হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী এক তরুণ অধিকারকর্মীকে সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত। চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চেষ্টা এবং অর্থ পাচারের দায়ে হংকংয়ের স্বাধীনতাকামী একটি গোষ্ঠীর নেতা টনি চুংকে এ কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মঙ্গলবার হংকংয়ের একটি জেলা আদালত সেখানকার স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ‘স্টুডেন্টলোকালিজম’র ওই নেতাকে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
সম্প্রতি হংকংয়ে পাস হওয়া বিতর্কিত এক আইনে টনি চুং (২০) নামের ওই তরুণ দোষী সাব্যস্ত হন। চলতি মাসের শুরুতেই অর্থ পাচার আইনের একটি মামলায় টনি দোষী সাব্যস্ত হন। তবে আদালতের ওই রায়ের পরে তিনি বলেন, ওই ঘটনায় তিনি মোটেই লজ্জিত নন।
২০ বছর বয়সী টনি চুংয়ের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের অক্টোবরে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে অর্থপাচারের অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং সে সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার পরবর্তী সময়ে জামিনের আবেদন বাতিল করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটের কাছে একটি কফি শপে অন্য দুজনের সঙ্গে তাকে সে সময় আটক করা হয়েছিল।
এদিকে জামিন আবেদনের ফলে তার সাজা ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে, বিচ্ছিন্নতার জন্য ৪০ মাস এবং অর্থপাচারের জন্য ১৮ মাস। এর সঙ্গে তিন মাস যোগ হয়ে মোট ৪৩ মাস সাজা।
স্থানীয় জেলা জজ আদালতের বিচারক স্ট্যানলি চ্যান বলেন, ‘টনি চুং দেশকে আলাদা করার জন্য সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম সংগঠিত এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল।’
আদালতের বিচারক ইভান চেউং বলেছেন, অভিযুক্ত টনি চুং যুক্তরাষ্ট্রের সংগঠন স্টুডেন্টলোকালিজমের শাখার ফেসবুকের একটি পেইজের প্রশাসক। এছাড়া ইনিশিয়েটিভ ইনডিপেনডেন্স পার্টি নামের একটি সংস্থা পরিচালনা করতেন তিনি।
বিচারকরা বলেছেন, গ্রেপ্তারের সময় চুংয়ের বাসভবন থেকে স্বাধীনতার পক্ষের টি-শার্ট, পতাকা এবং বই উদ্ধার করা হয়েছিল। এছাড়া পেপালের মাধ্যমে প্রাপ্ত অনুদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
চীনের কাছ থেকে হংকংয়ের স্বাধীনতার দাবিতে গড়ে ওঠা স্টুডেন্ট ইউনিয়নের আহ্বায়ক ছিলেন টনি চুং। পাঁচ বছর আগে মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি ওই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। চীন থেকে বিচ্ছিন্নতা তখন হংকংয়ে সংখ্যালঘুদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তবে বছর দুয়েক আগে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গণতন্ত্রের দাবিতে হংকংয়ের নাগরিকেরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
সেই বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া হিসেবে হংকংয়ের ওপর নিরাপত্তা আইন আরোপ করে বেইজিং। তবে ওই আইন কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে স্থানীয় ছাত্ররা এই আইনের বিরোধিতা জানান।
এমন প্রেক্ষাপটে বিদেশি অধিকারকর্মীদের আর্থিক সহায়তা নিয়ে আন্দোলনকারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় টনি চুংয়ের বিরুদ্ধে।
সরকারি কৌঁসুলি অভিযোগ করেছেন, টনি চুংয়ের দল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারের বেশি পোস্ট দিয়েছে। ওই সব পোস্টে ‘চীনা কমিউনিস্ট ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি’ এবং ‘হংকং প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার’ আহ্বান জানানো হয়েছিল।
২০২০ সালের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হওয়া টনি চুংকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতিমধ্যে এক বছরের বেশি জেল খাটা হয়েছে তার।
গ্রেপ্তারের সময় চুংয়ের বাসভবন থেকে স্বাধীনতার পক্ষের টি-শার্ট, পতাকা এবং বই উদ্ধার করা হয়েছিল। এছাড়া পেপালের মাধ্যমে প্রাপ্ত অনুদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
গত বছরের জুনে চীনের বেয়ারা এই অঞ্চলে জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারির আগে সেখানকার কর্তৃপক্ষ অন্যান্য সরকারবিরোধী সংগঠনের মতো স্টুডেন্টলোকালিজমকে ভেঙে দেয়। বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতা, সন্ত্রাসবাদ এবং বিদেশী বাহিনীর সাথে সম্পর্কের কারণে এসব সংগঠনের নেতার আজীবন কারাবাসের শাস্তির শঙ্কা রয়েছে।
হংকংয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী স্বাধীনতায় সমর্থন করে না; এ ধরনের প্রচারণাকে বেইজিং অসম্মানজনক হিসেবে মনে করে। গত বছর বেইজিং জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারির সাথে সাথে স্বৈরাচারী রূপে হাজির হয় হংকং।
সেখানকার অধিকাংশ গণতন্ত্রকামী রাজনীতিক বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন অথবা স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেছেন। কয়েক ডজন নাগরিক সমাজের সংগঠন তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে এবং কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হংকং ছেড়ে চলে গেছে।
গত মাসেও সাবেক এক আইনপ্রণেতাসহ হংকংয়ে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনকারী সাতজনকে ১২ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গত বছর চীনের জাতীয় নিরাপত্তার আইন ভঙ্গ করে বিক্ষোভ করার অভিযোগে এ রায় দিয়েছেন আদালত।
জানা যায়, অবৈধভাবে ২০২০ সালের ১ জুলাই আন্দোলন-সমাবেশ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তারা। ওই আন্দোলনে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী গণতন্ত্রের দাবিতে রাস্তায় নামে। করোনা মহামারির মধ্যে আন্দোলন সমাবেশ নিষিদ্ধ এমন অভিযোগ এনে সেসময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের জলকামান দিয়ে ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর হংকংয়ে ৯ গণতন্ত্রপন্থি কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি আরও ৩ কর্মীকে স্থগিত সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ১২ জনের মধ্যে তিয়ানআনমেন স্মরণে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচির আয়োজক আলবার্ট হো, সাবেক আইনপ্রণেতা এডি চু এবং গণতন্ত্রপন্থি বড় বড় সমাবেশের আয়োজক সিভিল হিউম্যান রাইটস ফ্রন্টের সাবেক নেতা ফিগো চ্যানও আছেন।
২০২০ সালের ৩০ জুন হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএল) প্রবর্তন করে চীন। এর আগের বছর গণতন্ত্রপন্থিদের ব্যাপক বিক্ষোভে বছরজুড়েই কার্যত অচল ছিলো এক সময়ের এই ব্রিটিশ উপনিবেশ।
বিতর্কিত এই আইন হংকংয়ের নিজস্ব বিচারিক ক্ষমতার স্বাধীনতা খর্ব করে এবং বিক্ষোভকারী ও অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ সহজ করে দেয়। বিদেশি কোনো শক্তির সঙ্গে আঁতাত করা, তাদের সঙ্গী হওয়া এবং তাদের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এই আইনের অধীনে এবং এর দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি হতে পারে।
আইনটি কার্যকর হওয়ার পর এর বিভিন্ন ধারার অধীনে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে— যাদের মধ্যে আছেন বিক্ষোভকারী, গণতন্ত্রকামী রাজনীতিক ও সাংবাদিক।
হংকংকে চাপে ফেলে বেইজিংয়ের এই ‘বদলে ফেলার’ নীতির প্রভাব পড়েছে শহরের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও।
নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার হরণের অভিযোগ অস্বীকার করে চীনা এবং হংকং কর্তৃপক্ষ বলেছে, রাজপথে ২০১৯ সালের গণ-বিক্ষোভের পর স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য এই আইনের প্রয়োজন ছিল।
বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নতুন আইন শহরের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এটা ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থার’ নীতি লঙ্ঘন করেছে, যে নীতি অনুসরন করে সাবেক এই ব্রিটিশ উপনিবেশকে চীনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
হংকংয়ের অনেক বাসিন্দাই স্বীকার করছেন যে, নতুন আইনটি কার্যকর করার পর সেখানে জীবনযাপনের ধারাতেই মৌলিক বদল এসেছে।
বাসিন্দাদের অনেকেই এখন পুলিশ হটলাইনে ফোন করে ‘অবাধ্য’ প্রতিবেশী বা সহকর্মীদের বিষয়ে তথ্য দিচ্ছেন। শিক্ষকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে ৪৮ ভলিউমের বই পড়িয়ে— যার নাম ‘মাই হোম ইজ ইন চায়না’।
গণগ্রন্থাগারগুলো থেকে অনেক বই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং নেলসন ম্যান্ডেলার ওপর লেখা বইও রয়েছে।
বেইজিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া এ আইন কার্যকর হওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেই চীনের নিরাপত্তা আইনটি হংকংয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আদালতের রায়, আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানি ও গ্রেপ্তারকৃত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তারা এই উপসংহারে এসেছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হংকংয়ের চীন-সমর্থিত কর্তৃপক্ষ নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনটিকে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করে এবং সেন্সরশিপ, হয়রানি, গ্রেপ্তার ও নিপীড়নকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে ব্যবহার করছে; যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এক বছরে জাতীয় নিরাপত্তা আইন হংকংকে একটি পুলিশি রাজ্যে পরিণত করার পথ দ্রুত উন্মোচিত করেছে। সেই সঙ্গে মানুষের বসবাসের জন্য শহরটিতে এক মানবাধিকার জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছে এ আইন।’
ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এ আইন হংকংয়ের সমাজের প্রতিটি অংশে প্রভাব ফেলেছে। তৈরি করেছে আতঙ্কের পরিবেশ। তা এমনই যে স্থানীয় বাসিন্দারা কথা বলা, টুইট করা ও কীভাবে জীবন যাপন করবেন, তা প্রকাশ করার আগে দুবার সেসব বিষয়ে চিন্তা করেন।’
অ্যামনেস্টি বলছে, হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ভিন্নমত দমনে মিথ্যা অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৫০ বছর ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর চুক্তির মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকং-কে চীনের কাছে ফেরত দেয় যুক্তরাজ্য। তখন থেকে অঞ্চলটি ‘এক দেশ, দুই নীতি’র আওতায় স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হংকংকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছে চীন। তবে গত বছর জুনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের জন্য নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করে বেইজিং। এই আইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চীনের হাতে তুলে দিতে পারবে হংকং কর্তৃপক্ষ। সমালোচকেরা বলছেন,এই আইনের কারণে অঞ্চলটির গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার সুযোগ পাবে চীন।
এদিকে গত বছর হংকং-এ চীন নতুন নিরাপত্তা আইন চালু করলে শুরু থেকেই পশ্চিমা দেশগুলি চীনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে, নতুন আইন হংকং-এর লোকেদের অধিকার ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। এই আইনে বলা হয়েছে, চীনের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা যাবে না। বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী কোনও কাজ করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির আশঙ্কা, এই আইন ব্যবহার করে হংকং-এ যাবতীয় বিক্ষোভ বন্ধ করে দেবে চীন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও ভূখণ্ডটিতে চীনা নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হংকংয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোনোভাবেই সহ্য করবে না চীনা প্রশাসন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ