যেখানে আদিবাসীরা বাস করে, সেখানে গেলেই একই কাহিনি শুনতে পাই। তাদের সহায়-সম্পত্তি ও জমি দখল করা হচ্ছে। সেটার জন্য হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন করা হচ্ছে এবং এগুলোর কোনো বিচার হচ্ছে না। আমরা এ ধরনের ঘটনাগুলোর বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। একই সঙ্গে মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, সে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
আজ বৃহস্পতিবার(০৮ আগস্ট) জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সুলতানা কামাল।
‘সাতক্ষীরার শ্যামনগরে নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যা ও আদিবাসী ভূমি দখলের প্রতিবাদে’ যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, এএলআরডি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, কাপেং ফাউন্ডেশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, স্বদেশ, সামস, হেগ ও নাগরিক সমাজ। গত ১৯ আগস্ট মুন্ডা জাতিগোষ্ঠীর নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আহত হন। পরদিন তিনি মারা যান।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, ‘অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে মুন্ডাদের পরিবারগুলোকে ঘিরে ধরে এ আক্রমণ করা হয়েছে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দিলেও তারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ায়নি। কেন অধিকার বঞ্চনার ঘটনা ঘটলে সংবাদ সম্মেলন করে বিচার চাইতে হয়। একটা সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে কিসের জন্য দুষ্কৃতকারী ও অন্যায়কারীদের সংবাদ সম্মেলন করে শাস্তি চাইতে হবে।’
সাতক্ষীরার মুন্ডা সম্প্রদায় শুধু নয়, এ হামলার ঘটনার সঙ্গে দেশের যেকোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাসকারী এলাকার মিল রয়েছে বলে উল্লেখ করেন সুলতানা কামাল।
‘দেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীদের ওপর সুপরিকল্পিত নির্যাতন হচ্ছে এবং পুলিশের ভূমিকার কথা আর বলা যাচ্ছে না। পুলিশের ভূমিকার নিন্দা জানাতে জানাতে আমরা ক্লান্ত। এখন সময় এসেছে পুলিশ একবার তাদের নিজেদের দিকে ঘুরে তাকাক। পুলিশের সব সদস্য যে খারাপ সেটা বলতে চাই না। কারণ অনেক কাজে আমরা পুলিশের সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু সার্বিকভাবে-সাধারণভাবে পুলিশের এমন ভূমিকা কোথাও দেখিনি সঙ্গে সঙ্গে এসে যারা আক্রান্ত হয়েছে সে জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে এবং সুষ্ঠু সুরহা করে দিতে পেরেছে।
কেন অধিকার বঞ্চনার ঘটনা ঘটলে সংবাদ সম্মেলন করে বিচার চাইতে হয়। একটা সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে কিসের জন্য দুষ্কৃতকারী ও অন্যায়কারীদের সংবাদ সম্মেলন করে শাস্তি চাইতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা; তা জনগোষ্ঠী যেকোনো শ্রেণির হোক, সংখ্যার হোক, জাতির হোক, বর্ণের হোক। সংবিধান বলে দিয়েছে রাষ্ট্র সবাইকে সমান চোখে দেখবে। প্রত্যেকের অধিকার সংরক্ষণ করবে। আজকে দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয়, মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।’
সুলতানা কামাল আরও বলেন, ‘একজনের মানুষের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়ে থাকে সে ব্যর্থতার দায়ভার তাকে গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে আদিবাসীদের জীবনে একটির পর একটি নিগ্রহ, অত্যাচার, ধর্ষণ, হত্যা চলতেই থাকবে। তাদের সম্পত্তি বেদখল হতেই থাকবে। তারা সে সংগ্রাম, আন্দোলন করেই জীবন পার করবে। একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তাদের অধিকার, বঞ্চনার কথা যদি আমরা না শুনি তাহলে আমার মনে হয় আসলে আমরা মাথা উচু করে বাঁচার অধিকারটুকু রাখি কি না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারের কথা বলি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের নীতি ধারণ করছি। মুক্তিযুদ্ধের কোন চেতনাকে ধারণ-বহন করছে সেটা নিয়ে আজ প্রশ্ন তুলতে হয়।’
‘স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, তারা কিন্তু ক্ষমতায় গেছেন জনগণের মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, সামাজিক অধিকার, ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার করে। তারা সে অধিকার রক্ষা করছেন না, বরং কখনো কখনো দেখা যায় তারা সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করছেন। তারা যে অঙ্গীকার করেছিলেন তার বিপরীতে কাজ করছেন।’
সম্মেলনে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি বলেন, ১৯ আগস্ট সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ধুমঘাট অন্তখালী মুন্ডাপল্লিতে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ভূমিগ্রাসী চক্র স্থানীয় ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের জড়ো করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মুন্ডাপাড়ার সব পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখে। তাদের হামলায় মুন্ডা জনগোষ্ঠীর ১২ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা পরের দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে মারা যান।
সঞ্জীব দ্রং জানান, জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মিলে ২৯ আগস্ট ওই ঘটনাস্থলে যান। তারা স্থানীয় মানুষ ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে স্থানীয় থানা-পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা জানতে পেরেছেন। ঘটনার সময় বিভিন্নভাবে স্থানীয় থানায় খবর দেওয়া হলেও পুলিশ সেখানে পৌঁছায় অনেক দেরিতে। পুলিশ এখনো মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
এ ঘটনার মূল হোতা রাশিদুল ও এবাদুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না বলে অভিযোগ করেন নিহত নরেন্দ্রনাথ মুন্ডার ছেলের স্ত্রী রিনা মুন্ডাও। তিনি বলেন, তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমার সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, মুন্ডাদের অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন-সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আশিক-ই-এলাহী, সদস্যসচিব গোপালচন্দ্র মুন্ডা ও মামলার বাদী ফনিন্দ্রনাথ মুন্ডা বক্তব্য দেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৮
আপনার মতামত জানানঃ