কিছু কিছু শস্যের উৎপত্তি নিয়ে আরকিওলজিস্টদের স্পষ্ট ধারণা আছে। এই যেমন ভূট্টার উৎপত্তি মেক্সিকোর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে প্রবাহিত বালসাস নদীর উপত্যকায় জন্মানো বুনো ঘাস থেকে। ধানও অন্য এক জাতের ঘাস থেকে এসেছে, এই ঘাস শিংহাই-তিব্বত নামক বরফাবৃত মালভূমি অঞ্চলে উৎপত্তিলাভ করা ইয়াং জি বাসিন নদীর অববাহিকায় পাওয়া যায়। বলিভিয়া ও পেরুর মধ্যবর্তী সীমান্তের কোন এক জায়গা থেকে পাওয়া গেছে আলু। দক্ষিণ কাজাখস্তানের বনভূমি থেকে এসেছে আপেল। তবে কিছু শস্যের উৎপত্তি সময়ের সাথে সাথে মুছে গেছে ইতিহাস থেকে। এমন কিছু শস্যের মধ্যে একটি হলো ‘তরমুজ’। যার উৎপত্তি নিয়ে আছে অজস্র মতামত।
তবে ধারণা করা হয়, তরমুজের পূর্বপুরুষ আফ্রিকান। আবার লিবিয়া এবং মিশরের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি ঘেঁটে ধারণা করা হয়, কয়েক হাজার বছর আগে সেখানে তরমুজের চাষ করা হতো। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্যালেওবোটানিস্টদের মতে, বিভিন্ন জাতীয় সিট্রুলাস প্রজাতির ক্ষুদ্র বুনো প্রতিনিধিদের সাথে তরমুজের উৎপত্তির খুব গভীর সম্পর্ক আছে। এই সিট্রুলাসগুলো এখনও দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক এবং জাম্বিয়া, নামিবিয়া এবং বোটসওয়ানা প্রান্তরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মরুভূমিকে অনেকে তরমুজের জন্মভূমি বলে থাকে, যেখানে আজও বুনো তরমুজ দেখা যায়। ধারণা করা হয়, আধুনিক তরমুজের পূর্বপুরুষ কষ্টসহিষ্ণু এবং খরা-সহিষ্ণু এক ধরনের উদ্ভিদ, যে উদ্ভিদ কালাহারি মরুভূমি পার করা উপজাতিদের জন্য পানি জমিয়ে রাখে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাংলা সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় অফিশিয়াল ভাষা। এই সিয়েরালিওন আফ্রিকার যে অঞ্চলে অবস্থিত সেই পশ্চিম আফ্রিকা তরমুজের জন্মভূমি হিসেবে বিখ্যাত— এ রকম একটি জনপ্রিয় মতও চালু আছে।
এমনকি আধুনিক তরমুজের যে নাম সিট্রুলাস লেনাটাস— বলা হয়ে থাকে, সেটা ভুল। ল্যাটিনে লেনাটাস অর্থ লোমশ। তরমুজের নাম হওয়া উচিত সিট্রন মেলনের (সিট্রুলাস এমারাস্য) নাম অনুসারে। সিট্রন মেলন, যা কিনা দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মাতো, তরমুজের পূর্বপুরুষের অন্যতম জনপ্রিয় দাবিদার। তবে এগ্রিকালচারাল রিসার্চ অরগানাইজেশন ইন ইসরায়েলের হর্টিকালচারালিস্ট হ্যারি প্যারিসের এই মত নিয়ে দ্বিমত আছে।
তিনি দেখেন যে, মিশরে তরমুজ চাষ শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় তরমুজ পাওয়ার বেশ আগে থেকেই। হ্যারি প্যারিস অনুমান করেন, প্রাচীন মিশরও তরমুজের আদিভূমি হতে পারে। প্রাচীন মিশরীয়দের তরমুজ চাষের ছবি দেখে তিনি বলেন, মিশরীয়দের কৃষির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো এবং এটি পশ্চিম আফ্রিকার কৃষির চেয়েও প্রাচীন। প্রাচীন মিসরের দ্বাদশ রাজবংশের রাজা আমেনমহাট–১ এর শাসন আমলে (১৯৯১-৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) তরমুজের দেখা পাওয়া যায়। এ ছাড়া তুতেনখামেনের সমাধিমন্দিরের গায়ে যে চিত্র রয়েছে, সেখানেও তরমুজের চিত্র দেখা যায়। উত্তর আফ্রিকার স্থানীয় ‘গুরুম’ আধুনিক তরমুজের পূর্বপুরুষ হিতে পারে বলে মনে করেন প্যারিস।
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, সেন্ট লুইস-এর সুসেন রেনের এবং ব্রিটেইনের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের গুইলিয়াউম চোমিকি সিট্রুলাসের এক প্রজাতির জিনেটিক ডেটার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর কার্যধারায় এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই গবেষণা থেকে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, সুদানের পশ্চিমে অবস্থিত দারফুর অঞ্চলে উৎপন্ন সুদানিস করদোফান মেলনের একটি উপ-প্রজাতি হচ্ছে আধুনিক তরমুজ।
বলা হয়ে থাকে, সিট্রুলাসের খুব কম প্রজাতিই সুস্বাদু, বেশির ভাগগুলো এতোটাই বিস্বাদ যে মানুষ খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেনি। তবে চার হাজার চারশো পঞ্চাশ বছর আগের মিশরের এক সমাধিমন্দিরে আঁকা পেইন্টিং প্রচলিত এই ধারণা ভেঙে দেয়। পূর্বের ধারণা ছিল, প্রথম দিকে চাষ করা তরমুজ কাঁচা খাওয়ার পক্ষে খুব তিক্ত ছিল। এজন্য এটি রান্না করতে হতো এবং এতে মিষ্টি যোগ করতে হতো। তবে খোঁজ পাওয়া এই পেইন্টিং থেকে জানা যায়, সরু এবং লম্বা দাগঅলা তরমুজ সে সময় পদ্মফুল দিয়ে সাজিয়ে খাবার জন্য কাঁচা পরিবেশন করা হতো। এছাড়া লিবিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অন্যান্য বীজের সাথে প্রায় ৫ হাজার বছর পুরনো তরমুজের বীজ উদ্ধার করে। এর থেকে ধারণা করা হয়, কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই মানুষের খাদ্যতালিকায় তরমুজ ছিল।
গ্রিক এবং রোমানরা তরমুজকে পথ্য হিসেবে ব্যবহার করেছে। প্রাচীন গ্রিকে তরমুজকে বলা হতো পেপন। চিকিৎসকেরা বিভিন্ন রোগ থেকে আরোগ্য লাভের উপায় হিসাবে তরমুজের কদর করতো। তরমুজকে মূত্রবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। শিশুদের হিটস্ট্রোকের ক্ষেত্রেও তরমুজ পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রোমান পুষ্টিবিদ প্লিনি দ্য এল্ডারও তরমুজে প্রশংসা করে পেপোকে (রোমে তরমুজকে পেপো বলা হতো) অত্যন্ত শীতল খাদ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যা তার প্রথম শতকের বিশ্বকোষ হিস্টোরিয়া নাটুরালিসে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মিশরে প্রথম তরমুজ চাষের তথ্য জানা যায়। যার বর্ণনা প্রাচীন সব বিল্ডিংয়ের গায়ে আঁকা মিশরীয় চিত্রলিপিতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ মৃত রাজাদের পরকালের পুষ্টিবিধানের জন্য সমাধিতে তরমুজ রাখা হতো। মিশর থেকেই বণিক জাহাজে করে ভূমধ্যসাগরীয় পথে তরমুজ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে সপ্তম শতকে প্রথম তরমুজ চাষ করা হয়। দশম শতকে তরমুজ চীনে পৌঁছায়। চীন বর্তমানে পৃথিবীর সর্বাধিক তরমুজ উৎপাদনকারী দেশ। এরপর ১৩ শতকে এসে পতিত জমিতে চাষের মাধ্যমে তরমুজ য়ুরোপে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০২২
আপনার মতামত জানানঃ