বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। এখানকার তরুণ জনশক্তিকে দেখা হয় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হিসেবে। নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, এ যুব শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ আদায় করে নিতে সক্ষম হবে। কিন্তু দেশে এখন তরুণ কর্মজীবীর (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী) সংখ্যা কমছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে দেশে তরুণ জনশক্তির সদস্যসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার। সে অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে দেশে যুব শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়েছে ৫ শতাংশের বেশি। শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত যুবকের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৪ লাখ ৬০ হাজার।
এক্ষেত্রে মূলত পুরুষ শ্রমশক্তিই কমেছে সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের এ পরিসংখ্যান উদ্বিগ্ন করে তুলছে বিশেষজ্ঞদের। যুব শ্রমশক্তি সংকোচনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা বলছেন, এক্ষেত্রে জন্মহার কমার একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তা আগামীতেও অব্যাহত থাকতে দেখা যেতে পারে।
তাছাড়া দেশে তরুণদের কাজের সুযোগও কম। অনেকে কাজ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আবার বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণেও এমনটি হয়ে থাকতে পারে। তবে প্রবৃদ্ধি কমায় শিল্প খাতে তরুণ জনশক্তি সংকোচনের প্রভাব সেভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে না।
বিবিএসের জরিপের তথ্যমতে, ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের শ্রমশক্তিতে যুবকের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার। সে হিসাবে গত প্রান্তিকে তিন মাসের ব্যবধানে যুবশক্তি কমেছে ৩ লাখ ৬০ হাজার।
ব্যুরোর প্রতিবেদনে উঠে আসা লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে পুরুষ যুব জনশক্তি ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার। এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে পুরুষ জনশক্তি কমেছে ৯ লাখ ৮০ হাজার। আর গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে নারী যুবশক্তি ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার, যা এবার কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজারে।
বহুমাত্রিক কারণে এমনটা হতে পারে বলে মনে করছেন জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শ্রমশক্তিতে নিযুক্ত লোকজনের অধিকাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাই মৌসুম পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় কাজ বেশি বা কম থাকে। তখন কাজে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যায় পার্থক্য দেখা দেয়। আবার যথাযথ কর্মসংস্থান না থাকায় অনেকে কাজের সন্ধানে বিদেশে চলে যান। কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্যও বিদেশে যান। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এমন স্থানান্তর বেশি দেখা যায়।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন ১৩ লাখ ৫৪ হাজার বাংলাদেশী। এ বছর এখন পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৩৭।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সুযোগ না থাকায় কর্মে যুক্ত হতে পারছেন না তরুণরা। বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে এত বেশিসংখ্যক যুবশক্তি কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। এটা তথ্য সংগ্রহের কোনো ত্রুটির কারণেও হতে পারে।’
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে এখন ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। এর মধ্যে ৭ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। এছাড়া শ্রমশক্তির বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নয়, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়। এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার। তারা মূলত শিক্ষার্থী, অসুস্থ, বয়স্ক, কাজে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মে অনিয়োজিত বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক ব্যক্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা বলেন, ‘তরুণরা যদি মনে করেন কাজ পাওয়া কঠিন বা চাকরি পাওয়া যাবে না, তাহলে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে কাজ নাও খুঁজতে পারেন।
তখন ডিসকারেজড ওয়ার্কফোর্স হিসেবে তাদের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কারণ শ্রমশক্তিতে যুক্ত থাকতে হলে কাজ খোঁজার মধ্যে থাকতে হবে। এটাও তরুণ জনশক্তি হ্রাসের একটি কারণ হতে পারে। কর্মে যুক্ত তরুণদের বড় অংশই ঢাকায় কাজ করে। দেশের অন্য বিভাগে একইভাবে কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে তরুণদের বেকারত্বের কারণে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নিতে পারছে না।’
দেশের আর্থিক ও জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি যুব শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়ে আসার পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতারা। তবে উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি কমে আসার কারণে শিল্প খাত বিষয়টি এখনো সেভাবে অনুধাবন করতে পারছে না বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘তরুণরা শিল্প খাতের প্রধান শক্তি। এটা কমে গেলে শিল্পে প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। গত নয় মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশের কিছু বেশি। তাই শিল্প খাতে এখন শ্রমের চাহিদা নেই। বিবিএসের তথ্যে বেকার বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি না থাকায় এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। প্রবৃদ্ধি থাকলে হয়তো তরুণ শ্রমশক্তি কমে যাওয়ার ব্যথাটা অনুভব করত শিল্প খাত। আর সুদহার বৃদ্ধি ও গ্যাস সংকটের কারণে আগামীতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান আমি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘জন্মহার কমে যাওয়ায় দেশের তরুণ জনশক্তি কমে যাচ্ছে। এটা ক্রমাগত কমে আসবে। ২০৩৫-৩৬ সালের মধ্যে যুবকদের তুলনায় নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। আর তরুণদের ৩০ শতাংশ আবার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মে নেই।
নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও আমরা তাদের কোনো কিছুতে যুক্ত করতে পারিনি। ধীরে ধীরে যুবকের সংখ্যা কমে বেকারের চাপও কমে আসবে। বয়স্ক মানুষ বাড়বে। তাই কর্মক্ষম ও অভিজ্ঞদের কাজে লাগাতে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ থেকে বাড়িয়ে ৬২ বছর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি যুক্ত করা যায়।’
আপনার মতামত জানানঃ