করোনার দেড় বছরেই স্বাস্থ্যব্যবস্থার অস্বাস্থ্য হাল। তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং অবনতির উৎসব সব হাসপাতালগুলোতে। এই দুরবাস্থার অনন্য নজির স্থাপন করেছে বরিশাল বিভাগ। কেবল করোনা নয়, সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার চিত্র আগের মতই আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। বরাদ্দ টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সরকারি হাসপাতাল হলে, সমস্ত সেবা পেতে রোগীদের গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অভিজ্ঞদের অভাবে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। আর এই করোনায় অক্সিজেন সরবরাহ যখন সবথেকে গুরুত্ব পাবার কথা, সেখানেই অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত। এমনকি ওয়ার্ডবয় দিয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা।
হাসপাতালের বরাদ্দ থেকে পুকুর চুরি
অপারেশন থিয়েটার যেনো নিজেই সার্জনের ছুরির নিচ থেকে বেঁচে ফিরতে পারেনি। অসুস্থ মেঝেতে নোংরা পানি, স্যাঁতসেঁতে অবস্থা, ভাঙা জানালা ও মশা-মাছিতে পরিপূর্ণ একটি কক্ষ। বলছি বরগুনার বেতাগী ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটির কথা। এটি হাসপাতাল, নাকি নিজেই চিকিৎসাপ্রার্থী কোনও রোগী, এই নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়।
এর অন্যতম কারণ হাসপাতালের বিভিন্ন খাতে প্রতি বছর যেসব বরাদ্দ দেয়া হয়, তার মধ্য থেকে হয় পুকুর চুরি। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে হাসপাতালটির উন্নয়নের জন্য ওষুধ ক্রয়সহ বিভিন্ন খাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেয়া হয় ৪০ লাখ ২৬ হাজার ৯০০ টাকা। তবে এসব বরাদ্দ শুধু কাগজ-কলমে সীমবদ্ধ। বাস্তবে এসব বরাদ্দের সিংহভাগই আত্মসাৎ করা হয়েছে।
সূত্র মতে, মোট বরাদ্দের ৭০ ভাগ ওষুধ ক্রয়ের জন্য। এর মধ্যে ইডিসিএল ৭৫ ভাগ ও লোকাল ক্রয় ২৫ ভাগ, এমএসআর যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ১০ ভাগ, গজ ব্যান্ডেজ তুলা ক্রয়ের জন্য ৫ ভাগ, লিলেন ক্রয়ের জন্য ৫ ভাগ, কেমিক্যাল রি-এজেন্ট (এক্স-রে ফিল্ম, ইসিজি পেপার) ক্রয়ের জন্য দুই ভাগ, আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য দুই ভাগ, এমএসআর যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য দুই ভাগ, অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাস সরবরাহ বাবদ এক ভাগ, সংগ্রহ ও সরবরাহ এক ভাগ, এমএসআর নির্বাচনী কমিটির ব্যয় ধরা হয়েছে দুই ভাগ টাকা।
হাসপাতালের স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত ৬-৭ বছর ধরে হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন নষ্ট এবং টেকনিশিয়ানও নেই। সেখানে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭৪ হাজার ৫৩৮ টাকা। সবচেয়ে বড় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ওষুধ ক্রয়ে। তবে হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অসুস্থ রোগীর জন্য কোনও ধরনের ওষুধের ব্যবস্থা হাসপাতাল থেকে করা হয় না। সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়। কিন্তু এ খাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ পেয়েছে ২৬ লাখ ৮ হাজার ৮৩০ টাকা।
এদিকে এক লাখ ৮৬ হাজার ৩৪৫ টাকার লিলেন ক্রয়ের কথা কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই। ব্যান্ডেজ, তুলা থাকতেও রোগীদের বাইরে থেকে ক্রয় করতে হয়। এ খাতেও বরাদ্দ এক লাখ ৮৬ হাজার ৩৪৫ টাকা। এমএসআর যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য ৭৪ হাজার ৫৩৮ টাকা বরাদ্দ থাকলেও এমএসআর সব যন্ত্রপাতি নষ্ট ও অকেজো।
এছাড়া হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন থেকে যেসব বরাদ্দ দেয়া হয় তা খরচ না করে আত্মসাৎ করা হয়।
নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি
বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। নেই টেকনিশিয়ান, অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। এর ফলে বন্ধ রয়েছে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও।
এই জেলা জেনারেল হাসপাতালে যন্ত্রপাতি থাকলেও নেই তার ব্যবহার। রেডিওলজিস্ট না থাকার কারণে হাসপাতালের নিচতলায় এক্সরে রুমে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন। বিশেষজ্ঞ না থাকায় কোনও অপারেশনও হচ্ছে না।
গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আল্ট্রসনোগ্রাম মেশিনটি চার বছর ধরে নষ্ট। কমপ্লেক্সের একটি এক্সরে মেশিন সচল থাকলেও অপর একটি দেড় যুগ ধরে অকেজো। রেডিওলজিস্ট পদটি কয়েক বছর ধরে শূন্য রয়েছে।
বানারীপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুই কোটি টাকা মূল্যের এক্সরে মেশিন চার মাসেও চালু হয়নি। বরাদ্দ আসা এসিটি চার মাসেও প্যাকেট থেকে খোলা হয়নি। হাসপাতালে একজন রেডিওগ্রাফার থাকলেও তাকে উন্নত ও ডিজিটাল এক্সরে মেশিন চালানোর কোনও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি।
দশমিনার ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্সরে মেশিন একযুগ ধরে বিকল। রয়েছে জনবল সংকট। চিকিৎসক সংকট থাকায় বর্তমানে অপারেশন বন্ধ রয়েছে। এক্সরে মেশিন বন্ধ একযুগ ধরে। আল্ট্রাসনোগ্রফ মেশিনও বন্ধ দীর্ঘদিন।
চরফ্যাশন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি মেশিন। জনবল না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রগুলো নষ্ট হচ্ছে। ইসিজি ও আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন থাকলেও টেকনোলজিস্ট নেই। এক্সরে মেশিন চালানোর টেকনোলজিস্ট নেই।
অক্সিজেনের অব্যবস্থাপনা
করোনা মহামারিতেও বরিশালের ৬ জেলা আর ৪২ উপজেলায় ৪৭টি সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের মধ্যে ৩৯টিতেই পৌঁছায়নি কেন্দ্রীয় অক্সিজেন বিতরণ ব্যবস্থা। এসব হাসপাতালে এখনও রোগীদের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার হয় সিলিন্ডারে থাকা অক্সিজেন। সর্বোচ্চ ১২ লিটার অক্সিজেন থাকে এসব সিলিন্ডারে। উচ্চ শ্বাসকষ্টের রোগীদের ক্ষেত্রে এসব সিলিন্ডার মাত্র কয়েক মিনিট সাপোর্ট দিতে সক্ষম। তাই হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম না থাকলে এসব সিলিন্ডার কোনও কাজে আসবে না।
শেবাচিম হাসপাতালে ৩৪টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এর বাইরে ভোলায় ৩টি এবং পটুয়াখালীতে ৫টি আইসিইউ বেড থাকলেও সেগুলো পড়ে আছে অকার্যকর অবস্থায়। এর মধ্যে ভোলায় থাকা ৩টি আইসিইউ বেড বসানো হলেও স্পেশালিষ্ট নেই বলে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বরিশালের হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ করোনা কিংবা শ্বাসকষ্টের রোগীদের চিকিৎসা হয় না বললেই চলে।
দেড় কোটি মানুষের এই বিভাগে প্রতি ২৩ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ১ জন ডাক্তার।
করোনাসহ যে কোনো শ্বাসকষ্টের রোগীকে অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়ার প্রশ্নে জরুরি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা’রও রয়েছে চরম সংকট। বর্তমানে যেখানে প্রতিদিন করোনা শনাক্ত হচ্ছে গড়ে ১৮০ থেকে ২শ’ জন সেখানে পুরো বিভাগে রয়েছে মাত্র ৭৫টি হাই ফ্লো।
এর বাইরে জনবল সংকট তো আছেই। শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসকের মোট পদ ২২৪ হলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৮৪ জন। অন্য হাসপাতালগুলোর চিত্রও প্রায় একই। সব মিলিয়ে করোনা কিংবা সাধারণ চিকিৎসা, সবক্ষেত্রেই ছন্নছাড়া বরিশাল বিভাগের স্বাস্থ্যসেবা।
সূত্রমতে, শেবাচিম হাসপাতালে সাপ্লাই সিস্টেমের রির্জাভারেই রয়েছে কেবল ২০ হাজার লিটার অক্সিজেন সংরক্ষণের ব্যবস্থা। বাকি ৪ জেলা হাসপাতালে মেনিফোল্ড পদ্ধতির অক্সিজেন ট্যাংকারগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৩ হাজার ৪২০ লিটার করে। এর বাইরে উপজেলা পর্যায়ে গৌরনদী, দুমকি এবং মীর্জাগঞ্জে রয়েছে ছোট আকৃতির মেনিফোল্ড অক্সিজেন রির্জাভার। এগুলোর ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৭২০ লিটার করে। যা পুরো বিভাগের রোগীদের জন্য অতি নগণ্যই বলা চলে।
প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে যদি ছোট আকারেরও একটি করে মেনিফোল্ড রির্জাভার এবং সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই থাকতো তাহলে হয়তো করোনাসহ অন্যান্য শ্বাসকষ্টের রোগে মৃত্যুর হার অনেক কমে যেত।
বরিশালের গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী আনিসুর রহমান স্বপন বলেন, ‘প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে যদি ছোট আকারেরও একটি করে মেনিফোল্ড রির্জাভার এবং সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই থাকতো তাহলে হয়তো করোনাসহ অন্যান্য শ্বাসকষ্টের রোগে মৃত্যুর হার অনেক কমে যেত।’
ওয়ার্ডবয় দিয়ে চিকিৎসাসেবা
দুর্নীতি ও অনিয়মের ঝাণ্ডা গেঁড়ে বসেছে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেএক্সে। দুই যুগ ধরে হাসপাতালের কর্মচারীদের বদলি না থাকায় হাসপাতালের দুর্নীতি এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সেবা গ্রহিতাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অর্থের বিনিয়মে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
সূত্র মতে, হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় মো. আবুল কালাম জমাদ্দার আছেন ২৫ বছর ধরে, মোতালেব হোসেন কর্মরত আছেন ২২ বছর ধরে। তারা দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকায় নিজেরাই এখন ডাক্তার। এ ‘ওয়ার্ড বয় ডাক্তারদের’ দিয়ে চলছে জরুরি বিভাগের নিয়মিত চিকিৎসাসেবা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ