[zoomsounds_player artistname=”আদিবাসীদের উপর ব্রিটিশদের নির্মম গণহত্যার ইতিহাস” type=”detect” dzsap_meta_source_attachment_id=”13975″ source=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/চা-শ্রমিকদের-আন্দোলন.mp3″ thumb=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/গণহত্যা-২.jpg” config=”default” autoplay=”off” loop=”off” open_in_ultibox=”off” enable_likes=”off” enable_views=”off” enable_rates=”off” play_in_footer_player=”default” enable_download_button=”off” download_custom_link_enable=”off”]
১৯২১ সালের আদিবাসী চা শ্রমিকদের ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলন আর তাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া গণহত্যা মুছে যাচ্ছে ইতিহাস থেকে। এর রাজনৈতিক কোন মূল্যই আজ আর নেই। অথচ করপোরেট পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের প্রথম সংগঠিত বিদ্রোহ ছিল এটি। ছিল ভূমিহীন খেটে খাওয়া আদিবাসী শ্রমিকদের বিদ্রোহ। নির্যাতন আর নিপীড়নের জীবন থেকে ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে আসাম আর সিলেটের চা বাগান থেকে বাংলাদেশের চা শ্রমিকেরা অনেক কষ্টে চাঁদপুর স্টিমারঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন। মেঘনা পাড়ি দিতে চাইলে তারা গণহত্যার শিকার হন। চরগোলা এক্রস নামে এই চা শ্রমিক আন্দোলন পরিচিত। সিলেট ও কাছাড়ের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল— ইংরেজ মালিকদের অধীনে আর কাজ করবেন না তারা। তারা ফিরে যাবেন তাদের নিজের আবাসভূমিতে।
আন্দোলনের গোড়ার কথা
চীন-জাপান যুদ্ধের কারণে চীনের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্কের অবনতি হলে চা আমদানি অনিশ্চিত হয়ে যায়। বিকল্প চা উৎপাদনের জন্য ব্রিটিশদের নজর পড়ে ভারতবর্ষের ওপর। এজন্য ১৮৩৫ সালে তারা ‘রয়েল সোসাইটি’ নামে একটি কমিশন গঠন করে। যদিও এই কমিশন কাজ শুরু করার আগেই শিলচর ও করিমগঞ্জে চা গাছের সন্ধান পাওয়া যায় এবং প্রথম চীনের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। ১৮৩৮ সালে সিলেট ও কাছাড়ে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় চায়ের উৎপাদন। এভাবে ভারতবর্ষে আসামের লখিমপুরে, সিলেট ও কাছাড় জেলায় চায়ের উৎপাদন ব্যাপকতা পায়।
চা বাগানে সস্তা শ্রমিকের আশায় প্রথমে স্থানীয়দের কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়। এবং এ কাজে তাদের বাধ্য করার জন্য শুরু হয়ে নানা উৎপাত। কৃষকদের খামারে উচ্চ হারে কর আরোপ করা হয়। পান সুপারির ওপরও কর আরোপ করা হয়। তারপরও সফল হতে পারেনি ব্রিটিশরা।
এদিকে ক্রীতদাস প্রথা বাতিল হয়ে গেছে অনেক আগে। তবু ১৮৩৪ সালের দিকে, একপ্রকার সেই ক্রীতদাস ব্যবস্থার কাছেই ফেরে ব্রিটিশরা। আজীবন কাজের শর্তে এক আজব চুক্তিতে গোলাম বানিয়ে ফেলে এ দেশের আদিবাসীদের। মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ভারতের নানা অভাবী জনপদ থেকে তারা শ্রমিক সংগ্রহ করতে শুরু করে। এর মধ্যে আছে বিহারের রাঁচি, হাজারীবাগ, সাঁওতাল পরগনা, ডুমকা ও গয়া; ওডিশার ময়ূরভঞ্জ, গঞ্জাম, সম্বলপুর ও চাইবাসা এবং মধ্যপ্রদেশের রায়পুর, রামপুরহাট ও জব্বলপুর। এ ছাড়া উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্য নেপাল থেকেও একপর্যায়ে শ্রমিক আনা হয়। এভাবে প্রায় ১১৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে চা শ্রমিক বানিয়ে তাদের আসাম ও সিলেট অঞ্চলে নিয়ে আসে চা বাগানের মালিক কোম্পানিগুলো। চা রপ্তানির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ১৮৬৪–৬৫ সালে রেল লাইন স্থাপন করে এবং প্রসারিত করে ১৯০৪ সালে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত করে। ফলে বাহির থেকে শ্রমিক আমদানি অনেক সহজ হয়ে যায়।
এদিকে, আদিবাসীরা এই অঞ্চলে হিংস্র জীবজন্তুর প্রতিকূল পাহাড়–জঙ্গলময় পরিবেশে অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন হয়। সে সময় আড়কাঠি ও গিরমিট প্রথার কারণে চা ম্যানেজাররা অসহায় ওই মানুষগুলোর ওপর একচ্ছত্র নির্যাতন করার অধিকার পান। কোনো শ্রমিক ইচ্ছে করলেই চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে পারতেন না। বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাদের ধরে আনা হতো। শাস্তি দেয়া হতো। চাবুক আর বুটের লাথি ছিল এই নিরীহ মানুষগুলোর কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এভাবে মালিকদের হাতে শ্রমিকের মৃত্যুও সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছিল।
পুরুষ শ্রমিকদের বেতন চার আনা, মহিলাদের বেতন তিন আনা এবং শিশুদের বেতন দুই আনা
১৮৪১ সালের দিকে ‘ফ্রি কনট্রাক্টরস’ পদ্ধতির নামে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কুলি সংগ্রহ করার জন্য চা করেরা এক চুক্তি করেন। এই চুক্তিতে স্থানীয় এজেন্টদের এবং লোভী এজেন্টদের আড়কাঠি বলা হয় এবং এই প্রক্রিয়াতেই হয় আড়কাঠি আইন। আড়কাঠিদের কাজ ছিল কুলিদের জাহাজ ডিপোতে নিয়ে এসে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া। একবার স্বাক্ষর করাতে পারলেই চা মালিকদের জিম্মায় চলে যেতেন শ্রমিকেরা। জাহাজে তোলার আগপর্যন্ত তাদের যত্ন নেয়া হতো। কিন্তু জাহাজের কর্তৃপক্ষের হাওলায় চলে আসার পরই শুরু হতো অমানবিক আচরণ। জাহাজের ধারণক্ষমতা যেখানে দুইশো জন, সেখানে তোলা হতো এক হাজার থেকে বারোশো জন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চা চাষের জন্য ১৮৬৩-১৮৬৬ সালে এই অঞ্চলে নিয়ে আসা ৮৪ হাজার ৯১৫জন শ্রমিকের মধ্যে অনাহারে অর্ধাহারে, অসুখে বিসুখে মারা গেছেন ৩০ হাজার জন শ্রমিক।
যেভাবে চালানো হয় গণহত্যা
১৯২১ সালের ৩ মার্চ অনিপুর চা বাগান থেকে ৭৫০ জন শ্রমিক বেরিয়ে এলে ভয় কাটিয়ে দলে দলে শ্রমিকেরা বাগান থেকে বের হতে থাকেন। উদ্দেশ্য ছিল নিজের মুলুকে ফিরে যাবে। চরগোলা অঞ্চলের চা শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। চা বাগান থেকে বের হয়ে আসে পরিবার নিয়ে। তারা কিছুই জানতো না। শুধু জানতো তাদের ফিরতে হবে। কত দিন লাগবে, কী খাবে, রাস্তাঘাট চিনবে কী করে এসব চিন্তা তাদের থামাতে পারেনি। তারা ভেবেছিল চাঁদপুর জাহাজঘাট অব্দি পৌঁছাতে পারলেই হবে। তাই জাহাজঘাটে যেতে সবাই জড়ো হতে থাকে রেলস্টেশনে। এদিকে চা বাগান মালিক ব্রিটিশরা শ্রমিকদের রেলের টিকিট না দেয়ার নির্দেশ দেয়। তাই অগত্যা সবাই হাঁটতে শুরু করে। ওই রেললাইন ধরেই হাঁটতে থাকে চাঁদপুর জাহাজঘাটের উদ্দেশে। এরপর জাহাজে উঠতে চাইলে সেই অসহায় মানুষগুলোকে গুলি করে ফেলে দেয়া হয় মেঘনায়। পাশাপাশি ক্ষুধার্ত আহত শ্রমিকেরা রাতে রেলস্টেশনে ঘুমানোর সময় পুলিশ কমিশনার কে সি দের নির্দেশে গুর্খা সৈন্যরা ঘুমন্ত শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ গুম করে ফেলে গুর্খা বাহিনী। এখানে কতজন যে অসহায়ভাবে প্রাণ হারাল, কতজন যে আহত হলো, তার কোনো হিসাব রাখা হয়নি।
আক্রমণের ফলে পুরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন শ্রমিকেরা। সাধারণ চাঁদপুরবাসী বাঙালি আর মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা সেদিন পাশে দাঁড়িয়েছিল চা শ্রমিক সেই আদিবাসীদের। ১৯২১ সালের সেই দিনে মাড়োয়ারি পাট ব্যবসায়ীরা তাদের পাটের গুদামে এবং মানুষজন তাদের বাড়িঘরে আশ্রয় দেন আহত ও ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের। চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ডাকা হয় হরতাল। রেল ও জাহাজ কোম্পানির কর্মীরা সে হরতালে সমর্থন জানান। প্রতিবাদ কর্মসূচিতে তারা অংশ নেন। এ ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়ে পাশের জেলাগুলোতে। রেল কর্মচারীদের সে ধর্মঘট স্থায়ী হয় আড়াই মাস। আর তার জেরে ৪ হাজার ৫০০ জন কর্মী চাকরিচ্যুত হন। আর জাহাজকর্মীদের ধর্মঘট চলে ছয় সপ্তাহ।
চা-শ্রমিকদের খাদ্য জোগানোর জন্য চাঁদপুরে হারাধন নাগের নেতৃত্বে রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়। জনসাধারণ উদারভাবে সাহায্যের হাত বাড়ান। একপর্যায়ে সরকার শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ করতে চাইলে শ্রমিকেরা তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। কিছুদিন পরেই শ্রমিকদের মধ্যে মহামারি আকারে কলেরা দেখা দেয়। বহু শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন।
এরপরই সরকার ও বেনিয়ারা মুসলিম লীগ, কংগ্রেসের সাথে বৈঠকে বসে। এই বৈঠকে করা হয় চার দফা শান্তি চুক্তি। চুক্তির শর্তগুলো ছিল— এ মর্মান্তিক ঘটনার পরেও যেসব শ্রমিক নিজ মুলুকে যেতে একান্ত ইচ্ছুক, কোম্পানি তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। কিছু কংগ্রেসকর্মী গিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। বাকিরা আসামে ফিরে গিয়ে আবার কাজ পাবে। কোম্পানি তাদের কাজ পেতে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করবে না।
এই একপেশে চার দফা আপসের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। এরপর আর কোনো তদন্ত হয়নি, জানা যায়নি নিহতের সংখ্যা। এমনকি ইতিহাস থেকেও মুছে যাচ্ছে আদিবাসী চা শ্রমিকদের এই আন্দোলন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ