মাদকসংক্রান্ত মামলার তদন্ত করে কোনো তথ্যের সঠিক বিশ্লেষণ দেয়নি সিআইডি। মাদকদ্রব্য কে পাঠালো, কাকে পাঠালো, কে পৌছে দিলো, অর্থের যোগানদাতা কে এসব বিষয় অর্থাৎ মাদকের পুরো রুট চিহ্নিত করার নির্দেশনা আছে। কিন্তু এসব বিষয়সহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তদেশীয় সহযোগী কারা—তা চিহ্নিত না করেই আলোচিত এক মাদক মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। ওই মাদক বাংলাদেশের রুট ব্যবহার করে পাচার করা হয়েছে কি না, তা–ও উল্লেখ করা হয়নি অভিযোগপত্রে।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কায় বিপুল পরিমাণ হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হন এক বাংলাদেশি নারী। ঘটনার প্রায় ১১ মাস পর ২০১৯ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে গ্রেপ্তারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে এখনও মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়নি।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, শ্রীলঙ্কায় ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম ৩২ দশমিক ৩২৯ কেজি হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশি নারী সূর্যমণি। ১৫ দিন পর ৩১ ডিসেম্বর দেওয়ান রাফিউল ইসলাম ওরফে হিরো ও জামাল উদ্দিনকে একটি ভাড়া বাসা থেকে ২৭০ দশমিক ৩০ কেজি হেরোইন এবং ৫ দশমিক ২৯৮ কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করে শ্রীলঙ্কার পুলিশ।
শ্রীলঙ্কায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সে দেশ ভ্রমণ করলেও মামলার অভিযোগপত্রে ওই তিনজনকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
অভিযোগপত্রে নাম এসেছে ১৪ জনের
উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কালীগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম করিমপুরের মেয়ে সূর্যমণি পরিবারের অভাব মেটাতে ১০ বছর আগে ঢাকায় এসে গৃহকর্মীর কাজ করেন। পরে একটি গার্মেন্টসে সুইং সহযোগী হিসেবে কাজ নেন। সেখান থেকে উত্তরায় একটি বায়িং হাউসে কাজ পান তিনি। এরপরই বদলে যেতে থাকে তার জীবন। তিনি নিয়মিত বিরতিতে মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে যেতেন।
সেই মেয়েটিই শ্রীলঙ্কায় বিপুল পরিমাণ হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হন। ১৫ দিন পর তার দুই সহযোগী দেওয়ান রাফিউল ইসলাম ও জামাল উদ্দিনকে বিপুল পরিমাণ হেরোইন, কোকেনসহ শ্রীলঙ্কার পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়। তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশের পুলিশ। একটি অনুসন্ধান কমিটিও গঠন করে সিআইডি। এরপর শ্রীলঙ্কায় গ্রেপ্তার তিনজনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চয়েজ রহমান নামের একজন বায়িং হাউসের মালিককে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর উত্তরা থানায় মামলা করে সিআইডি। তদন্তে নেমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতে পারেন, চয়েজ রহমানের বায়িং হাউসে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন সূর্যমণি। তার একাধিক পাসপোর্ট রয়েছে। দুটি পাসপোর্টই চয়েজ রহমান করে দিয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় গ্রেপ্তার অপর দুজনের মধ্যে রাফিউল ইসলামও চয়েজ রহমানের প্রতিষ্ঠানের কর্মী। আর জামাল উদ্দিন বগুড়ার একজন মাদক কারবারি। তারা আন্তদেশীয় মাদক পাচারকারী চক্রের সদস্য বলে পুলিশ তখন জানায়।
অভিযোগপত্রে নাম আসা ১৪ জনের মধ্যে চয়েজ রহমান ছাড়া ৬ জনই তার প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছিলেন। এই মামলায় গ্রেপ্তার চয়েজ রহমানসহ ৯ জন এখন কারাগারে। ৪ জন পলাতক। শেখ আহমেদ হোসেনের নাম–ঠিকানা সঠিক না পাওয়ায় তাকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কারাগারে থাকা আসামিরা হলেন শাহীনা আক্তার, আফসানা মিমি, পারভেজ শেখ, ফাতেমা ইমাম তানিয়া, রুহুল আমিন সায়মন ব্যাপারী, সালমা সুলতানা ওরফে স্বপ্না, সোহরাব হোসেন ও শারমিন আক্তার মায়া। শ্রীলঙ্কায় গ্রেপ্তার তিনজন ছাড়া পলাতক রয়েছেন শেখ মোহাম্মদ আরিফ। তিনি চয়েজ রহমানের বায়িং হাউসের ব্যবস্থাপক ছিলেন। আসামিদের মধ্যে শাহিনা আক্তার চক্রের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। শ্রীলঙ্কায় তাঁর নামে ভাড়া করা বাসা থেকেই রাফিউল ও জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ।
সূত্র পেলেও তা নিয়ে আগায়নি তদন্ত
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আসামিরা আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী দলের সদস্য। তারা দেশ-বিদেশ থেকে এগুলো সংগ্রহ করেন। এরপর এসব মাদক বিভিন্ন দেশে পাচার করেন। কিন্তু এসব মাদক তারা কখন, কোথা থেকে, কীভাবে সংগ্রহ ও পাচার করেছেন—অভিযোগপত্রে তা সুনির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি। মাদকগুলো পাচারের রুট সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই অভিযোগপত্রে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, চয়েজ রহমানের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপের ফরেনসিক পরীক্ষা করে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ল্যাপটপে ‘ড্রাগ মাফিয়া’ নামে একটি নথি পাওয়া যায়। এ ছাড়া ‘বিগ বস’, ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’, ‘টুডেস ফটো’, ‘ওয়ার্কার্স’ নামে কয়েকটি ফোল্ডারও পাওয়া যায়। ল্যাপটপে একটি চিঠিও পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছে, “প্রিয় স্যার, চোরাচালানকারী গ্রুপ পাকিস্তান থেকে হেরোইনের কনটেইনার মালয়েশিয়ায় সরবরাহ করা হয়েছে। সেখান থেকে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হবে। ‘বস’ এবং তার ‘ডানহাত’ মালয়েশিয়ায় তিন দিন ধরে অবস্থান করছেন। দয়া করে তাদের খুঁজে বের করেন এবং পর্যবেক্ষণ করেন।” ল্যাপটপে একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর এবং একটি ভাইভার নম্বর পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরের পাশে লেখা রয়েছে বস এবং ভাইভার নম্বরের পাশে লেখা ‘দ্য সেকেন্ড বস’।
কিন্তু ফরেনসিক পরীক্ষায় পাওয়া এসব তথ্যের সূত্র ধরে তদন্ত এগোয়নি। বস, সেকেন্ড বসের হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইভার নম্বর পাওয়ার পরও তাদের চিহ্নিত করা হয়নি। পাকিস্তান থেকে মালয়েশিয়ায় সরবরাহ করা হেরোইনের কনটেইনার কবে পাঠানো হয়েছে। সেখানে কী পরিমাণ হেরোইন ছিল, কারা এবং কীভাবে এটা পাচার করেছে, কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে—এসব বিষয় তদন্তে উঠে আসেনি। ‘বস’ এবং ‘ডানহাত’ বলে যাদের সম্বোধন করা হয়েছে, তারা কারা—এ বিষয়েও কোনো তথ্য নেই।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার) ফারুক হোসেন এ বিষয়ে গনমাধ্যমকে বলেন, শ্রীলঙ্কায় মাদক উদ্ধারের ঘটনায় যথাযথ অনুসন্ধান ছাড়া মামলা নেওয়াটাই ভুল ছিল। পরে তদন্ত করতে গিয়ে কোনো কূলকিনারা পেলেন না তদন্তকারীরা। শ্রীলঙ্কা থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের পরিচয় বের করতে তদন্তকারীদের ঘাম ছুটে গেছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে এক নাম, পাসপোর্টে আরেক নাম। তিনি বলেন, গডফাদার নিয়ে অনেক জটিলতা ছিল। অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা যায়নি।
তদন্ত তদারক কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তখন শ্রীলঙ্কায় গিয়ে সে দেশের পুলিশপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার কারা জড়িত ছিল, এ তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু তাদের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
এদিকে কূটনৈতিক সূত্র বলছে, শ্রীলঙ্কান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে সে দেশের পুলিশ তদন্ত করে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে অবস্থানকারী চক্রের বিষয়ে পাওয়া তথ্য বিস্তারিত জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশকে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তখন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এই চক্রের নেটওয়ার্ক মধ্যপ্রাচ্য থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। শ্রীলঙ্কায় গ্রেপ্তার তিনজন মাদকের বাহক ছিল।
বিষয়টি বিদেশে আলোচিত হলেও বাংলাদেশে গাফিলতির কমতি নেই
সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গনমাধ্যমকে বলেন, শ্রীলঙ্কায় মাদক উদ্ধারের ওই ঘটনা দেশে–বিদেশে ব্যাপক আলোচিত ছিল। এ ধরনের স্পর্শকাতর মামলা তদন্ত করতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়। এই মামলায়ও একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপারকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার বদলির পর একজন উপপরিদর্শককে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদারকিতেও গাফিলতি ছিল। এই কর্মকর্তা বলেন, সঠিকভাবে তদন্ত করলে মাদকসংশ্লিষ্ট একটি আন্তদেশীয় চক্রের বিস্তারিত তথ্য তুলে আনা যেত। রুটটি চিহ্নিত করা গেলে মাদকবিরোধী নজরদারিরও সুযোগ পাওয়া যেত। রুট ও চক্রের দেশি-বিদেশি সদস্যরা চিহ্নিত না হওয়ায় দেশের ভেতর দিয়ে মাদক পাচারের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের সহকারি কৌসুলি মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্রে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণের উল্লেখ করতে হয়। তা না হলে আসামিরা সুবিধা পায়। এ মামলায় অবশ্যই বাংলাদেশের অংশে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। মাদক পাচারে জড়িত বিদেশিদের চিহ্নিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৮০৮
আপনার মতামত জানানঃ