ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেই চীনের নিরাপত্তা আইনটি হংকংয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আদালতের রায়, আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানি ও গ্রেপ্তারকৃত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তারা এই উপসংহারে এসেছে। বেইজিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া এ আইন কার্যকর হওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বুধবার একটি প্রতিবেদনে এই মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি। খবর রয়টার্সের।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হংকংয়ের চীন-সমর্থিত কর্তৃপক্ষ নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনটিকে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করে এবং সেন্সরশিপ, হয়রানি, গ্রেপ্তার ও নিপীড়নকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে ব্যবহার করছে; যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এক বছরে জাতীয় নিরাপত্তা আইন হংকংকে একটি পুলিশি রাজ্যে পরিণত করার পথ দ্রুত উন্মোচিত করেছে। সেই সঙ্গে মানুষের বসবাসের জন্য শহরটিতে এক মানবাধিকার জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছে এ আইন।’
এই অভিযোগের বিষয়ে হংকং কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। অবশ্য তারা বলেছে, আইনসম্মতভাবেই লোকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এ আইন হংকংয়ের সমাজের প্রতিটি অংশে প্রভাব ফেলেছে। তৈরি করেছে আতঙ্কের পরিবেশ। তা এমনই যে স্থানীয় বাসিন্দারা কথা বলা, টুইট করা ও কীভাবে জীবন যাপন করবেন, তা প্রকাশ করার আগে দুবার সেসব বিষয়ে চিন্তা করেন।’
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আইনটি প্রয়োগের প্রথম বছরে শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; আর অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে ৬০টির বেশি।
অ্যামনেস্টি বলছে, হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ভিন্নমত দমনে মিথ্যা অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
২০২০ সালের ৩০ জুন হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএল) প্রবর্তন করে চীন। এর আগের বছর গণতন্ত্রপন্থিদের ব্যাপক বিক্ষোভে বছরজুড়েই কার্যত অচল ছিলো এক সময়ের এই ব্রিটিশ উপনিবেশ।
বিতর্কিত এই আইন হংকংয়ের নিজস্ব বিচারিক ক্ষমতার স্বাধীনতা খর্ব করে এবং বিক্ষোভকারী ও অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ সহজ করে দেয়। বিদেশি কোনো শক্তির সঙ্গে আঁতাত করা, তাদের সঙ্গী হওয়া এবং তাদের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এই আইনের অধীনে এবং এর দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি হতে পারে।
আইনটি কার্যকর হওয়ার পর এর বিভিন্ন ধারার অধীনে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- যাদের মধ্যে আছেন বিক্ষোভকারী, গণতন্ত্রকামী রাজনীতিক ও সাংবাদিক।
হংকংকে চাপে ফেলে বেইজিংয়ের এই ‘বদলে ফেলার’ নীতির প্রভাব পড়েছে শহরের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও।
বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নতুন আইন শহরের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এটা ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থার’ নীতি লঙ্ঘন করেছে, যে নীতি অনুসরন করে সাবেক এই ব্রিটিশ উপনিবেশকে চীনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
হংকংয়ের অনেক বাসিন্দাই স্বীকার করছেন যে, নতুন আইনটি কার্যকর করার পর সেখানে জীবনযাপনের ধারাতেই মৌলিক বদল এসেছে।
বাসিন্দাদের অনেকেই এখন পুলিশ হটলাইনে ফোন করে ‘অবাধ্য’ প্রতিবেশী বা সহকর্মীদের বিষয়ে তথ্য দিচ্ছেন। শিক্ষকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে ৪৮ ভলিউমের বই পড়িয়ে- যার নাম ‘মাই হোম ইজ ইন চায়না’।
গণগ্রন্থাগারগুলো থেকে অনেক বই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং নেলসন ম্যান্ডেলার ওপর লেখা বইও রয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ১৯৯৭ সালে হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তরের সময় এই শহরে বাক স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, যা চীনের মূল ভূখণ্ডে কল্পনাও করা যায় না।
কিন্তু চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিংয়ের অধীনে, কমিউনিস্ট পার্টি হংকংয়ের এই ‘স্বাধীনচেতা’ পরিচয় আর বরদাস্ত করতে পারছে না। ২০১৯ সালে এখানকার জনগণ প্রায় বিদ্রোহ করতে বসেছিল, সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ফুঁসে উঠেছিল।
এখন, জাতীয় নিরাপত্তা আইনের সম্প্রসারিত বলয়ে বলীয়ান বেইজিং চেষ্টা করছে হংকংকে মূল ভূখণ্ডের অন্যান্য মেগাসিটির মত আরেকটি মেগাসিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে, একটি অর্থনৈতিক ইঞ্জিন বানাতে, যেখানে বিরোধিতাকে তাৎক্ষণিকভাবে মিটিয়ে দেওয়া যাবে।
এ মাসে হংকংয়ে নিযুক্ত বেইজিংয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা লুও হুইনিং বলেন, “হংকংয়ের সব শ্রেণিপেশার মানুষ উপলব্ধি করেছে যে ‘এক দেশ’ ধারণাটি ‘দুই ব্যবস্থা’র পূর্বশর্ত ও ভিত্তি।”
নিউ ইয়র্ক টাইমন লিখেছে, হংকং এখন অপরিচিত দৃশ্যাবলীর একটি মন্তাজ, অনেকের জন্যই ‘অস্বস্তিকর’। শহরের পুলিশ কর্মীরা এখন চীনের সামরিক বাহিনীর কায়দায় পা ফেলে, বদলে গেছে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ব্রিটিশ-ধারার কুচকাওয়াজ। সেখানকার নেতারা এখন নিয়মিতই ‘বহিঃশক্তির’ সমালোচনা করেন, দেশের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে বলে গলা ফাটান।
চীন যখন হংকংয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার করল, তাদের প্রতি সম্ভাব্য অবাধ্যদের প্রার্থিতা বাতিলের জন্য, তখনও তারা বলেছিল, এই পরিবর্তন ‘হংকংয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ‘নিখুঁত’ করে তুলছে।
যখন প্রভাবশালী গণতন্ত্রপন্থি সংবাদপত্র অ্যাপল ডেইলি বন্ধ করে দেওয়া হল পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযানের পর, তখনও পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এই প্রকাশনাটি ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছে’।
যখন বেশ কিছু বিরোধী রাজনৈতিক নেতা একটি অনানুষ্ঠানিক নির্বাচনী বাছাইয়ের আয়োজন করেছিল, চীনের কর্মকর্তারা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনে এবং তাদের গ্রেপ্তার করে।
চীনের ক্ষমতা এখন এতোটাই সুদূর প্রসারী যে হংকংয়ের একসময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নায়ক চ্যান তাত চিং গত এক বছর ধরে তার বন্ধুদের আহ্বান জানিয়ে চলেছেন, যাতে তারা বেইজিংকে চ্যালেঞ্জ না করে।
তবে, হংকং এখনও মূল ভূখণ্ডের আরেকটি চীনা-মহানগরীতে পরিণত হয়নি। এখানকার বাসিন্দারা প্রমাণ করে চলেছে, স্বাধীনতায় ছাড় দিতে তাদের চরম অনাগ্রহ, এবং কিছু অংশ শুধু হংকংয়ের পরিচয়কে তুলে ধরার জন্য প্রতীক সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ