে হবে। সরকার প্রণোদনার মাধ্যমে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখায় বেশি মনোযোগ দিয়েছে। পাশাপাশি সমস্যাগ্রস্ত মানুষকে সামান্য কিছু সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতার তুলনায় এসব সহায়তা অপ্রতুল। এখন প্রচলিত কর্মসূচি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নতুন কর্মসূচিও নিতে হবে। করোনার আঘাতে যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেম তাদের সহায়তার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। তথ্য ও দক্ষতা দরকার। সরকার চাইলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টেলিফোনের মাধ্যমে তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও অঞ্চলভিত্তিক ও পেশাভিত্তিক তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়েছে। সরকার পেশাভিত্তিক কিছু তথ্য ইতোমধ্যে নিয়েছে। আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে সমস্যায় পড়া সবাইকে সহায়তা করতে হবে। এখন এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে। এই বিপর্যয় ঠিকভাবে মোকাবিলা করা না গেলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারও ঠিকভাবে হবে না। এ জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার।
তারা বলেন, আগে যারা দরিদ্র ছিলেন, তারা আরও দরিদ্র হয়েছেন। নতুন করে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়েছে। শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকেরই এখন করুণ দশা। এ অবস্থায় সবচেয়ে জরুরি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। কিন্তু এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। পুরোনো দরিদ্রদের যে তালিকা সরকারের কাছে আছে, সেখানে অনেক ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। আর নতুনদের তালিকা সরকারের কাছে নেই। ফলে অনেক সমস্যাগ্রস্ত মানুষই সরকারের কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। এর মধ্যে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, নতুন দরিদ্রদের অস্বীকার করার প্রবণতা রয়েছে সরকারের মধ্যে। সরকার মনে করছে, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হচ্ছে। ফলে সমস্যায় পড়া মানুষদের জন্য খাদ্য, অর্থ সহায়তা করা এবং কাজের সুযোগ সৃষ্টি জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫১
আপনার মতামত জানানঃ