দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) অভিজ্ঞতায় আমার স্নায়ু যথেষ্ট কঠিন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধও এত পৈশাচিক নয়, এ এক মধ্যযুগীয় বর্বর উন্মাদনা এবং এটাকে পৈশাচিক রূপ দেয়া হয়েছিল।” [‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ প্রসঙ্গে স্টেটসম্যান পত্রিকার বৃটিশ সাংবাদিক কিম ক্রিস্টেন]
দেশভাগের দুইটা পার্সপেক্টিভ ছিলো। ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজমের দৃষ্টিতে পুরো ব্যাপারটাই ছিলো পলিটিক্যাল। আর ভারতীয়দের কাছে ছিলো ধর্মীয় এবং জাতিগত। ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোর প্রস্তাবে জিন্নার বক্তব্য বিষয়টাকে স্পষ্ট করে তোলে।
“ভারতবর্ষের সমস্যা সাম্প্রদায়িক নয়, বরং জাতিগত। এটা খুবই দুঃখের যে হিন্দুরা ইসলাম ও হিন্দুত্বের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারছেন না। ইসলাম এবং হিন্দুত্ব শুধুমাত্র আলাদা ধর্ম নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত দুই জাতিসত্ত্বা। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক ইতিহাস থেকে প্রেরণা পায়। এদের একজনের মহাপুরুষ অন্য জনের শত্রু। মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয়, মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি। জাতি গঠনের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের মধ্যে আছে। তাই তাদের অবশ্যই নিজের বাসভূমির অধিকার আছে।” [ভিপি মেনন, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পৃষ্ঠা-৮২]
তবে শুধু জিন্না নয়, ধর্মের খুঁটি গেঁড়ে জাতিগত এই বিভাজনের যজ্ঞের আগুনে ঘি ঢেলেছেন গান্ধী নিজেও। হরিজন পত্রিকায় কয়েকদফায় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির পক্ষে লিখেছিলেন তিনি। পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে গান্ধী সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েছে।
১৯৪২ সালের ১৮ই এপ্রিল গান্ধীজী হরিজন পত্রিকায় লেখেন,
“যদি ভারতের বেশীর ভাগ মুসলমান এই মত পোষণ করে যে মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি, যাদের সঙ্গে হিন্দু ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মিল নেই, তবে পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যে সেই চিন্তাভাবনা থেকে তাদের বিরত করতে পারে এবং সেই ভিত্তিতে তারা যদি বেশীর ভাগ চায়, তবে অবশ্যই দেশভাগ করতে হবে। তবে ইচ্ছা করলে হিন্দুরা তার বিরোধীতা করতে পারে।”
পাকিস্তান দাবি অপ্রাসঙ্গিক ছিলো না। কিন্তু এই দাবির পেছনের কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার পথ তৈরি করে দিয়েছে। যে পথ রক্তের, হিংস্রতার। উপমহাদেশের বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। জম্মু কাশ্মীর নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। এখান থেকেই প্রায় ৫ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’ যার বড় একটি কারণ। তবে এই নোয়াখালী দাঙ্গার বীজ বোনা ছিলো ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসে’।
১৯৪৬ সালের জুলাইয়ে, মুসলিম লীগের ক্যাবিনেট মিশনের চুক্তি প্রত্যাহারের মাধ্যমেই সেরে ফেলা হয় ‘গ্রেট কলকাতা কিলিং’য়ের সমস্ত আয়োজন। মুসলিম লীগের এই প্রত্যাহারের কারণ ছিল, ক্যাবিনেট মিশন চুক্তি সংশোধন করার অধিকার সংরক্ষণ করছিল কংগ্রেস। ১০ জুলাই কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহেরু বোম্বাইয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেন যে, কংগ্রেস শুধুমাত্র গণপরিষদে অংশ নিতে রাজি হয়েছে এইজন্য যে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাকে উপযুক্ত করতে সংশোধন করার অধিকার সংরক্ষণ করবে তারা। [ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম: দ্য কমপ্লিট ভার্শন পৃষ্ঠা ১৬৪-১৬৫]
এরপর জিন্নাও বোম্বাইয়ের (বর্তমান মুম্বাই) নিজ বাড়িতে একটি সংবাদ সম্মেলন ক’রে বলেন যে, মুসলমানদের যদি আলাদা পাকিস্তান না দেওয়া হয় তবে তারা ‘সরাসরি পদক্ষেপ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের’ ডাক দেবে। এরপর দিন জিন্নাহ ১৬ আগস্টকে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ বা ’‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’ হিসাবে ঘোষণা করেন এবং কংগ্রেসকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না। যদি আপনারা যুদ্ধ চান, তবে আমরাও যুদ্ধ করতে পিছুপা হবো না। আমাদের হয় বিভক্ত ভারত অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারত থাকবে।’ [হাফওয়ে টু ফ্রিডম: অ্যা রিপোর্ট অন দ্য নিউ ইন্ডিয়া ইন দ্য ওয়ার্ডস এন্ড ফটোগ্রাফস। পৃষ্ঠা ১৫]
এদিকে, ১৯৪৬ সালে কংগ্রেসকে হারিয়ে প্রাদেশিক নির্বাচনে জিতে বাংলায় ক্ষমতা দখল করে মুসলিম লীগ। সোহরাওয়ার্দী বা সুরাবর্দী হন মুসলিম লীগ সরকারের মূখ্যমন্ত্রী। আর এই সুরাবর্দীই জিন্নার ডাইরেক্ট এ্যকশন ডে বাস্তবায়ণ করেন।
এক নিবন্ধে সুরাবর্দী লেখেন, “হিংসা এবং রক্তপাত অন্যায় নয়, যদি তা মহৎ উদ্দেশ্যে করা হয়। মুসলমানদের কাছে আজ পাকিস্তান আদায় করা ছাড়া অন্য কোন প্রিয় কাজ নেই।” [৫ই আগস্ট, ১৯৪৬; স্টেটসম্যান]
এরপর ১৬ আগস্ট সকাল থেকেই শুরু হয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। এদিন সকাল থেকেই জোরপূর্বক হিন্দুদের দোকানগুলোকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। এরপর দুপুরে অক্টারলোনি মনুমেন্টের কাছে শুরু হয় লীগের সমাবেশ। এই সমাবেশটি তখনকার ‘বাংলার সর্বকালের বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ’ হিসাবে বিবেচিত হয়। নামাজের পর কলকাতার সমস্ত অঞ্চল থেকে মুসলমানদের মিছিল শুরু হয়। লোহার রড এবং লাঠি নিয়েই মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল একটি বড় অংশ। একজন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার রিপোর্টারের তথ্য অনুযায়ী ৩০ হাজার জন সমাবেশে উপস্থিত ছিল বলে জানা যায়। স্টার অফ ইন্ডিয়া রিপোর্টার এই সংখ্যাকে প্রায় এক লক্ষের উপরে রেখেছেন।
এই সমাবেশে সামরিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিযুক্ত সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স অফিসার এবং প্রতিবেদক ফ্রেডেরিক বারোজ একটি বিবৃতিতে বলেন, সুরাবর্দী সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে সংযত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও পুলিশের ‘নীরব’ থাকার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আদেশ দেওয়া হয়নি। এদিকে, আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন, সমগ্র কলকাতা শহরে যখন নারী পুরুষ খুন হচ্ছিল তখন পুলিশ ও মিলিটারি নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। [কেন উদ্বাস্তু হতে হল। বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র। পৃষ্ঠা ৩২]
এই সমাবেশ শেষ হওয়ার পর ফেরার সময় অনেকেই হিন্দুদের উপর আক্রমণ এবং হিন্দুদের দোকান লুট করা শুরু করেছিল বলে জানা যায়। এছাড়াও কলকাতায় হ্যারিসন রোডে ট্রাকে করে আসা কট্টরপন্থী মুসলমানরা ইটপাটকেল ও বোতল নিয়ে হিন্দু মালিকানাধীন দোকানে আক্রমণ করেছিল [ইন্ডিয়া অ্যা হিস্টোরি, পৃষ্ঠা ৫০৫]। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ হুঙ্কার ছেড়ে তারা দল বেঁধে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা ধরে। অবাধে চলে লুটপাট‚ খুন, জখম‚ ধর্ষণ।
এ দিনের বিভৎসতা তুলে ধরে ডি.সি নর্থ খান সাহেব খলিলুর রহমান তার রিপোর্টে লিখেছেন, “বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা চলেছে ধর্মতলা স্ট্রীট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট, মার্কেট স্ট্রীট, কর্পোরেশন স্ট্রীট এবং ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে। দোকান লুঠ হয়েছে, খুন হয়েছে এবং হামলা এখনও চলছে। মিলিটারী মোতায়েন করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।”
হত্যা, ধর্ষণ, প্রাণের ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরের চেষ্টা, বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ এবং লুটপাটে কলকাতা পরিণত হয়েছিল নরকে। টানা তিন দিন চলে এই বিভৎসতা। এ সময় গৃহহীন হয় হাজার হাজার হিন্দু। কতজন যে ধর্ষিত এবং অপহৃত হয়েছিল, তার হিসেব নেই। কলকাতার রাস্তায় এখানে সেখানে লাশ পড়েছিল।
প্রথম তিন দিনে প্রায় ২০ হাজার লোক নিহত হয় [জ্যোতি বসু]। শহরের সমস্ত ড্রেন হিন্দুদের লাশে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল, আর গঙ্গায় এত লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল যে দুর্গন্ধে মাঝিদের নৌকা চালান অসাধ্য হয়ে উঠেছিল। বাঁশের লগি দিয়ে লাশ সরিয়ে সরিয়ে রাস্তা তৈরি করে মাঝিদের নৌকা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল।
১৮ আগস্ট সকালে বাস ও ট্যাক্সি ভর্তি শিখ এবং হিন্দুরা তরোয়াল, লোহার রড এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এই সাম্প্রদায়িক সংঘাত প্রায় এক সপ্তাহ অব্যাহত ছিল। শেষ অবধি, ২১ আগস্ট বাংলাকে ভাইসরয়ের শাসনের অধীনে রাখা হয়। ভারতীয় এবং গোর্খাবাহিনীর চারটি ব্যাটালিয়নসহ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৫ টি ব্যাটালিয়ন শহরে নিয়োগ করা হয়েছিল। পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য থাকা সত্যেও কেন সৈন্যদের আরো আগে ডাকা হয়নি সেই বিষয়ে লর্ড ওয়াভেল পরবর্তীতে অভিযোগ করেন। তিনি আরও বলেন, পলাশীর যুদ্ধে যত লোকের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক লোকের মৃত্যু হয়েছে কলকাতার দাঙ্গায় [কেন উদ্বাস্তু হতে হল, পৃষ্ঠা ৩২]।
আপনার মতামত জানানঃ