মহামারী করোনাভাইরাস একদিকে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, অন্য দিকে আক্রান্ত করছে মনকেও। কারণ করোনাভাইরাস সংকটে কর্মক্ষেত্র কমে যাওয়ায় বাড়ছে বেকারত্ব, বিভিন্ন পেশায় কর্মরতরা বেকার হয়ে পড়ছে; ফলে শিক্ষিত তরুণদের কর্মের সুযোগও সীমিত হয়ে পড়েছে। হতাশাগ্রস্ত তরুণদের অনেকে হচ্ছে বিপথগামী।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনেকেই ভুগছেন মানসিক সমস্যায়। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন অথবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ঘরবন্দি থাকার কারণে বাড়ছে পারিবারিক কলহ-বিবাদ, এতে অবসাদগ্রসস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে।
চলছে করোনাভাইরাসের সংকটময় সময়। আর এই সময় একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমস্যা কুরে কুরে খাচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে। বয়স্কদের তুলনায় তরুণতরুণীরা অনেক বেশি করে শিকার হচ্ছেন একাকিত্বের। চরম একাকিত্বে ভুগছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ, বাড়ছে পরিবার-স্বজন-সমাজ ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তাদের দূরত্ব।
নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।
‘এজ অফ এলিয়েনেশন’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘কয়েক দশক ধরে বাড়তে থাকা যোগাযোগবিচ্ছিন্নতা আর ১৫ মাসের লকডাউনের পর তরুণদের বন্ধুর সংখ্যা কমছে। তারা মানুষের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন এবং অসংখ্য তরুণ আরও বেশি যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।
‘প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এ সংখ্যা কেবলই বাড়ছে।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণাটিতে দেখা যায়, ৩৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে যাদের একজন বন্ধুও নেই কিংবা একজনই বন্ধু আছেন, এমন মানুষের সংখ্যা গত ১০ বছরে তিন গুণ বেড়েছে। এক দশক আগে এ হার ছিল সাত শতাংশ, যা বর্তমানে ২২ শতাংশ।
আর চার বা ততোধিক বন্ধু আছে, এমন মানুষের সংখ্যা ১০ বছরে ৬৪ শতাংশ থেকে কমে ৪০ শতাংশে নেমেছে।
গবেষণাটি করেছেন থিংক ট্যাংক অনওয়ার্ডের পরিচালক উইল ট্যানার। তিনি বলেন, ‘তরুণরা একাকিত্বের মহামারিতে ভুগছেন। একাকিত্বের এই সমস্যার সমাধান না হলে এর মারাত্মক পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সমাজকে এক সুতোয় বেঁধে রাখার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলব আমরা।’
তরুণরা একাকিত্বের মহামারিতে ভুগছেন। একাকিত্বের এই সমস্যার সমাধান না হলে এর মারাত্মক পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সমাজকে এক সুতোয় বেঁধে রাখার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলব আমরা।’
গবেষণায় দেখা যায়, ২০ বছর আগে ৩৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা কম বলা ও সাহায্য দেয়া-নেয়ার প্রবণতা কম ছিল। ফলে তখনও তাদের মধ্যে আস্থায় ঘাটতি ছিল।
যারা ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে জন্মেছেন এবং যারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মেছেন, তাদের বেশির ভাগই ধর্মীয় বা দলবদ্ধ কার্যক্রমে অনীহা প্রকাশ করেন।
দেখা যাচ্ছে, বয়স যত কম, অন্যের প্রতি অনাস্থার প্রবণতা তত বেশি। অন্যদিকে ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে আস্থার প্রবণতা বেশি।
গবেষণা প্রতিবেদনের লেখক লর্ড জেমস ও’ শঘনেসি বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে সামাজিক বন্ধনে ক্ষয় শুধু ভৌগোলিক কারণে নয়, এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে।
‘এটি ভীষণ উদ্বেগজনক। সামাজিক বন্ধনের দৃঢ়তা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি, মানুষের সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির উৎস।’
একাকিত্বের কারণ হিসেবে বলা হয়, ভবিষ্যৎ, কর্মজীবন ও জীবিকা উপার্জন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগা তরুণদের একাকী জীবন বেছে নেয়ার অন্যতম কারণ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘ সময় কাটানো সত্ত্বেও ব্যক্তিজীবনে একাকিত্বে ভোগেন বেশির ভাগ তরুণ।
করোনা আতঙ্কের মধ্যে সম্প্রতি একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি সমীক্ষার রিপোর্ট। ‘লোনলিনেস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড: এজ, জেন্ডার অ্যান্ড কালচারাল ডিফারেন্সেস ইন লোনলিনেস’ শিরোনামের ওই স্টাডিতে বিভিন্ন বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থান ও লিঙ্গের মানুষের জীবনে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা কতটা প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, বিশ্বের ২৩৭টি দেশ, দ্বীপ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৫৫ হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের বয়স ১৬ থেকে ৯৯ বছর।
গ্রেট ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব এক্সটারের অধ্যাপক এবং অন্যতম সমীক্ষক ম্যানুয়েলা ব্যারেটোর ভাষ্য মতে, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা নিয়ে সাধারণভাবে যা ভাবা হয়, আমাদের সমীক্ষায় তার বিপরীত ছবি উঠে এসেছে। জনপ্রিয় ধারণা হলো, মূলত বয়স্করাই একাকিত্বের সমস্যায় ভোগেন। কিন্তু আমাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্মই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন।
শিশু মনোবিজ্ঞানী এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আই প্যারেন্টস-১০১-এর প্রতিষ্ঠাতা ড. অ্যাডাম প্ল্যাটার প্রযুক্তির দুনিয়ায় কিশোর-তরুণ প্রজন্মটিকে ‘ডিজিটালি নেটিভ সিটিজেন’ বা ‘প্রযুক্তি দুনিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা’ এবং তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে ‘ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্টস’ বা ‘প্রযুক্তি দুনিয়ার অভিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি বলেছেন, এই দুটি প্রজন্মের মধ্যে অবস্থানগত পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবে তিনি মনে করেন, অভিবাসীদের স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ন্ত্রণ করার এ প্রবণতা সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলছে। ফলে দুটি প্রজন্মের মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব আর অবিশ্বাস, সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, তৈরি হচ্ছে জটিলতা।
মনোস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা জীবনে কখনো কখনো দুঃশ্চিন্তা, হতাশা, বিষন্নতা ও একাকিত্ব অনুভব করি। মাঝে মাঝে এই অনুভূতিগুলো এতটাই অসহনীয় হয়ে পড়ে যে, তা নিজের পক্ষে সামলানো সম্ভব হয় না। তখন আমরা মনে করি এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই এবং এটি আমাকে সারাজীবনই বয়ে বেড়াতে হবে। ফলে, আমরা বিভিন্ন রকম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এবং কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথও বেছে নেয়। যার ফলশ্রুতিতে, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্রমগত অবনতি হচ্ছে এবং হারিয়ে ফেলছি অনেক মূল্যবান প্রাণ।
তারা বলেন, মানসিক এ ধরনের অবসাদ দূর করতে দরকার সঠিক কাউন্সিলিং। তার জন্য পরিবারের মানসিক সহযোগিতার পাশাপাশি একজন পেশাগত কাউন্সিলরের সহযোগিতা নেয়া দরকার। পেশাগত কাউন্সিলর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগত থেরাপি প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্ম-উন্নয়ন ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকেন। ফলে সমস্যা ও মানসিক অবসাদ কাটিয়ে ওই ব্যক্তি নিজেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৩
আপনার মতামত জানানঃ