হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট চৌ হ্যাং তুং-কে ১৫ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ১৯৮৯ সালে তিয়েনয়ানমেন স্কয়ারে চালানো চীনা নিপীড়নের বার্ষিকী উপলক্ষে ২০২১ সালে এক অনুষ্ঠান আয়োজন করায় দোষী সাব্যস্ত হন তিনি।
১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল বেইজিং। প্রতি বছর সেই দিনটিকে পালন করে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থীরা। মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
জানা গেছে, অনুমতি ছাড়াই অন্যদের সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করায় তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। কারণ হংকং কর্তৃপক্ষ করোনা মহামারির কারণে পরপর দুই বছর এ ধরনের সম্মেলন নিষিদ্ধ করেছিল। ২০২০ সালেও একই সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও অন্যদের উসকানি দেওয়ার জন্য গত মাসে তাকে ১২ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হংকং অ্যালায়েন্সের (এইচকেএ) ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন চৌ। ১৯৮৯ সালের জুন মাসে তিয়েনয়ানমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর দমনপীড়ন চালায় বেইজিং কর্তৃপক্ষ। সেই দিনটি স্মরণ করে প্রত্যেক বছর সম্মেলন করে এইচকেএ।
গত বছরের ৪ জুন সকালে চৌ হ্যাং তুং গ্রেপ্তার হন। হংকংয়ের অধিবাসীদের মোমবাতি জ্বালিয়ে দিবসটি পালনের আহ্বান জানানোর পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার উসকানি দেওয়ায় মঙ্গলবার আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে।
ম্যাজিস্ট্রেট অ্যামি চ্যান বলেন, ‘আইন কোনোভাবেই কাউকে বেআইনি উপায়ে স্বাধীনতার চর্চা করতে দেয় না।’
আদালতে নিজেই মামলা পরিচালনা করেন ব্যারিস্টার চৌ হ্যাং তুং। নিজের দোষ স্বীকার করেননি তিনি। আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলেন, তিনি অন্যদের ৪ জুন ভুলে না যেতে উসকানি দিয়েছেন, সমবেত হতে নয়। তবে বিচারক তার যুক্তি খারিজ করে দিয়ে বলেন, এটা অবিশ্বাস্য।
হংকংয়ে সম্প্রতি সাংবাদিকদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। চালানো হচ্ছে তল্লাশি অভিযান। সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে স্ট্যান্ড নিউজের সাবেক ও বর্তমান ৭ সাংবাদিককে। এমনকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
হংকং অ্যালায়েন্সের (এইচকেএ) ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন চৌ। ১৯৮৯ সালের জুন মাসে তিয়েনয়ানমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর দমনপীড়ন চালায় বেইজিং কর্তৃপক্ষ। সেই দিনটি স্মরণ করে প্রত্যেক বছর সম্মেলন করে এইচকেএ।
সাংবাদিক গ্রেপ্তার হওয়ার পর হংকং জুড়ে নতুন করে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। চীন যে নতুন আইন তৈরি করেছে, তা নিয়ে ফের সরব হয়েছেন হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থিরা। এর আগেও সাংবাদিক এবং খবরের কাগজের সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে হংকংয়ে। চীনের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী সংবাদপত্র অ্যাপল ডেইলির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে চীনের জাতীয় নিরাপত্তা পুলিশ। এতে পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদকসহ পাঁচ জন নির্বাহী কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হংকংয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী স্বাধীনতায় সমর্থন করে না; এ ধরনের প্রচারণাকে বেইজিং অসম্মানজনক হিসেবে মনে করে। গত বছর বেইজিং জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারির সাথে সাথে স্বৈরাচারী রূপে হাজির হয় হংকং।
সেখানকার অধিকাংশ গণতন্ত্রকামী রাজনীতিক বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন অথবা স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেছেন। কয়েক ডজন নাগরিক সমাজের সংগঠন তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে এবং কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হংকং ছেড়ে চলে গেছে।
বেইজিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া এ আইন কার্যকর হওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেই চীনের নিরাপত্তা আইনটি হংকংয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আদালতের রায়, আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানি ও গ্রেপ্তারকৃত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তারা এই উপসংহারে এসেছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হংকংয়ের চীন-সমর্থিত কর্তৃপক্ষ নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনটিকে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করে এবং সেন্সরশিপ, হয়রানি, গ্রেপ্তার ও নিপীড়নকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে ব্যবহার করছে; যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এক বছরে জাতীয় নিরাপত্তা আইন হংকংকে একটি পুলিশি রাজ্যে পরিণত করার পথ দ্রুত উন্মোচিত করেছে। সেই সঙ্গে মানুষের বসবাসের জন্য শহরটিতে এক মানবাধিকার জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছে এ আইন।’
ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এ আইন হংকংয়ের সমাজের প্রতিটি অংশে প্রভাব ফেলেছে। তৈরি করেছে আতঙ্কের পরিবেশ। তা এমনই যে স্থানীয় বাসিন্দারা কথা বলা, টুইট করা ও কীভাবে জীবন যাপন করবেন, তা প্রকাশ করার আগে দুবার সেসব বিষয়ে চিন্তা করেন।’
অ্যামনেস্টি বলছে, হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ভিন্নমত দমনে মিথ্যা অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৫০ বছর ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর চুক্তির মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকং-কে চীনের কাছে ফেরত দেয় যুক্তরাজ্য। তখন থেকে অঞ্চলটি ‘এক দেশ, দুই নীতি’র আওতায় স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হংকংকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছে চীন। তবে গত বছর জুনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের জন্য নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করে বেইজিং। এই আইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চীনের হাতে তুলে দিতে পারবে হংকং কর্তৃপক্ষ। সমালোচকেরা বলছেন,এই আইনের কারণে অঞ্চলটির গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার সুযোগ পাবে চীন।
এদিকে গত বছর হংকং-এ চীন নতুন নিরাপত্তা আইন চালু করলে শুরু থেকেই পশ্চিমা দেশগুলি চীনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে, নতুন আইন হংকং-এর লোকেদের অধিকার ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। এই আইনে বলা হয়েছে, চীনের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা যাবে না। বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী কোনও কাজ করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির আশঙ্কা, এই আইন ব্যবহার করে হংকং-এ যাবতীয় বিক্ষোভ বন্ধ করে দেবে চীন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও ভূখণ্ডটিতে চীনা নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হংকংয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোনোভাবেই সহ্য করবে না চীনা প্রশাসন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫১
আপনার মতামত জানানঃ