সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার খেলায় মত্ত হয়েছে। এই দুটি দেশই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিজেদের বলয়ে আনার মাধ্যমে ভূ-রাজনীতিতে নিজেদের করায়ত্ত বজায় রাখার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।
করোনা মহামারির এই সংকটময় সময়ে আধিপত্য বজায় রাখার এই প্রতিযোগিতায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভ্যাকসিন কূটনীতি। করোনা মোকাবিলায় সহযোগিতা করার জন্য ভারত দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপে অনুদান হিসেবে লাখ লাখ ডোজ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে। ভ্যাকসিন কূটনীতি ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ভারতের বিভিন্ন উদ্যোগ চলমান রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, সহযোগিতা ও কৌশলগত নানা চুক্তি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে ভারত প্রতিনিয়ত আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখতে ভারত তার ভৌগোলিক অবস্থানকে যথাযথভাবেই ব্যবহার করে থাকে।
অন্যদিকে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি চীন ইতোমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। চীন যদিও ভারতের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চীনের আগ্রহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ভারতের আধিপত্যের লাগাম টানতে চায়। এজন্য চীন কয়েক বছর ধরেই আদাজল খেয়ে লেগেছে।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের হাত ধরে কোয়াড গঠনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার প্যাসিফিক অঞ্চলে যে আধিপত্য তৈরি করতে চাইছে, এর বিরুদ্ধে চীন অনেকটাই উঠেপড়ে লেগেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের দৌরাত্ম্য থামাতে চাইছে চীন। আর তাই দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য নতুন নতুন কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন।
সর্বশেষ পদক্ষেপ হলো গত বৃহস্পতিবার চংকিং শহরে চীন-দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর দারিদ্র্য নির্মূল ও সমবায় উন্নয়ন কেন্দ্র চালু করা। প্রায় কোমায় থাকা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সার্ক-এর আট সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে পাঁচটি বেইজিং নেতৃত্বাধীন উদ্যোগে যোগ দিয়েছে। ভারত, ভুটান ও মালদ্বীপ নিজেদের অনুপস্থিতি দ্বারা অবস্থান স্পষ্ট করেছে। নেপালের সংবাদমাধ্যম কাঠমাণ্ডু পোস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানা গেছে।
কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন সার্ক প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে পড়ে তখন ভারতকে বাদ দিয়ে এই উদ্যোগ নেয় বেইজিং। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল ভারতকে মোকাবিলা এবং অঞ্চলটিতে চীনের উপস্থিতি শক্তিশালী করা। এটির গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে।
নেপালের দুই প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ও জাতিসংঘে দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রদূত দিনে ভট্টারাই বলেন, যদি দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য নির্মূল গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হয় তাহলে কেন ভারতকে বাইরে রাখা হয়েছে? দেশটিতে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ রয়েছে, যা সাব-সাহারা অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের সমান। আমি এই কেন্দ্র গঠনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত তাৎপর্য ও অর্থ রয়েছে বলে মনে করি। চীনের সঙ্গে ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
চীনা এই উদ্যোগ এমন সময় গতি পেল যখন ভারত সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টার পাশাপাশি আরেকটি আঞ্চলিক ব্লক বিমসটেক-এ মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল কোঅপারেশন (বিমসটেক)-এ সাতটি রাষ্ট্র যোগ দিয়েছে। এসব দেশ বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী ও সন্নিহিত অঞ্চলের।
নেপালে চায়না স্টাডি সেন্টারের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত সুন্দর নাথ ভট্টরাই বলেন, ‘এটি যে চীনের নেতৃত্বে ‘মাইনাস ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ, তা স্পষ্ট। দক্ষিণ এশীয় যেসব দেশ চীনা নেতৃত্বে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভস-এর অংশ তারাই এর অংশীদার। শেষ পর্যন্ত মালদ্বীপও এতে যুক্ত হবে, কারণ তারা বিআরই-এ যুক্ত হয়েছে’।
এ কেন্দ্র গড়ে তোলার ধারণা প্রথম তুলে ধরা হয় দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ির এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল বৈঠকে। করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠকটি আয়োজন করা হয়েছিল। ওই বৈঠকে ভারতকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও দেশটি অংশগ্রহণ করেনি।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, চীন, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে চীনা সরকারের পক্ষে স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ইয়ি প্রস্তাবিত চীন-দক্ষিণ এশীয় দেশের দারিদ্র্য নির্মূল ও সমবায় উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
তবে এ কেন্দ্র কীভাব কাজ করবে, অর্থায়ন কীভাব হবে তা বিস্তারিত জানায়নি চীন। তবে নেপালের মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, উদ্বোধনী অধিবেশনে দক্ষিণ এশীয় পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রদূত চীনের এ উদ্যোগকে সমর্থন করেছেন।
নেপালের কর্মকর্তারা জানান, এ কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সহযোগিতার জন্য চীন-দক্ষিণ এশীয় দেশের জরুরি সরবরাহ মজুদ চালু করেছে চেংদু শহরে। আরেকটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে চাইছে বেইজিং, সেটি হলো গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র নির্মূলে চীন-দক্ষিণ এশীয় দেশের ই-কমার্স সহযোগিতা ফোরাম।
নয়া দিল্লিভিত্তিক মনোহর পারিকার ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস-এর রিসার্চ ফেলো নিহার নায়ক বলেন, চীন দক্ষিণ এশিয়াকে টার্গেট করেছে এবং সার্কের পাল্টা সংস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। তাই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগের নামে সংযুক্ত হচ্ছে।
চীন দক্ষিণ এশিয়াকে টার্গেট করেছে এবং সার্কের পাল্টা সংস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। তাই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগের নামে সংযুক্ত হচ্ছে।
নেপালের সাবেক উপদেষ্টা ভট্টরাইয়ের মতে, সার্ক এখন সাইডলাইনে এবং প্রায় মৃত হওয়ায় চীনের এ নতুন উদ্যোগ তাৎপর্যপূর্ণ গুরুত্ব রাখে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্প্রতি তিব্বতের নির্বাসিত নেতা দালাই লামাকে ফোনে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোকে ভারতের চীননীতি থেকে বড় ধরনের সরে যাওয়া বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
ভট্টরাই মনে করেন, চীনা নেতৃত্বাধীন দক্ষিণ এশীয় ব্লকটি হতে পারে হিমালয়ান কোয়াড গড়ে তোলার পরিকল্পনা। যা ওয়াশিংটন নেতৃত্বাধীন কোয়াডের পাল্টা ব্লক হবে এবং এতে ভারত সক্রিয় সদস্য।
নায়ক বলেন, তারা মালদ্বীপকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না, কারণ এখানে চীনের সামুদ্রিক স্বার্থ রয়েছে এবং চীনের বিআরআই-এর অংশও দেশটি। পাকিস্তান তাদের সব সময়ের বন্ধু এবং তাদের পরের টার্গেট আফগানিস্তান ও পরে বাংলাদেশে। সবশেষে আসবে নেপালের পালা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীন-ভারত দ্বন্দ্বের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে কোয়াড। কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ; যা সংক্ষেপে কোয়াড নামে পরিচিত। সম্প্রতি এই জোট নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সমন্বিত কোয়াডের প্রধান উদ্দেশ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো কার্যকর করে তুলতে এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, অবাধ বাণিজ্য ও নৌ-চলাচলসহ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নানামুখী সহযোগিতার ক্ষেত্র গড়ে তোলা হলেও চীন এটাকে নিজের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবেই দেখছে। তারই বিকল্প হিসাবে গড়তে চাইছে এই ব্লক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৪
আপনার মতামত জানানঃ