দেশের বিভিন্ন বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প, গার্মেন্টস, আইটিসহ বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে বিদেশি কর্মীরা। এদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা বেশি। অনেকেই আছে অবৈধভাবে। তাদের উপার্জিত বিশাল পরিমাণ অর্থ প্রতিবছর পাচার হচ্ছে বিদেশে। এদিকে, বৈধভাবে যারা আছে, তারাও কর ফাঁকি দেয়ার উৎসবে মেতে আছে। অন্যদিকে করোনা মহামারিতে দেশের কোমর পানিতে ডুবে থাকা অর্থনীতির গলা অব্দি ডুবে গেছে। বাড়ছে বেকারত্ব। কমছে চাকরির সুযোগ। এর মাঝেই ভারতীয়দের কর্মস্থলে ফেরানোর বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া।
ভারতীয় কর্মীদের ফেরাতে তৎপর সরকার
সম্প্রতি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টে যুক্ত বিশেষজ্ঞ এবং গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা ভারতীয় কর্মীদের দীর্ঘ অনুপস্থিতি প্রকল্প বাস্তবায়নে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। এতে প্রকল্পগুলোর কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়া এবং বাজেট বরাদ্দ বেড়ে যাওয়াসহ অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। সেই সব শঙ্কা বিবেচনায় অপরিহার্য কর্মীদের জরুরিভিত্তিতে কর্মস্থলে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ভারত সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, অভ্যন্তরীণভাবে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি-কর্ম শুরুর তাগিদ দিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং সংস্থাগুলোকে চিঠি পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
রাশিয়ার সহযোগিতায় বাস্তবায়িত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে যুক্ত রাশিয়ান কর্মীদের সম্প্রতি বিশেষ ব্যবস্থায় ফেরানো হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবিলা করে ভারতীয়দের ফেরানো যায় কিনা সেটাই ভাবছে সরকার।
উল্লেখ্য, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট এবং গার্মেন্টস খাতের গুরুত্বপূর্ণ পোস্টগুলোতে অনেক ভারতীয় কর্মী কাজ করেন। মহামারি করোনাকালে বেশির ভাগ ভারতীয় তাদের কর্মস্থলে ছিলেন, তারা সংক্রমণ মুক্ত ছিলেন। পরবর্তী উভয় দেশের করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটলে অর্থাৎ নতুন বছরের শুরুতে পরিস্থিতি খানিক স্বাভাবিক হলে শত শত কর্মী বাৎসরিক ‘হোম লিভ’ বা পরিবারের প্রয়োজনে দেশে গেছেন। মার্চ-এপ্রিলে তাদের ফেরার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে মধ্য এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে বিশেষ বিমান পরিসেবা ‘এয়ার বাবল’সহ সব ধরনের ফ্লাইট যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ।
প্রতিবছর ক্ষতি ৩৮ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশে বৈধ এবং অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখ। এদের অনেকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। আবার অনেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে কোন কর না দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলে উঠে এসেছে টিআইবি’র গবেষণায়।
পাশাপাশি বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা প্রতিবছর অবৈধভাবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এমন তথ্য উঠে এসেছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায়।
টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, বিদেশী নাগরিকরা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন সেখানে তাদের প্রকৃত বেতন গোপন করা হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশে কোন কোন দেশের কতজন বিদেশি নাগরিক কাজ করে, সেবিষয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।
এমনকি অনেকক্ষেত্রেই তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের নথিপত্রে বিদেশি কর্মীদের উল্লেখ থাকে না। আয়কর ফাঁকি দিতে বৈধভাবে কাজ করা বিদেশি কর্মীদের বেতনও প্রকৃত বেতনের চেয়ে অনেক কম দেখানো হয়। এছাড়া প্রকৃত বেতনের একটি অংশ বৈধভাবে দেয়া হলেও সিংহভাগই অবৈধভাবে নগদ দেয়া হয়ে থাকে।
গার্মেন্টসখাতে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের উদাহরণ তুলে ধরে টিআইবি বলেছে, সেখানে একজন বিদেশী নাগরিক সিইও হিসেবে প্রতিমাসে ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার বেতন পেলেও কাগজপত্রে সেটি দেখানো হচ্ছে মাত্র তিন থেকে চার হাজার ডলার।
কর আদায়ে ১৬৫তম স্থানে বাংলাদেশ
এদিকে, বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বিপরীতে কর আদায়ে বিশ্বে অন্যতম দুর্বল অবস্থানে আছে। ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। করোনার কারণে এ অবস্থান আরও নিচে নামছে। জিডিপির অনুপাতে গত ৫ বছরের গড় হিসাবে বাংলাদেশের কর আদায় ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ।
পাশের দেশ ভারতে ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কর আদায় নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশের করব্যবস্থায় যে পরিমাণ ফাঁকি দেওয়া হয়, তা অন্য কোনো দেশে নেই। কর ফাঁকি বন্ধ করতে পারলে রাজস্ব আদায়ে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সম্ভব।
অবৈধ নাগরিক প্রায় ১৩ হাজার
দেশে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের নজরদারিতে রাখার কাজ নিয়োজিত পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৭৯০। এর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি হচ্ছেন ভারতের নাগরিক।
এরপরই রয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা। এদের কেউ ভ্রমণ ভিসায়, কেউ ব্যবসায়িক ভিসায়, কেউবা ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসায় এ দেশে এসে অবৈধভাবে রয়ে গেছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭ বছর ধরে আছেন মিসরের ছয় নাগরিক। আর সর্বনিম্ন অবৈধ অবস্থানকারীরা আছেন তিন বছর ধরে।
এদের অনেকেই অনেকে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রে জড়িত। আবার অনেকে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন এবং কর ফাঁকি দিয়ে উপার্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, এদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন বৈধ বিদেশিদের সংখ্যা প্রায় তিন–চতুর্থাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন অভিবাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সরকারি হিসাবে এখন বৈধভাবে ১৪০টি দেশের ২০ হাজার ১৯৭ জন নাগরিক রয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০ হাজার ৯৭৪ জন হলেন ভারতের নাগরিক। এরপরই চীনের ২ হাজার ৯৩ জন।
বাড়ছে বেকার, কমছে চাকরির সুযোগ
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে আর বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই এই বেকারত্ব বাড়ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ আর ২৭ লাখ বেকার। এদিকে, সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পান না এরকম মানুষ রয়েছেন প্রায় ৬৬ লাখ। এরা মূলত টিউশনি, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয় কর্মী ইত্যাদি খণ্ডকালীন কাজ করেন।
করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি হওয়া মন্দায় ব্যাংকিং, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কমিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই করেছে। আর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের চাকরি সংক্রান্ত একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী একেএম ফাহিম মাশরুর এ প্রসঙ্গে বলন, আগে যেরকম বিজ্ঞাপন আসতো, করোনার কারণে সেটা ৬০%, ৭০% কমে গেছে। মে মাসে একটু বাড়লেও এখনো ৫০% কম আছে। যেসব বিজ্ঞাপন আসছে, সেখানে অভিজ্ঞ লোক চাওয়া হচ্ছে, ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের চাহিদা আরও অনেক কমে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ