চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হংকংয়ে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের দুটি কার্যালয় বন্ধ করতে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনটি এর আগে ঘোষণা দিয়েছে যে, চলতি বছরের শেষে তারা সেখানে তাদের কার্যালয় বন্ধ করে দেবে। এরই মধ্যে রোববার থেকে তারা স্থানীয়ভাবে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। লন্ডনভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠন বলছে, চীনের আরোপিত জাতীয় নিরাপত্তা আইন সেখানে তাদের কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা অসম্ভব করে তুলেছে।
হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের রোষানলে পড়ার শঙ্কায় যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি আজ সোমবার এ ঘোষণা দিয়েছে। সোমবার (২৫ অক্টোবর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
চীনের আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ে আজই সংগঠনটির সাবেক এক খাদ্য সরবরাহ কর্মীকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে দোষী সাব্যস্ত করার পর অ্যামনেস্টি এ ঘোষণা দিল। এ নিয়ে ওই নিপীড়নমূলক আইনে দুজন দোষী সাব্যস্ত হলেন।
গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে হংকংয়ে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে অ্যামনেস্টি। বর্তমানে সেখানে তাদের দু’টি কার্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হংকংয়ের অভ্যন্তরীণ এবং অন্যটি বৃহৎ অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করছে। স্থানীয় কার্যালয়টি আগামী ৩১ অক্টোবর বন্ধ করে দেওয়া হবে। এছাড়া আঞ্চলিক কার্যালয়টি চলতি বছরের শেষের দিকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয় লন্ডনে। তবে এশিয়া প্যাসিফিকের অন্যান্য অফিস থেকে গবেষণা, অ্যাডভোকেসি ও প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের কারণে এমন বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনটি। নিরাপত্তা আইনের ফলে হংকংয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করা অসম্ভব। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বোর্ডের চেয়ারম্যান আনঝুলা মায়া সিং বাইস সোমবার এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, হংকং দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সুশীল সংস্থাগুলোর জন্য একটি আদর্শ আঞ্চলিক ভিত্তি ছিল। তবে সম্প্রতি স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নগুলো কর্তৃপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ভিন্নমতকে দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে সর্বত্র। তাই এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশে কাজ চালিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য কঠিন।
গণতন্ত্রের দাবিতে সহিংস বিক্ষোভের জেরে গত বছর চীনের কমিউনিস্ট সরকার হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে। তখন থেকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈচিত্র্যের শহর হংকং পরিণত হয়েছে ভয় আর শঙ্কার শহরে।
চীন সরকার জাতীয় হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইনকে নিরাপত্তার জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী, পশ্চিমা বিশ্ব এই আইনকে হংকংয়ে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা রোধের ভয়াবহ ‘অস্ত্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের কারণে এমন বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনটি। নিরাপত্তা আইনের ফলে হংকংয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করা অসম্ভব।
হংকংভিত্তিক কিছু বিশিষ্ট সামাজিক সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নের মতো অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও জাতীয় নিরাপত্তা আইনের ফলে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে নাগরিক মানবাধিকার ফ্রন্টসহ অন্তত ৩৫টি সংগঠন তাদের কর্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকারকে জবাবদিহি করার লক্ষ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ৭০টিরও বেশি দেশে কাজ করছে।
২০২০ সালের ৩০ জুন হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএল) প্রবর্তন করে চীন। এর আগের বছর গণতন্ত্রপন্থিদের ব্যাপক বিক্ষোভে বছরজুড়েই কার্যত অচল ছিলো এক সময়ের এই ব্রিটিশ উপনিবেশ।
বিতর্কিত এই আইন হংকংয়ের নিজস্ব বিচারিক ক্ষমতার স্বাধীনতা খর্ব করে এবং বিক্ষোভকারী ও অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ সহজ করে দেয়। বিদেশি কোনো শক্তির সঙ্গে আঁতাত করা, তাদের সঙ্গী হওয়া এবং তাদের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এই আইনের অধীনে এবং এর দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি হতে পারে।
আইনটি কার্যকর হওয়ার পর এর বিভিন্ন ধারার অধীনে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে— যাদের মধ্যে আছেন বিক্ষোভকারী, গণতন্ত্রকামী রাজনীতিক ও সাংবাদিক।
হংকংকে চাপে ফেলে বেইজিংয়ের এই ‘বদলে ফেলার’ নীতির প্রভাব পড়েছে শহরের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও।
বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নতুন আইন শহরের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এটা ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থার’ নীতি লঙ্ঘন করেছে, যে নীতি অনুসরন করে সাবেক এই ব্রিটিশ উপনিবেশকে চীনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
হংকংয়ের অনেক বাসিন্দাই স্বীকার করছেন যে, নতুন আইনটি কার্যকর করার পর সেখানে জীবনযাপনের ধারাতেই মৌলিক বদল এসেছে।
বাসিন্দাদের অনেকেই এখন পুলিশ হটলাইনে ফোন করে ‘অবাধ্য’ প্রতিবেশী বা সহকর্মীদের বিষয়ে তথ্য দিচ্ছেন। শিক্ষকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে ৪৮ ভলিউমের বই পড়িয়ে— যার নাম ‘মাই হোম ইজ ইন চায়না’।
গণগ্রন্থাগারগুলো থেকে অনেক বই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং নেলসন ম্যান্ডেলার ওপর লেখা বইও রয়েছে।
বেইজিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া এ আইন কার্যকর হওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেই চীনের নিরাপত্তা আইনটি হংকংয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আদালতের রায়, আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানি ও গ্রেপ্তারকৃত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তারা এই উপসংহারে এসেছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হংকংয়ের চীন-সমর্থিত কর্তৃপক্ষ নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনটিকে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করে এবং সেন্সরশিপ, হয়রানি, গ্রেপ্তার ও নিপীড়নকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে ব্যবহার করছে; যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এক বছরে জাতীয় নিরাপত্তা আইন হংকংকে একটি পুলিশি রাজ্যে পরিণত করার পথ দ্রুত উন্মোচিত করেছে। সেই সঙ্গে মানুষের বসবাসের জন্য শহরটিতে এক মানবাধিকার জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছে এ আইন।’
ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এ আইন হংকংয়ের সমাজের প্রতিটি অংশে প্রভাব ফেলেছে। তৈরি করেছে আতঙ্কের পরিবেশ। তা এমনই যে স্থানীয় বাসিন্দারা কথা বলা, টুইট করা ও কীভাবে জীবন যাপন করবেন, তা প্রকাশ করার আগে দুবার সেসব বিষয়ে চিন্তা করেন।’
অ্যামনেস্টি বলছে, হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ভিন্নমত দমনে মিথ্যা অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৫০ বছর ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর চুক্তির মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকং-কে চীনের কাছে ফেরত দেয় যুক্তরাজ্য। তখন থেকে অঞ্চলটি ‘এক দেশ, দুই নীতি’র আওতায় স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হংকংকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছে চীন। তবে গত বছর জুনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের জন্য নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করে বেইজিং। এই আইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চীনের হাতে তুলে দিতে পারবে হংকং কর্তৃপক্ষ। সমালোচকেরা বলছেন,এই আইনের কারণে অঞ্চলটির গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার সুযোগ পাবে চীন।
এদিকে গত বছর হংকং-এ চীন নতুন নিরাপত্তা আইন চালু করলে শুরু থেকেই পশ্চিমা দেশগুলি চীনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে, নতুন আইন হংকং-এর লোকেদের অধিকার ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। এই আইনে বলা হয়েছে, চীনের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা যাবে না। বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী কোনও কাজ করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির আশঙ্কা, এই আইন ব্যবহার করে হংকং-এ যাবতীয় বিক্ষোভ বন্ধ করে দেবে চীন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও ভূখণ্ডটিতে চীনা নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হংকংয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোনোভাবেই সহ্য করবে না চীনা প্রশাসন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ