যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের আফগানিস্তান ত্যাগের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই রক্তক্ষয় বেড়েছে দেশটিতে। আফগান বাহিনী ও সশস্ত্র তালিবানদের সংঘর্ষে নিহত হচ্ছে বহু বেসামরিক মানুষ। আফগানিস্তানে ক্রমবর্ধমান সহিংসতায় এ বছরের প্রথম ভাগে রেকর্ড সংখ্যায় বেসামরিক মানুষ মারা গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
এদিকে আফগানিস্তানের একটি অলাভজনক সংস্থা নাইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে চলতি বছরের প্রথম ভাগে কমপক্ষে ৩০ গণমাধ্যম কর্মী সন্ত্রাসীদের হাতে হতাহত হয়েছেন।
রেকর্ডসংখ্যক বেসামরিক নিহত
জাতিসংঘের নতুন একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে এ পর্যন্ত ১,৬৫৯ বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। তাদের এই রিপোর্ট বলছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর ৪৭ শতাংশ বেশি মানুষ মারা গেছে।
জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
গতকাল সোমবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশন (ইউনামা)। সেখানে চলতি বছরের প্রথমার্ধে আফগানিস্তানে বেসামরিক মানুষের হতাহতের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।
জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘাত চলায় সেখানেই প্রধানত বেসামরিক নাগরিক নিহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। যদি এ সংঘাত ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে দেশটিতে মহাবিপর্যয় হতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে আফগানিস্তানে এক হাজার ৬৫৯ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত ও তিন হাজার ২৫৪ জন আহত হয়েছেন।
মে মাসে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার শুরু ও তালিবান হামলা বেড়ে যাওয়ার পর থেকে এ প্রাণহানি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে গেছে বলে ইউনামা জানিয়েছে।
জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, আফগানিস্তানের সংঘাত না কমলে ২০০৯ সালের পর বেসামরিক নাগরিকদের সর্বোচ্চ মাত্রার প্রাণহানি ঘটবে। জাতিসংঘ ওই বছর থেকে আফগানিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণহানির রেকর্ড রাখতে শুরু করেছিল।
ইউনামার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— আফগানিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের শতকরা ৩৯ ভাগ ঘটে তালিবানের হাতে, ২৩ ভাগ আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে, শতকরা ১৬ ভাগ অন্য সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর হাতে এবং উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের হাতে হতাহত হন শতকরা ৯ ভাগ বেসামরিক আফগান নাগরিক।
এ ছাড়া শতকরা ১৩ ভাগ হতাহতের ঘটনা ঘটে সংঘর্ষরত পক্ষগুলোর ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্দেশে আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়া হবে বলে কথা ছিল। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকেই তালিবানদের হামলা বেড়ে যায়। হামলা ঠেকানোর চেষ্টায় গত শনিবার থেকে দেশটির ৩৪ প্রদেশের মধ্যে ৩১টিতে রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করেছে আফগান সরকার।
ইউনামার প্রতিবেদনে এক বিবৃতিতে সংস্থাটির প্রধান ডেবরাহ লায়ন্স বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান সংঘাত যদি না কমানো যায়, তাহলে আফগানিস্তানে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হবে। মানুষ অঙ্গহানির শিকার হবে।’ সংঘাত কমাতে তালিবান ও আফগান নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তবে তালিবান এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি, তাদের হাতে কোনো বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটে না।
অন্যদিকে আফগান সেনাবাহিনী বলেছে, তারা সবসময় যুদ্ধের আইন মেনে চলে এবং তারা বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণহানির জন্য দায়ী নয়।
চলতি বছরে ৩০ গণমাধ্যমকর্মী হতাহত
আফগানিস্তানে চলতি বছরের প্রথম ভাগে কমপক্ষে ৩০ গণমাধ্যম কর্মী সন্ত্রাসীদের হাতে হতাহত হয়েছেন। এদের বেশিরভাগকে সরকারি কর্মকর্তারাও হুমকি দিয়েছেন বলে আফগানিস্তানের একটি অলাভজনক সংস্থা নাইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি কাবুলে বোমা বিস্ফোরণে দুই সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন নারী সাংবাদিক। এমনকি স্থানীয় সাংবাদিকরা অভিযোগ করেছেন, আফগানের বালখ প্রদেশে সরকারি কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় তথ্য দেয় না।
নাইয়ের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে খামা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, কিলিদ গোষ্ঠীর এক সাংবাদিককে কাবুল শহরের একটি ঘটনা কভার করতে বাধা দেওয়া দিয়েছিল পুলিশ। তাকে কাবুল পুলিশ হুমকিও দিয়েছিল। অন্যদিকে, আফগান পিস পাবলিকেশন ওয়াচের এক সাংবাদিককে সরকারি কর্মকর্তারা অপমান করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও, আফগানিস্তানের বাওয়ার মিডিয়ার ২৬ জন কর্মচারীকে উত্তর বালখ প্রদেশে ছাঁটাই করা হয়েছে এবং চার কর্মচারীকে মিডিয়া আউটলেটগুলোকে তথ্য দেওয়ার জন্য ভাইস-প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ বরখাস্ত করেছেন।
নাই গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় নিন্দা করেছে এবং এটিকে দেশের শ্রম আইনের ‘বিরুদ্ধে’ বলে অভিহিত করেছে।
এরইমধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র সংবাদ সংস্থার একটি জোট দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভদের দুটি পৃথক চিঠি লিখে আফগান সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মীদের বিশেষ অভিবাসন ভিসা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।
আফগান সেনাদের সহায়তায় বিমান হামলা অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র
তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীর সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলা অব্যাহত রাখবে। রবিবার এক শীর্ষ মার্কিন জেনারেল এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আফগানিস্তানজুড়ে তালিবানের সশস্ত্র হামলার বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এই অঙ্গীকারের কথা জানালেন মার্কিন জেনারেল। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে এ খবর ।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিদেশি সেনা আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়া শুরুর কয়েক দিনের মাথায় মে মাসের শুরু থেকেই তালিবান হামলা জোরদার করে। মার্কিন সেনাদের ৯০ শতাংশ চলে গেছে। ৩১ আগস্টের মধ্যে সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হবে। এই সুযোগে তালিবানরা দেশটির প্রায় অর্ধেক জেলা, সীমান্ত ক্রসিং ও বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক রাজধানী ঘিরে রেখেছে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি বলেন, কয়েক দিন ধরে আফগান বাহিনীর সমর্থনে বিমান হামলার সংখ্যা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তালিবান হামলা অব্যাহত রাখলে আগামী সপ্তাহগুলোতে এই সহযোগিতার মাত্রা আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।
মার্কিন জেনারেল স্বীকার করেছেন, আফগান সরকারের জন্য সামনে কঠিন দিন অপেক্ষা করছে। তিনি বলেন, তালিবানরা তাদের অভিযান নিয়ে অনিবার্যতাবোধ তৈরি করতে চাইছে। তারা ভুল। তালিবানের জয় অনিবার্য নয়।
তিনি জানান, ৩১ আগস্ট সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পরও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের বিমান বাহিনীকে লজিস্টিক্যাল সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। তার কথায়, ৩১ আগস্টের পরও আমরা আফগান বাহিনীকে সমর্থন অব্যাহত রাখবো। সাধারণত বাইরে থেকে এই সহযোগিতা করা হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ