কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তৃতীয় ঢেউও শুরু হয়েছে। মহামারীতে বয়স্ক ও অসুস্থদের ঝুঁকি বেশি। তার চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। করোনাকালে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। হাসপাতাল এড়িয়ে যাওয়ার কারণে বাড়িতে সন্তান প্রসবের হারও বেড়েছে। একইসাথে বেড়েছে মৃত সন্তান প্রসব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রসবসংখ্যার তুলনায় ২০১৯ সালের চেয়ে করোনাকালে মৃত সন্তান প্রসব বেড়েছে। ২০১৯ সালে মৃত সন্তান জন্মের হার ৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ ছিল। ২০২০ সালে তা বেড়ে ৪ দশমিক ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে এ হার ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। এ সময়ে সরকারি সেবাকেন্দ্রগুলোতে প্রসবের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
করোনাকালে চিকিৎসাসেবার ঘাটতি এবং অনেক মা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার কারণেও মৃত সন্তান প্রসবের ঘটনা বেড়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ-সংক্রান্ত তথ্যে কোভিডের বিষয়টি আলাদা করা নেই।
অবস্ট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি বাংলাদেশ (ওজিএসবি)-এর তথ্যমতে, মহামারির আগে বাড়িতে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৩২ শতাংশের মতো। কিন্তু করোনাকালে ওজিএসবির ১৪টি শাখার তথ্য বলছে, শতকরা ৫৪ শতাংশ বাড়িতে মাতৃমৃত্যু বেড়েছে। যদিও এটা গবেষণালব্ধ জরিপ নয়। তাছাড়া মহামারি এখনও শেষ হয়নি, আর সব হাসপাতালের তথ্যও নেওয়া শেষ হয়নি।
গত বছরের মার্চ থেকে লকডাউনের সময়ে পরিবার পরিকল্পনা সার্ভিস ছিল বেশ নড়বড়ে। লকডাউন থাকার কারণে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে ‘ম্যাটেরিয়াল’ পৌঁছাতে পারেননি। পরিবার পরিকল্পনা সেন্টারগুলোও বন্ধ ছিল। তাই তারা উপকরণও পাননি। ফলে এ সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের অর্ধেকই পিল। বাকি অর্ধেকের মধ্যে আছে ইনজেকশন, কনডম, নারী ও পুরুষের বন্ধ্যাকরণ, ইমপল্গান্ট ইত্যাদি।
করোনাকালে চিকিৎসাসেবার ঘাটতি এবং অনেক মা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার কারণেও মৃত সন্তান প্রসবের ঘটনা বেড়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে পিল ও কনডমের ব্যবহার কমে যায় প্রায় ৩০ শতাংশ। স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের পরিমাণও কমে যায় ব্যাপকভাবে। যেমন জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে গড়ে প্রায় তিন হাজার ভ্যাসেকটমি (পুরুষের বন্ধ্যাকরণ) হলেও এপ্রিল মাসে এ সংখ্যা ছিল ২৬৩ এবং মে মাসে ১২১। নারী বন্ধ্যাকরণ বা কিউবেকটমির সংখ্যা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ছয় হাজারের ওপরে হলেও এপ্রিলে এর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮০০ আর মে মাসে এ সংখ্যা ২ হাজার ৬০০।
তথ্যমতে, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার না করায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে সন্তান প্রসবের হার যেমন বেড়েছে, তেমনই গলির দোকান থেকে গর্ভপাতের ওষুধ খাবার কারণেও রক্তক্ষরণ হয়ে অনেক মা মারা যাচ্ছেন। আবার কেবল যে সন্তান প্রসবের সময়েই মায়েরা মারা গেছেন, তা-ই নয়, ‘আর্লি প্রেগন্যান্সিতে’ও নানান জটিলতার কারণে মায়েদের মৃত্যু বেড়েছে।
জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটি ২ আগস্ট অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধদানকারী মাকে করোনাভাইরাস টিকার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) টিকা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা কমিটির কাছে তুলে ধরে।
বারডেম হাসপাতালের প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এবং ওজিএসবির সভাপতি ফেরদৌসী বেগম জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের হার কম। আর সংক্রমিত হলেও মৃত্যুঝুঁকি কম। তাই অন্তঃসত্ত্বাদের আগে থেকেই টিকার আওতায় আনা গেলে মাতৃমৃত্যু, মৃত সন্তান জন্ম এবং নবজাতক মৃত্যু হয়তো কম হতো।’
তিনি বলেন, করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা—সবই নিম্নমুখী। মায়ের স্বাস্থ্যে এসব প্রভাব ফেলে।
মৃত সন্তান জন্মের কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, অপুষ্টি, ডায়াবেটিস, সংক্রমণ, জন্মগত বিকলাঙ্গতার কারণে মৃত শিশু প্রসবের ঘটনা ঘটে থাকে। আর নবজাতক মৃত্যুর বড় কারণ অপরিণত বয়সে প্রসব হওয়া। করোনায় আক্রান্ত মায়ের মৃত সন্তান জন্ম ও অপরিণত বয়সী শিশু জন্ম দেওয়ার ঝুঁকি বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘যেসব গর্ভবতী মা নিয়মিত চেকআপে থাকতেন, করোনা সংক্রমণের শঙ্কায় এই সময়টাতে তারা থাকতে পারেননি। এ কারণে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মা, যাদের অবশ্যই হাসপাতালে ডেলিভারি করাতে হবে বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে, তারা সেই সুযোগ পাননি। কারণ তাদের শনাক্ত করা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ। কিন্তু করোনার এ সময়ে চিকিৎসা অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। সীমিত হয়েছে ডোনার। ঠিক সময়ে রক্ত না পাওয়া, ব্লাডব্যাংকগুলোতে রক্তস্বল্পতার কারণেও মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায়ও নারী না থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুন নাহার বলেন, ‘পরিবার থেকে শুরু করে সর্বত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ খুব সীমিত। করোনার সময়ে গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে সবাইকে। ফলে পুরুষের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভধারণ করতে হয়েছে অনেক নারীকে। আবার অনেক নারীকে পুরুষের সিদ্ধান্তে অনিরাপদ গর্ভপাত করতে হয়েছে। এতে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মা মৃত্যুবরণও করেছেন।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খিঁচুনি, ফুল না আসা ও প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণের কারণে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতাল-গুলোতে সীমিত সেবা, যানবাহন সমস্যা, হাসপাতালে সময়মতো সেবা না পাওয়ার আশঙ্কা এবং ছুটির দিনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা নির্ধারিত সেবা না পাওয়া এর অন্যতম কারণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ