গণতন্ত্রপন্থি ছয় সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে হংকং পুলিশ। পুলিশের অভিযোগ, খবরের নামে দেশবিরোধী লেখা প্রকাশ করা হচ্ছিল। ওয়ারেন্ট নিয়েই তাদের দপ্তরে যাওয়া হয়েছিল।গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী স্বাধীন সংবাদমাধ্যম স্ট্যান্ড নিউজের বর্তমান ও সাবেক কর্মী।
আজ বুধবার হংকংয়ের অনলাইন খবরের পোর্টাল স্ট্যান্ড নিউজের অফিসে তল্লাশি চালায় পুলিশ। তল্লাশি চালানো হয় সাংবাদিকদের বাড়িতেও। পরে ছয় সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশ। তবে বিবৃতিতে সাংবাদিকদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। ছয় সাংবাদিকের মধ্যে তিনজন পুরুষ এবং তিনজন নারী। কয়েকজন ওই পোর্টালের সাবেক সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ।
হংকং পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তল্লাশি ও সাংবাদিকতা-সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক সামগ্রী জব্দ করার ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্যান্ড নিউজের সাবেক ও বর্তমান প্রধান সম্পাদক রয়েছেন। এ ছাড়া আছেন পপ তারকা থেকে গণতন্ত্রপন্থীদের মুখ হয়ে ওঠা সংবাদমাধ্যমটির সাবেক বোর্ড সদস্য ডেনিস হো।
ডেনিস হো ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তার গ্রেপ্তার হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তাকে হংকংয়ের ওয়েস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, হংকং পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ছয় ব্যক্তির মধ্যে তিনজন নারী ও তিনজন পুরুষ। তাদের বয়স ৩৪ থেকে ৭৩ বছরের মধ্যে।
স্ট্যান্ড নিউজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা ফুটেজে দেখা যায়, আজ সকালে সংবাদমাধ্যমটির ডেপুটি অ্যাসাইনমেন্ট ডিরেক্টর রনসন চ্যানের কার্যালয়ের দরজায় পুলিশ অবস্থান করছে।
সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী সংবাদপত্র অ্যাপল ডেইলির প্রতিষ্ঠাতা জিমি লাইয়ের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনা হয়। এ ঘটনার পরই স্ট্যান্ড নিউজের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।
জিমি লাইকে ইতিমধ্যে পৃথক অভিযোগে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন হংকংয়ে কারাভোগ করছেন।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্যান্ড নিউজের সাবেক ও বর্তমান প্রধান সম্পাদক রয়েছেন। এ ছাড়া আছেন পপ তারকা থেকে গণতন্ত্রপন্থীদের মুখ হয়ে ওঠা সংবাদমাধ্যমটির সাবেক বোর্ড সদস্য ডেনিস হো।
এদিকে কারাভোগ করা অবস্থায় ‘চীনে মৌলিক মানবাধিকারের জন্য দীর্ঘ অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ’ ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান লুই জিয়াওবো৷ চীনা এই লেখক, সমালোচক, দার্শনিক ও মানবাধিকারকর্মী একধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ চীনা কমিউনিস্ট শাসকদের সবচেয়ে বড় সমালোচক ও সবচেয়ে বিখ্যাত রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে৷ ২০১৭ সালে ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন তিনি৷
সাংবাদিক গ্রেপ্তার হওয়ার পর হংকং জুড়ে নতুন করে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। চীন যে নতুন আইন তৈরি করেছে, তা নিয়ে ফের সরব হয়েছেন হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থিরা। এর আগেও সাংবাদিক এবং খবরের কাগজের সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে হংকংয়ে। চীনের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী সংবাদপত্র অ্যাপল ডেইলির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে চীনের জাতীয় নিরাপত্তা পুলিশ। এতে পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদকসহ পাঁচ জন নির্বাহী কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হংকংয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী স্বাধীনতায় সমর্থন করে না; এ ধরনের প্রচারণাকে বেইজিং অসম্মানজনক হিসেবে মনে করে। গত বছর বেইজিং জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারির সাথে সাথে স্বৈরাচারী রূপে হাজির হয় হংকং।
সেখানকার অধিকাংশ গণতন্ত্রকামী রাজনীতিক বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন অথবা স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেছেন। কয়েক ডজন নাগরিক সমাজের সংগঠন তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে এবং কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হংকং ছেড়ে চলে গেছে।
বেইজিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া এ আইন কার্যকর হওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেই চীনের নিরাপত্তা আইনটি হংকংয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আদালতের রায়, আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানি ও গ্রেপ্তারকৃত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তারা এই উপসংহারে এসেছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হংকংয়ের চীন-সমর্থিত কর্তৃপক্ষ নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনটিকে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করে এবং সেন্সরশিপ, হয়রানি, গ্রেপ্তার ও নিপীড়নকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে ব্যবহার করছে; যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এক বছরে জাতীয় নিরাপত্তা আইন হংকংকে একটি পুলিশি রাজ্যে পরিণত করার পথ দ্রুত উন্মোচিত করেছে। সেই সঙ্গে মানুষের বসবাসের জন্য শহরটিতে এক মানবাধিকার জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছে এ আইন।’
ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ‘এ আইন হংকংয়ের সমাজের প্রতিটি অংশে প্রভাব ফেলেছে। তৈরি করেছে আতঙ্কের পরিবেশ। তা এমনই যে স্থানীয় বাসিন্দারা কথা বলা, টুইট করা ও কীভাবে জীবন যাপন করবেন, তা প্রকাশ করার আগে দুবার সেসব বিষয়ে চিন্তা করেন।’
অ্যামনেস্টি বলছে, হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ভিন্নমত দমনে মিথ্যা অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৫০ বছর ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর চুক্তির মেয়াদ শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকং-কে চীনের কাছে ফেরত দেয় যুক্তরাজ্য। তখন থেকে অঞ্চলটি ‘এক দেশ, দুই নীতি’র আওতায় স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হংকংকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছে চীন। তবে গত বছর জুনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের জন্য নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করে বেইজিং। এই আইনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চীনের হাতে তুলে দিতে পারবে হংকং কর্তৃপক্ষ। সমালোচকেরা বলছেন,এই আইনের কারণে অঞ্চলটির গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার সুযোগ পাবে চীন।
এদিকে গত বছর হংকং-এ চীন নতুন নিরাপত্তা আইন চালু করলে শুরু থেকেই পশ্চিমা দেশগুলি চীনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে, নতুন আইন হংকং-এর লোকেদের অধিকার ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। এই আইনে বলা হয়েছে, চীনের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা যাবে না। বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী কোনও কাজ করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির আশঙ্কা, এই আইন ব্যবহার করে হংকং-এ যাবতীয় বিক্ষোভ বন্ধ করে দেবে চীন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও ভূখণ্ডটিতে চীনা নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হংকংয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোনোভাবেই সহ্য করবে না চীনা প্রশাসন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ