বরিশাল জেলা ডিবির ওসি মিজানুর রহমানের স্ত্রীর নির্যাতন সইতে না পেরে পালিয়েছিল ওসির বাড়ির শিশুগৃহকর্মী। পরে রাস্তায় ধরে ওসির স্ত্রী আবারও প্রকাশ্যে মারধর করতে থাকেন। নগরীর চৌমাথা বাজার এলাকায় এ ঘটনার সময় উপস্থিত লোকজন বাঁধা দিতে গেলে ওসির ছেলেও স্থানীয়দের সাথে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে।
গৃহকর্মীকে উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর চৌমাথা বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, নির্যাতনের শিকার শিশু গৃহকর্মীর নাম মনি (১২)। সে বাবুগঞ্জ উপজেলার পিতা মন্টু হাওলাদারের মেয়ে। রুপাতলী এলাকায় ডিবি ওসির মিজানুর রহমানের বাসায় কাজ করতেন। এ সময় তাকে অনেকবারই নির্যাতন করা হয়। এ কারণে আজ সে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। এরপর তাকে নগরীর চৌমাথা এলাকায় মিজানুর রহমানের স্ত্রী রাস্তায় মারধর করে।
প্রত্যক্ষদর্শী রফিকুল ইসলাম হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মেয়েটি চৌমাথা বাজারের সামনের রাস্তা পার হইতেছিল। এর মধ্যে এক নারী ও একজন ছেলে শিশু মাইয়াডার হাত ধইরা টান দেয় এবং ওরে মারা শুরু করে। এই সময় মাইয়াডা চিল্লাইয়া কইতে থাহে যে, মুই আমনেগো লগে যামু না, ওই বাসায় মইরা গেলেও যামু না। হেই সময় লোকজন জমা হইয়া যায় এবং শিশুটিকে মারার কারণ জানতে চায়। পাশাপাশি মারধরকারী ওই নারী ও ছেলেকে পুলিশে দেয়ার কথা কইলে পুলিশের মায়রে বাপরে তুইলা গালাগাল করে।
মমতাজ নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘মানুষ মানুষরে এমনে পিডাইতে পারে না। ওরা জানোয়ার। গরিব মারলে তো আর বিচার হইবে না। হেরা বড় মানুষ। ওই পোলায় জানাইছে হের বাপেও ডিবির বড় অফিসার।’
‘মানুষ মানুষরে এমনে পিডাইতে পারে না। ওরা জানোয়ার। গরিব মারলে তো আর বিচার হইবে না। হেরা বড় মানুষ। ওই পোলায় জানাইছে হের বাপেও ডিবির বড় অফিসার।’
১২ বছরের ওই শিশু গৃহকর্মী অভিযোগ করে বলে, ‘গেল ছয় দিন ধরে আমি জেলা ডিবির পরিদর্শক মিজানুর রহমানের বাসায় কাজ করেছি। এই সময়ে আমাকে অনেকবারই বকাঝকা করা হয়েছে। আজ আমি বাসা থেকে পালিয়ে আসি। নগরীর চৌমাথা এলাকায় আমাকে ধরে মারধর করেন মিজানুর রহমানের স্ত্রী। এ সময় তার ছেলেও চড়-থাপ্পড় দেয়।
অভিযুক্ত নারীর স্বামী জেলা ডিবির পরিদর্শক মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘তিন দিন আগে শিশুটির মা-বাবা আমাদের বাসায় রেখে যান। আমার স্ত্রী অসুস্থ। আজ সকালে সে রিপোর্ট দেখানোর জন্য বাইরে বের হয়েছে। আমি বাসায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এই সুযোগে শিশুটি ঘরের বাইরে বের হয়ে যায়।
১২ বছরের শিশুকে আপনার বাসায় কী কারণে রেখেছেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শিশুটি অসহায় হওয়ায় তার মা আমার বাসায় দিয়ে গেছে। আমার সন্তানদের সঙ্গী হিসেবে থাকত শিশুটি। তাকে গৃহকর্মী হিসেবে রাখা হয়নি।
বরিশাল কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুটির সঙ্গে কথা বলেছি। ছয় দিন আগে সে ওই বাসায় কাজ শুরু করেছে। সেখানে বকাঝকা করায় মেয়েটি ক্ষুব্ধ হয়ে বাসা থেকে আজ সকালে বের হয়ে যায়।
পরিদর্শকের পরিবারের লোকজন খুঁজতে বের হয়, ঘটনাস্থলে এসে শিশুটিকে পেলে তারা বাসায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মেয়েটি না যেতে চাইলে টানাহেঁচড়া হয়। যে বিষয়টি দৃষ্টিকটু। পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধার করে হেফাজতে নেয়। শিশুটি বর্তমানে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রয়েছে। তার পরিবার এসে অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। যারা শিশুটিকে মারধর করেছেন তাদের নাম জানাতে পারেননি ওসি।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, যেহেতু শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেহেতু শিশুটিকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। ভিকটিমের জবানবন্দি ও বাবা-মায়ের অভিযোগ সবকিছু শুনেই ঘটনার তদন্ত করে যা সামনে আসবে সেভাবেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন সবার জন্য সমান। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু গৃহকর্মীরা এ শারীরিক ও মানসিক আঘাত পাওয়া তাদের অনেকেই ভাগ্যলিপি বলে মেনে নিয়েছে। তাদের অধিকার, পাওনার কথা খুব কমই গোচরে আসে। গোচরে আসে কেবল তখনই, যখন তারা মৃত্যুশয্যায়। যে মা-বাবা তাদের প্রিয় সন্তানকে অভাবের তাড়নায় বাসায় কাজ করতে পাঠায় তারা মনে করে হয়তো ভালোই আছে তাদের আদরের সন্তান। তবে বাস্তবতা হলো দু’টির জায়গায় তিনটি মরিচ পোড়ানোর জন্য, ভাত বেশি গলে বা পুড়ে গেলে, গৃহকর্ত্রীর সন্তান একটু আঘাত পেলে, প্লেট ভেঙ্গে ফেললে, আরো কত রকম কারণে একজন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার তার হিসাব কেউ রাখে না। অনেক সময় তারা যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়।
তারা বলেন, অবস্থা দেখে মনে হয়, এদেশে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ হওয়ার নয়। একেবারে লাগাতার ‘চলছে ও চলবে’ পরিস্থিতি। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের অপরাধের গুরুত্ব বুঝে এদের দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি কার্যকর করা উচিত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে এটা যেমন সুখের ও গৌরবের তেমনি বিপরীতক্রমে ধর্ষক ও নির্যাতকের দেশ হিসেবে আমাদের যে পরিচিতি হচ্ছে সেটা চরম লজ্জার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ