যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হবার পর থেকেই দেশটির অবস্থা সর্বোচ্চ খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে। ২০০১ সালে তালিবান শাসনের অবসান হওয়ার পর আফগানিস্তানের বড় অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে গণমাধ্যমের সমৃদ্ধি। তবে বর্তমানে দখলকৃত এলাকায় জঙ্গি গোষ্ঠীটি গত ৩ মাসে ৫১ টি গণমাধ্যম জোরপূর্বক বন্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে আফগানিস্তানের জাওজাজান প্রদেশের রাজধানী শেবেরগান দখল করেছে তালিবান। এমনকি আফগানিস্তানের একটি জেলখানাও দখল করেছে তালিবানরা। ফলে আফগানিস্তানে ক্রমেই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে অবস্থানরত সকল ব্রিটিশ নাগরিককে দ্রুত দেশটি ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
৩ মাসে ৫১টি গণমাধ্যম বন্ধ হয়েছে
আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতার মধ্যে গত তিন মাসে মোট ৫১টি গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। টলো নিউজের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ইয়াহু নিউজ।
গত মঙ্গলবার আফগানিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চারটি টেলিভিশন নেটওয়ার্কসহ ১৬টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।
আফগানিস্তানের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী কাসিম ওয়াফায়েজাদা বলেছেন, এখন পর্যন্ত ৩৫ টি গণমাধ্যম তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, ৬ টির বেশি সংবাদমাধ্যম তালিবানদের হাতে পড়েছে এবং তাদের কার্যক্রম প্রকাশের জন্য ব্যবহার হচ্ছে।
হিলমান্দ, কান্দাহার, বাদাখশান, তাখার, বাঘলান, সামানগান, বালখ, সার-ই-পুল, জাওজান, ফারইয়াব, নুরিস্তান এবং বাঘি এলাকায় ওই সংবাদমাধ্যমগুলোর কার্যালয়।
জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০০ রিপোর্টার এবং গণমাধ্যমকর্মী চাকরি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে দেড় শতাধিক নারী রয়েছেন। এমনকি দুই সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন।
২৪ ঘন্টায় দুটি প্রাদেশিক রাজধানী দখল
আফগানিস্তানের জাওজাজান প্রদেশের রাজধানী শেবেরগান দখল করেছে তালিবান। আজ শনিবার ( ৭ আগস্ট) প্রদেশটির ডেপুটি গভর্নর কাদের মালিয়া এই তথ্য জানিয়েছেন। এর ফলে গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় প্রাদেশিক রাজধানী দখল করলো তালিবানরা। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এখবর জানিয়েছে।
ডেপুটি গভর্নর কাদের মালিয়া বলেন, বিমানবন্দর থেকে পিছু হটেছে সরকারিবাহিনী ও কর্মকর্তারা। এই শহরে কুখ্যাত যুদ্ধবাজ রশিদ দুস্তুমের বাস। এই সপ্তাহেই তিনি তুরস্কে চিকিৎসা শেষে আফগানিস্তান ফিরেছেন।
মে মাসে হামলা জোরদার করার পর থেকে আফগানিস্তানের বিশাল গ্রামীণ এলাকার দখল নিয়েছে তালিবানরা। বিদেশি ও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার সময়ে এসব অভিযান চালাচ্ছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
গতকাল নিমরোজের ডেপুটি গভর্নর রোহ গুল খাইরজাদ বার্তাসংস্থা এএফপি’কে বলেছেন, নিমরোজের প্রাদেশিক রাজধানী জারাঞ্জ নগরী ‘কোনো যুদ্ধ ছাড়াই’ তালেবান যোদ্ধারা দখল করে নিয়েছে। তালিবান। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির দখল করা প্রথম প্রাদেশিক রাজধানী শহর এটি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জারাঞ্জ হচ্ছে ইরান সীমান্তের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্য কেন্দ্র। এই শহরের চারদিকের এলাকা দখল করে নেওয়ার পর তালেবান জারাঞ্জ দখলের জন্য অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল।
বেশ কয়েকটি সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, শেবেরগানে তালেবানে কিছুটা প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। তবে দস্তুমের এক উপদেষ্টা নিশ্চিত করেছেন তালিবানরা শেষ পর্যন্ত শহরটি দখল করেছে।
একটি জেলখানাও দখল করে নিয়েছে তালিবানরা
আফগানিস্তানের একটি জেলখানা দখল করেছে তালিবান যোদ্ধারা। দখলের পর সেখানে আটক সব অপরাধীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দেশটির জোজ্জন প্রদেশে ঘটেছে এ ঘটনা। আজ শনিবার (৭ আগস্ট) এসব জানিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিওতে দেখা যায়, শনিবার বিদ্রোহীরা হামলা চালানোর পর শত শত বন্দি জোজ্জন প্রদেশের রাজধানী শেবারগান শহরের কারাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তালিবানরা শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, এটি জঙ্গিদের হাতে দখল হওয়া দ্বিতীয় প্রাদেশিক রাজধানী। দেশজুড়ে যুদ্ধ বেড়ে যাওয়ায় এটি নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য একটি বড় আঘাত। এর আগে, নিমরোজ প্রদেশের জারাঞ্জ শহরটি বিদ্রোহীরা দখল করে।
শেবারগান আফগানিস্তানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল রশিদ দস্তুমের শক্ত ঘাঁটি। তার সমর্থকরা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, আফগান বাহিনীকে তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করার জন্য ১৫০ জন লোক শহরে এসেছে। এ অঞ্চলের কাউন্সিল প্রধান বাবর এশচি বলেছেন, জঙ্গিরা এখন একটি সেনা ঘাঁটি ছাড়া পুরো শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ঘাঁটিতে এখনও যুদ্ধ চলছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় নাগরিকদের দ্রুত আফগানিস্তান ত্যাগের নির্দেশ যুক্তরাজ্যের
যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটিতে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি এবং নাগরিকদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে আফগানিস্তানে অবস্থানরত সকল ব্রিটিশ নাগরিককে দ্রুত দেশটি ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে যুক্তরাজ্য। এছাড়া ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অফিস শুক্রবার হালনাগাদ করা নির্দেশনায় আফগানিস্তান সফরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আফগানিস্তান ছাড়ার পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে ব্রিটিশ নাগরিকদের কাবুলে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের দূতাবাসে যোগাযোগের জন্য বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘আফগানিস্তানে থাকা সকল ব্রিটিশ নাগরিককে যত দ্রুত সম্ভব দেশটি ত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যদি আপনি আফগানিস্তানে থাকেন, তাহলে আপনাকে দ্রুত আফগানিস্তান ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। কারণ দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে দেখা যাচ্ছে।’
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, সন্ত্রাসীরা আফগানিস্তানে আরও শক্তিশালী হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তালিবান যোদ্ধারা হামলার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিগুলো কাজে লাগাচ্ছে এবং তা আরও জোরদার করছে। এছাড়া আফগানিস্তানজুড়ে পশ্চিমা নাগরিকদের অপহরণের শিকার হওয়ার চরম ঝুঁকি রয়েছে।
তালিবান মিলিশিয়ারা ইতোমধ্যে অর্ধেক আফগানিস্তান নিজেদের দখলে নিয়েছে। এর মধ্যে প্রতিবেশী দুই দেশ পাকিস্তান ও ইরানের সঙ্গে ‘বর্ডার ক্রসিং’ রয়েছে। তালেবান অবশ্য দেশের ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করছে।
আফগানিস্তানে থাকা যুক্তরাজ্যের সকল নাগরিককে দ্রুত দেশটি ত্যাগ করার ব্যাপারে সতর্ক বার্তা জানিয়ে দিয়েছে ব্রিটেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার কারণে তারা এমন সতর্ক বার্তা জানালো।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২১১০
আপনার মতামত জানানঃ