বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন আফ্রিকান দেশ কঙ্গোয় নৃশংস গণহত্যার জন্য। কঙ্গোর বাসিন্দাদের ওপর বেলজিয়ামের প্রথম সাংবিধানিক রাজা লিওপল্ড যে নির্যাতন চালিয়েছেন তার জন্য ঐতিহাসিকরা পর্যন্ত তাকে ‘বুচার অব কঙ্গো’ বা কঙ্গোর কসাই হিসেবে আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন।
১৮৬৫ সালে সিংহাসনে আরোহনের আগেই আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য বেলজিয়ামের রাজনীতিবিদদের মধ্যে লবিং শুরু করেন লিওপোল্ড। ব্রিটেন, জার্মানি ও স্পেন ওই সময় আফ্রিকা দূর প্রাচ্যে উপনিবেশ স্থাপন করে ফেলেছে। লিওপল্ডের দাবি, বেলজিয়াম উপনিবেশ স্থাপন করতে না পারলে ইউরোপে তার মর্যাদা থাকবে না। ওই বছরেরই ১৭ ডিসেম্বর সিংহাসনে আরোহন করেন লিওপোল্ড। এরপর আফ্রিকায় গোয়েন্দাগিরি ও উপনিবেশ স্থাপনের জন্য জায়গা বাছাইয়ে পর্যটক ও পাদ্রী হেনরি এস স্ট্যানলিকে ব্যবহার করেন তিনি। আফ্রিকার মানুষদের ‘শিক্ষিত’ করার ব্রত নিয়ে লিওপল্ড ইন্টারন্যাশনাল আফ্রিকান সোসাইটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের আড়ালে পুরোদস্তুর দাস ব্যবসা চালিয়ে যেতেন লিওপোল্ড। ১৮৭৯ সালে কঙ্গোর বিশাল এলাকা নিজের বলে দাবি করেন তিনি।
প্রথম দিকে যেমনটা আশা করেছিলেন কঙ্গো থেকে ততোটা মুনাফা পেতেন না লিওপোল্ড। তার বাণিজ্য তখন সীমিত ছিল হাতির দাঁত ও দাস বিক্রির ওপর। তবে কয়েক বছরের মাথায় রাবারের ব্যবহার জেনে যায় মানুষ। রাবারের সঙ্গে কার্বন মেশালে সেটা যে প্রায় অক্ষয় বস্তুতে পরিণত হয় সেটা আবিষ্কার হয়েছে ওই সময়। গাড়ির শক্ত চাকা সেই কালো বস্তুতে মুড়ে দিলে চলাফেরা হয় মসৃন। এ কারণে টায়ারের তখন ব্যাপক চাহিদা। কঙ্গোর প্রাকৃতিক রাবার তখন লিওপোল্ডের কাছে হয়ে ওঠে সোনার খনি। তিনি কঙ্গোর মানুষদের দিয়েই কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন শুরু করেন। কঙ্গোতে তার নিজস্ব বাহিনীর নাম ছিল ফোর্স পাবলিক।
লিওপোল্ড রাবার সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বেলজিয়ামের ব্যবসায়ীদের। রাবার সংগ্রহের জন্য তারা স্থানীদের ওপর লোমহর্ষক ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাতো । রাবার সংগ্রহকারীদেরকে রাবার গাছের জন্য জঙ্গলে ঢোকার সময় গাছের পাতায় ও লতায় লম্বা দা দিয়ে কোপ দিতে হতো। এতে অনেক সময় তরল রাবার ছিটকে এসে তাদের গায়ে আটকে যেত। লিওপোল্ডের সেনারা এসব রবার অপচয় করতে রাজী ছিল না। তারা পরে দা কিংবা ছুরি দিয়ে তাদের শরীর থেকে এই রাবার উঠিয়ে নিতো। শরীর থেকে এভাবে রাবার উঠানোর সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পশমসহ চামড়া উঠে আসত। চামড়া উঠে পড়ায় এই মানুষগুলোর গগনবিদারি চিৎকার গায়েই মাখতো না লিওপোল্ডের সেনারা।
রাজা লিওপোল্ডের নির্দেশে ফোর্স পাবলিকের অফিসাররা জনপ্রতি আইভরি বা হাতির দাঁত ও রাবার সংগ্রহের কোটা ধার্য করে দিত। নির্দিষ্ট পরিমাণ আইভরি বা রাবার সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এই দণ্ড কার্যকর করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর গুলি অপচয় হয়েছে কি-না তার প্রমাণ হিসেবে প্রত্যেকটি গুলির বিপরীতে মানুষের একটি করে কাটা কব্জি জমা দিতে হতো। তবে সেনাবাহিনীর অফিসারদের দয়া হলে কুমিরের চামড়ার চাবুক খেয়েই অনেকে বেঁচে যেত।
লিওপোল্ড বাহিনীর নির্যাতনের ছোট্ট একটি নমুনা এখানে তুলে ধরা হলো।
১৯০৪ সালের ঘটনা এটি। রাবার চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরন করতে না পারায় এক কৃষ্ণাঙ্গের পাঁচ বছরের মেয়ের হাত-পা কেটে খুন করে লিওপোল্ড বাহিনী। এরপর তার স্ত্রীকে খুন করা হয়। পরে ওই চাষীর সামনে তার মেয়ের কাটা হাত-পা রেখে দেওয়া হয় শাস্তি হিসেবে।
লিওপোল্ডের বাহিনীর নির্যাতনে কঙ্গোর ঠিক কতো লোক মারা গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত যে, এ সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ লাখের নিচে নয়।
তবে মার্কিন লেখক অ্যাডাম হসচাইল্ড তার কিং লিওপোল্ড’স ঘোস্ট বইতে দাবি করেছেন, ওই সময় সরকারি বিভিন্ন নথির মাধ্যমে জানা গেছে, লিওপোল্ডের নির্যাতনে কঙ্গোর অর্ধেক বাসিন্দা মারা গেছে। আর ১৯২৪ সালে বেলজিয়ান সরকার পরিচালিত প্রথম আদম শুমারিতে দেখা গেছে, তখন কঙ্গোর জনসংখ্যা ছিল এক কোটি। অর্থাৎ এই হিসেব করলে, লিওপোল্ডের নির্যাতনে নিহত মানুষের সংখ্যা এক কোটি!
১৮৮৯ সালে আমেরিকার রাজনীতিবিদ, উকিল, সাংবাদিক ও আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাসের লেখক জর্জ ওয়াশিংটন উইলিয়ামস কঙ্গোতে নিজের চোখে লিওপোল্ড বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র দেখেন। ১৮৯০ সালের ১৯ জুলাই তিনি লিওপোল্ডের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লেখেন। এতে তিনি লিওপোল্ডকে বলেন, রাজার নামে সেনারা কঙ্গোবাসীর ওপর বর্বর অত্যাচার করছে। এর ফলে তার সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। তাই তিনি যেন অবিলম্বে এসব বন্ধ করেন।
জর্জ ওয়াশিংটন উইলিয়ামসের লেখা এই চিঠিটিই ছিল কঙ্গোতে লিওপোল্ড বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ। তিনি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কঙ্গোতে ঘটা এই বর্বর অত্যাচারের চিত্র ফাঁস করে দেন।
১৯০৬ সালে অধিকারকর্মী ও লেখক ই ডি মোরেলের লেখা ‘রেড রাবার’ বইটি প্রকাশের পর কঙ্গোর বিষয়টি আবারও আলোচনায় চলে আসে। ব্যাপক সমালোচনার পর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের চাপে ১৯০৮ সালে রাজার হাত থেকে কঙ্গোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বেলজিয়াম সরকার। বিচারতো দূরের কথা, বরঞ্চ কঙ্গো ছেড়ে দেওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে লিওপোল্ডকে দেওয়া হয় পাঁচ কোটি ফ্রাঁ।
আর্মেনিয়ার গণহত্যা কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধন নিয়ে যতোটা আলোচনা হয়, তার সিকিভাগও হয় না কঙ্গোতে পরিচালিত বেলজিয়ামের রাজার গণহত্যা নিয়ে। বরং উপনেবিশবাদীরা সুকৌশলে বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন বারবার। আজও কঙ্গোর কাছে বর্বর নির্যাতনের জন্য ক্ষমা চায়নি বেলজিয়াম।
ছবিতে-ছবিতে কঙ্গোয় বেলজিয়াম রাজার বর্বর নির্যাতন:-
লেখা: সংগৃহীত
ছবি: Rare Historical Photos.com
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪১
আপনার মতামত জানানঃ