করোনাভাইরাসের টিকা প্রাপ্তির দৌড়ে বাংলাদেশ বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকার শুরুতে যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিকা নিয়ে আলোচনা চালিয়েছিল, সেসব প্রতিষ্ঠান টিকা উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া টিকা প্রাপ্তিতে সুসমন্বিত পরিকল্পনায়ও ঘাটতি দেখা গেছে। এখনো পড়ে আছে জরুরি অনেক কাজ। এ অবস্থায় টিকা প্রাপ্তির কিছু আশা থাকলেও তা পরিমাণে সীমিত এবং ধারণা করা হচ্ছে, এটা গরিবরা প্রথমে পাবে না। ধাপে ধাপে গরিবদের জন্য টিকা আসবে। তবে সেটা কবে নাগাদ, তা কেউ জানে না। এখন অবধি সরকারের পরিকল্পনায় ধনীকশ্রেণি, বিশেষায়িত পেশাজীবী ও সরকারী কর্মকর্তারাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
টিকা নিয়ে এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী চলছে ব্যাপক তোড়জোড়। চলতি সপ্তাহকে মহামারী প্রতিরোধী উদ্যোগের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে। কারণ, এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনটি ওষুধ কোম্পানির করোনা টিকা ৯০ শতাংশের বেশি সফল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৮ নভেম্বর ২০২০, বুধবারের ঘোষণায় চীনের টিকাকেও সফল বলা হচ্ছে। যে টিকাগুলোকে সফল বলা হচ্ছে, সেগুলোর গণউৎপাদনও শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এই উৎপাদিত টিকার পুরোটাই যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোতে। বাংলাদেশ কবে নাগাদ টিকা পাবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
তবে দেশের গরিব মানুষ কবে টিকা পাবে, সেই নিশ্চয়তা না থাকলেও বিত্তবানদের জন্য বেসরকারিভাবে টিকা আনার চেষ্টা চলেছে। সরকারের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে কোনো কোনো টিকা স্বল্পসংখ্যক হলেও সরকারের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে আগাম দেশে আনার চেষ্টা করছে একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এভাবে টিকা আনার ব্যাপারে সরকারও ইতিবাচক। ফলে চড়া দামে টিকা কেনার একটা সুযোগ থাকবে। যে সুযোগ কেবল ধনীরাই নিতে পারবে।
সূত্র জানায়, সরকার শুরুতে অক্সফোর্ডের টিকাকেই লক্ষ্যবস্তু করে। সেই মোতাবেক ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৩ কোটি ডোজ টিকা আনার ব্যাপারে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু টিকার প্রতিযোগিতায় অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা এখন অনেক পিছিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে এগিয়ে রয়েছে মার্কিন কোম্পানি ফাইজার ও মডার্না। কিন্তু এই দুটি কোম্পানির ভ্যাকসিন নিয়ে সরকার ভাবছে না। কারণ এই ভ্যাকসিন সংগ্রহের অর্থ ও মাইনাস তাপমাত্রায় তা সংরক্ষণের অবকাঠামো বাংলাদেশে নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা প্রতিযোগিতায় চরম উত্থা-পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত পরিকপনা নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি সরকার। তাছাড়া চীনের সিনোভ্যাকের টিকার ট্রায়াল বাংলাদেশে করা গেলে সেই টিকা প্রাপ্তির দৌড়ে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকত। কিন্তু সময়মত সাড়া না দেয়ায় সেই প্রক্রিয়া আটকে গেছে। ধারণা করা হয়, এখানে ভারতীয় সরকার ও তার পেছনে থাকা ওষুধ কম্পানিগুলোর প্রভাব কাজ করে থাকতে পারে।
টিকাপ্রাপ্তির দৌড়ে পিছিয়ে পড়লেও সরকার আত্মবিশ্বাসী যে, টিকার অনুমোদন মিললে সরকার ধাপে ধাপে তা অল্প কিছু করে হলেও পাওয়া শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের একটি সভায় বলেছেন, ‘যখনই টিকার অনুমোদন মিলবে, তখনই আমরা পাব।’ তিনি আরো যুক্ত করেছেন, ‘ইতিমধ্যেই আমরা এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে টিকার বুকিং দিয়ে রেখেছি।’
জানা গেছে, টিকাপ্রাপ্তির চেষ্টায় সরকার ‘কোভেক্স’ উদ্যোগে নাম লিখিয়েছে এবং নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকাও দিয়েছে। যেখান থেকে প্রাথমিকভাবে ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা পাবে বাংলাদেশ। পরে আরো ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষের টিকা আসার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু এই মাধ্যমে বাংলাদেশে কবে নাগাদ টিকা আসতে পারে, তা এখনো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
১৯ নভেম্বর টিকা বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্যাভি অ্যালায়েন্স ও কোভেক্স নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে। বৈঠক সূত্র জানায়, এই সভা থেকে বাংলাদেশের জন্য টিকা বিষয়ে নতুন কোনো অগ্রগতির খবর আসতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে টিকা আসতে এপ্রিল মাস লেগে যাবে। অথচ বিশ্ব হয়তো ডিসেম্বরেই এই টিকা হাতে পাবে। তবে বাংলাদেশ টিকা পাবে ধাপে ধাপে। তাতে করে সাধারণ মানুষ কবে এই টিকার নাগাল পাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
টিকা বাংলাদেশ যখন পাবে, তখনও তা প্রাপ্তির দৌড়ে এগিয়ে থাকবে দেশের ধনী ও প্রভাবশালীরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির পরিচালক ডা. সামসুল হক বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ অনুসারে অগ্রাধিকারভিত্তিক যারা টিকা পাবে, তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এ কাজে অগ্রগতিও বেশ ভালোই হয়েছে। এখন সেটা উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসারে প্রথমেই পাবেন ফ্রন্টলাইনার চিকিৎসাকর্মীরা। এর বাইরে পর্যায়ক্রমে থাকবেন অন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্তরা। এখানে আমরা জর করে কাউকে আগে দেব না।
এদিকে করোনা ভাইরাসের টিকা কিনতে বাংলাদেশ দাতাসংস্থাগুলোর কাছে ঋণ সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বলছে, ১৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের জন্য ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এ মাসের গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক ও জাপানের উন্নয়ন সংস্থা-জাইকার কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কাছে ৫০ কোটি ডলার, জাইকার কাছে ৫০ কোটি ডলার, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের কাছে ৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে সরকার। এছাড়া জার্মানির কাছে ২৫ কোটি ডলার, ফ্রান্সের কাছে ২৫ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ চাওয়ার সময় এটা নয়। এখন সময় টিকা কেনার। ঋণ আরও আগেই চাওয়া উচিত ছিল। এখন ঋণ আবেদনের অর্থ হলো এর অনুমোদন পেয়ে অর্থ হাতে পেতে আরও অনেক সময় লেগে যাবে। সরকার চাইলে এক্ষেত্রে রিজার্ভের সহায়তা নিতে পারত। ইদানীং রিজার্ভের অর্থ থেকে সরকারি ও বেসরকারি কম্পানিকে ঋণ দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। অথচ রিজার্ভের অর্থকে করোনা মোকাবিলায় কাজে লাগানো যেত। করোনা প্রতিরোধ করাটা এখন জাতীয় নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রধান কর্তব্য। এখানে যে কোনো ধরণের ব্যর্থতার জন্য দেশবাসীকে অনেক বড় মাশুল দিতে হতে পারে।
মিই/আরা/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ