দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুর যে ভ্যারিয়েন্টটি বেশি ছড়াচ্ছে, সেই একই ভ্যারিয়েন্ট ২০১৯ সালে বিপর্যয় ঘটিয়েছিল। একইসাথে চলতি বছরের জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। মাসের শুরুতে আক্রান্তের সংখ্যা তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ মাসের ৩ দিনেই আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৮৮ জন। গত মাসের ৩১ দিনে এ সংখ্যা ছিল ২২৮৬ জন। এ তথ্য রাজধানীর ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের। তবে এর বাইরে ঠিক কত রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন এবং চিকিৎসাধীন তার কোনো হিসাব নেই সরকারের কাছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে মঙ্গলবার জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকা বিভাগের হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হন ২৪৮ জন। অন্য বিভাগের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হন ১৬ জন।
চলতি বছর এ নিয়ে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৪৪৬ জনের দেহে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৮৬ জন ছিলেন গত মাসেই।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, ডেঙ্গু উপসর্গ নিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৪৪৬ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে রোগী শনাক্ত হয় ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে-তে ৪৩ জন, জুনে ২৭১ জন, জুলাইয়ে ২২৮৬ জন এবং আগস্টে ৩ দিনে ৭৮৮ জন। আক্রান্তদের মধ্যে বর্তমানে সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১০৭২ জন।
এরমধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১০২৫ জন। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসাধীন আরও ৪৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪৮ জন। এই সময়ে ঢাকার বাইরে ১৬ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ তথ্যে ৪ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে। যাদের তথ্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে মৃত্যুগুলো ডেঙ্গুজনিত কিনা সেটি এখনও নিশ্চিত করেনি আইইডিসিআর।
এ মাসের ৩ দিনেই আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৮৮ জন। গত মাসের ৩১ দিনে এ সংখ্যা ছিল ২২৮৬ জন।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ওই ৮ বছরে কখনোই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়ায়নি। ২০১৫ সাল থেকে রোগটির প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। ২০১৭ সালে কিছুটা কমে ২০১৮ সালে আবার বেড়ে যায়।
গত বছর সারা দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪০৫ জনের, যাদের মধ্যে ছয় জন মারা যান। এর আগের বছর ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। সেবার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখের বেশি, যাদের মধ্যে মারা যান ১৭৯ জন।
সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গিজ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিলেন শিশু, শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে আইইডিসিআর থেকে ডেঙ্গু সন্দেহে ২৭৬ জনের মৃত্যুর তথ্য আসে। বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনায় এর মধ্যে ১৭৯ জনের ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ বছর শনাক্ত রোগীর বেশির ভাগই ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ থ্রি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। দুই বছর আগেও এ ধরনের ভ্যারিয়েন্টে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডেঙ্গুর এখন পর্যন্ত চারটি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, যার মধ্যে সেরোটাইপ থ্রি বেশি সংক্রমিত করতে সক্ষম।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর এক দৈনিককে বলেন, ‘এবারও ডেঙ্গুর টাইপ থ্রি বেশি মানুষকে আক্রান্ত করছে। এবার করোনা সংক্রমণের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে একটু বেশি সতর্ক হতে হবে।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোতলেবুর রহমান ওই দৈনিককে বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এবার ডেঙ্গুর টাইপ সি-তে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এখনকার রোগীদের যে লক্ষণ দেখা দিচ্ছে তা হল দ্রুত পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। তবে অন্য উপসর্গের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই মাথা ব্যথা, চোখ জ্বলা, বমি, পাতলা পায়খানা এগুলো হচ্ছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গু ভাইরাসের আসলে চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। টাইপ ওয়ান, টাইপ টু, টাইপ থ্রি, টাইপ ফোর। এবার ডেঙ্গু টাইপ থ্রি দিয়ে জ্বরটা বেশি হচ্ছে।
এ বছর কেনো সেরোপাইট থ্রি বেশি সক্রিয়, সেই প্রশ্নে অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘এই চারটার মধ্যে কোনো একটা ভাইরাসের বিস্তার কোনো বছর বেশি হয়। ২০১৯ সালে টাইপ থ্রি বেশি হয়েছিল। গত বছরেও এই টাইপ থাকলেও তখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল।’
ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে কোনটি বেশি প্রাণঘাতী, সে বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রায় সবগুলোই এক রকমের। তবে কিছু টাইপ বেশি সংক্রামক, যেমন করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বেশি সংক্রমিত করে। ২০১৯ সালে টাইপ থ্রি বেশি ছড়িয়েছিল, তাই বলা যায় এটার সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, এখন বর্ষা মৌসুম, তাই এডিসবাহিত ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। তবে ডেঙ্গু ধরা পড়লেই হাসপাতালে আসার প্রয়োজন নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাসায় বসে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে যাদের শরীরে জটিলতা দেখা দেবে তারাই হাসপাতালে আসবেন। অর্থাৎ যাদের রক্তক্ষরণ বা তীব্র পেটে ব্যথার মতো লক্ষণ দেখা যায় তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই নন-কোভিড হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ন্যাশনাল গাইডলাইন ফলো করতে হবে। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ফ্লুইড সরবরাহ করা হয়েছে, যাতে কোনো সংকট দেখা না দেয়।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ১৬ মাসেও আলোর মুখ দেখেনি বিচার বিভাগীয় সুপারিশ
২০১৯ সালে ঢাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। প্রতিদিনই বাড়ছিল আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। ঠিক তখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমুটো) হয়ে রুল জারি করেন। রুল শুনানির ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের মার্চে হাইকোর্ট ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বিস্তারে দায়ীদের শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে করণীয় ঠিক করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ১০ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে।
এরপর ১৬ মাস অতিবাহিত হলেও ওই প্রতিবেদনের ওপর কোনো নির্দেশনা আসেনি। উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রতিবেদনটি এখনও ফাইলবন্দি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচার বিভাগীয় কমিটির সুপারিশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করলে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটা বাড়তো না। এ অবস্থায় বিচার বিভাগীয় কমিটির সুপারিশের আলোকে হাইকোর্ট কোনো নির্দেশনা দিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি শুনানির উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
ওই সময়ে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চে দায়িত্ব পালনকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত অনলাইন ভিত্তিক এক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ২০২০ সালের ৯ মার্চ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তারে দায়ীদের শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করা হয়। এর কিছুদিন পরেই করোনার কারণে আদালত বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ প্রদানকারী জ্যেষ্ঠ বিচারপতি তারিক উল হাকিম পদোন্নতি পেয়ে আপিল বিভাগে চলে যান। ফলে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চটি ভেঙে যায়। এ কারণে পরে বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনের ওপর আর শুনানি হয়নি।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষকে দ্রুত সুয়োমুটো রুলটি শুনানির উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান ওই সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আদালত অনেক সময় সুয়োমুটো আদেশ বা রুল জারি করেন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্ট তেমনি একটি আদেশ দিয়েছিলেন। আমি মনে করি সুয়োমোটো রুল ও বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনের বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে শুনানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত। রাষ্ট্রপক্ষ ভার্চুয়াল কোর্টেই এই শুনানির উদ্যোগ নিতে পারে।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় সুপারিশের আলোকে হাইকোর্ট কোনো নির্দেশনা দিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তা অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩১
আপনার মতামত জানানঃ